চা-শ্রমিকের মজুরি ৪০২ নাকি ১৫৮ টাকা

একজন চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি নিয়ে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক। চা-শ্রমিকরা দৈনিক ১২০ টাকার বদলে ৩০০ টাকা মজুরির দাবি সামনে আনায় এ আলোচনা শুরু হয়।
চা-শ্রমিক
ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

একজন চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি নিয়ে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক। চা-শ্রমিকরা দৈনিক ১২০ টাকার বদলে ৩০০ টাকা মজুরির দাবি সামনে আনায় এ আলোচনা শুরু হয়।

চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের (বিটিএ) মতে, সব সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে মজুরি আসলে ৪০২ টাকা। চা-শ্রমিকদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সন্তানদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদ (উৎস) দাবি করেছে সব মিলে একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরি পড়ে ১৫৮ টাকা।

তারা বলছেন, যেসব ভাতার কথা বলে বাগান মালিকরা বেশি মজুরির দেওয়ার দাবি করছেন, শ্রম আইন ২০০৬ এর ১০৮(১) ধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত কাজের জন্য বিভা মজুরি প্রদানের কথা উল্লেখ আছে এবং এটি দৈনিক মজুরিতে যুক্ত হবে না।

মজুরির বাইরেও চা-শ্রমিকরা আবাসন, রেশন, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা ভাতা পান। আছে বিনোদন ভাতা, উৎসব ভাতাও। এসব সুযোগ-সুবিধা মিলিয়েই প্রতিদিন প্রতি জনের পেছনে ন্যূনতম ৪০২ টাকা ব্যয় হয় বলে বাগান মালিকদের দাবি।

চা-শ্রমিক
ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

বাংলাদেশীয় চা সংসদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, মজুরি হিসেবে নগদ অর্থ ছাড়াও একজন শ্রমিককে দৈনিক ঘর ভাড়া বাবদ ৭৬ টাকা ৯২ পয়সা, চিকিৎসা বাবদ সাড়ে ৭ টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ শূন্য দশমিক ০২ টাকা, বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪ টাকা, অবসরভাতা ২ টাকা, গরু চরানো বাবদ ১ টাকা, চা-শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষা ব্যয় বাবদ দেড় টাকা দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদ (উৎস) বলছে, মালিকরা যে এসব সুযোগ-সুবিধাকে মজুরি দাবি করছেন, তা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২ ধারার ৪৫ উপধারা অনুযায়ী করা যায় না।

উৎস'র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি চম্পা নাইডু দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, মজুরির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে—'মজুরি' অর্থ টাকায় প্রকাশ করা হয় বা যায় এমন সব পারিশ্রমিক যা চাকরির শর্তাবলী, প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন, পালন করা হলে কোনো শ্রমিককে তার চাকরি বা কাজের জন্য দেওয়া হয়। এবং এমন প্রকৃতির অন্য কোনো অতিরিক্ত প্রদেয় পারিশ্রমিকও এর অন্তর্ভুক্ত হবে, তবে নিম্নলিখিত অর্থ তার অন্তর্ভুক্ত হবে না। যেমন:

(ক) বাসস্থান সংস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা বা অন্য কোনো সুবিধা প্রদানের মূল্য অথবা সরকার কর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা বাদ দেওয়া হয়েছে এমন কোনো সেবার মূল্য

(খ) অবসর ভাতা তহবিল বা ভবিষ্যৎ তহবিলে মালিক কর্তৃক প্রদত্ত কোনো চাঁদা

(গ) কোনো ভ্রমণ ভাতা অথবা কোনো ভ্রমণ রেয়াতের মূল্য

(ঘ) কাজের প্রকৃতির কারণে কোনো বিশেষ খরচ বহন করার জন্য কোনো শ্রমিককে প্রদত্ত অর্থ।

আইনের এসব ধারার কথা তুলে ধরে উৎস'র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ কৈরি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাগান মালিকরা মিথ্যাচার করছেন। অপপ্রচার চালাচ্ছেন। শ্রম আইন ও বাস্তবতার সঙ্গে তাদের প্রচারণার কোনো মিল নেই।'

গত মঙ্গলবার চা সংসদের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়—চা-শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের পরোক্ষ যেসব সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে তা বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পের তুলনায় নজিরবিহীন।

আরও জানানো হয়, এই শিল্পে প্রতি শ্রমিককে ২ টাকা কেজি দরে মাসে প্রায় ৪২ কেজি চাল বা আটা রেশন হিসেবে দেওয়া হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১০ টাকা। তা ছাড়া, শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা আরও সুদৃঢ় করতে চা-শিল্পে প্রায় ৯৪ হাজার ২০০ বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য বিনামূল্যে চা-শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে।

উৎস'র কেন্দ্রীয় কমিটির বিশ্বজিৎ কৈরি বলেন, 'শ্রম আইন ২০০৬ ও শ্রমিকের প্রাপ্ত প্রকৃত সুবিধার ভিত্তিতে চা-শ্রমিকদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়।

তিনি জানান, একজন পুরুষকে ৩ দশমিক ২৭ কেজি, পোষ্য নারীকে ২ দশমিক ৪৪ কেজি, শিশুকে ১ দশমিক ২২ কেজি হিসেবে মোট ৬ দশমিক ৯৩ কেজি আটা দেওয়া হয়। নারী শ্রমিকের পোষ্য রেশন নেই। নারী শ্রমিকই প্রধান শ্রমিক। তিনি অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। ধানী জমি থাকলে রেশন দেওয়া হয় না।

তার মতে, 'মালিকপক্ষের দাবির তুলনায় রেশন অনেক কম ও নিম্নমানের।'

সংবাদ সম্মেলনে বাগান উদ্যোক্তাদের দাবি, চা উত্তোলনের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই, সে ক্ষেত্রে একজন শ্রমিক দৈনিক কর্মঘণ্টার মধ্যে অতিরিক্ত পাতা উত্তোলনের জন্য বোনাস পেয়ে থাকেন, যা বাগানভেদে গড়ে দৈনিক ৬৫ টাকা হয়।

রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজ করে শ্রমিকরা আরও অতিরিক্ত আয় করে থাকেন উল্লেখ করে তারা আরও দাবি করেন, এ ক্ষেত্রে একজন শ্রমিক দৈনিক গড়ে প্রায় ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা পর্যন্ত নগদ মজুরি পেয়ে থাকেন।

উৎস'র কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি রঞ্জিত রবিদাশ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি শ্রমিকের অতিরিক্ত কাজের টাকা। শ্রম আইন ২০০৬ এর ১০৮(১) ধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত কাজের জন্য বিভা মজুরি দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। এটি দৈনিক মজুরিতে যুক্ত হবে না।

তা ছাড়া বার্ষিক ছুটি ভাতা, বেতনসহ ১৪ দিনের উৎসব ছুটি ভাতা, ২০ দিনের অসুস্থজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতাসহ আরও কিছু প্রত্যক্ষ সুবিধা মিলিয়ে একজন শ্রমিক দৈনিক গড়ে ২৪৬ টাকা নগদ পেয়ে থাকেন বলেও দাবি করেন তারা।

তবে ছুটির দিনে কাজ করালে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে তা শ্রম আইনের একটি সাধারণ বিষয়।

উৎস'র সিন্ডিকেট সদস্য স্বপন নাইডু বলেন, শ্রম আইনের ১০৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো দিন বা সপ্তাহে এই আইনের অধীন নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করেন, সে ক্ষেত্রে তিনি সেই কাজের জন্য তার মূল মজুরি ও মহার্ঘ ভাতা এবং এডহক বা অন্তর্বর্তী মজুরি, যদি থাকে, এর সাধারণ হারের দ্বিগুণ হারে ভাতা পাবেন।'

ফলে, ছুটির দিনে কাজ করাকে মজুরি হিসেবে দেখানো যাবে না।

উৎস'র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি চম্পা বলেন, 'আমি নিজে চা-শ্রমিকের কন্যা। মালিক পক্ষ যে সুযোগ-সুবিধার কথা বলছে আমি নিজের চোখে সেগুলো দেখেছি। শ্রমিকরা নামমাত্র কিছু পায়।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রায় ১৭০ বছর ধরে বসবাসকৃত ভিটায় যদি কোনো ফলের গাছ লাগানো হয় তাহলে সেটাও কি দৈনিক আয় হিসেবে ধরতে হবে? এটা হাস্যকর। চিকিৎসা মানে সব রোগের ওষুধ প্যারাসিটামল, নাপা, হিসটাসিন।'

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, 'ভাঙা প্রাইমারি স্কুলঘর। পর্যাপ্ত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই। শিক্ষা সুবিধা শুধু প্রাইমারি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। অনেক বাগানে তাও নেই।'

শ্রম আইনের সঙ্গে নিজেদের দাবির ব্যবধান সম্পর্কে চা-শিল্পের উদ্যোক্তা ও সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আফজাল রশীদ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যে সেবাগুলো দিচ্ছি, তা মজুরি হিসেবে ধরা যাবে না। আমাদের তো এই টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। ব্যবসা করেই আমাদের এই টাকা দিতে হয়। ব্যবসায় যদি লাভই না করতে পারি তবে এসব সেবা কোথা থেকে দেব?'

বাগান মালিকদের এমন দাবি প্রসঙ্গে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক। বাগান ইজারা নেওয়ার শর্তেই আছে, শ্রমিকদের বাসস্থান করে দিতে হবে। চা-চাষের বাইরের জমি শ্রমিকদের চাষবাষের জন্য দিতে হবে।'

'বাস্তবে দেখা যায় বাগান মালিকরা রাবার বাগান করে, মাছ চাষ করে সব জমি নিজেরাই দখল করে নেন। শ্রমিকদের চাষের জন্য জায়গা ফাঁকা থাকে না।'

তিনি আরও বলেন, 'শ্রমিকদের আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য যে সেবা দেওয়া হয় তা খুবই নাজুক। বেশির ভাগ বাগানেই স্কুল নেই। চিকিৎসক নেই, ওষুধ নেই। বাগান মালিকদের এসব প্রচারণার ভিত্তি নেই। নিজেদের শোষণ টিকিয়ে রাখতেই তারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন।'

Comments

The Daily Star  | English

Six state banks asked to cancel contractual appointments of MDs

The Financial Institutions Division (FID) of the finance ministry has recommended that the boards of directors of six state-run banks cancel the contractual appointment of their managing directors and CEOs..The six state-run banks are Sonali Bank, Janata Bank, Agrani Bank, Rupali Bank, BAS

1h ago