জর্জ অরওয়েলের যে বইয়ে ‘ভিন্নমত বলে কিছু নেই’

কেউ প্রশ্ন করলে পেতে হয় নির্যাতন, দমন করা হয় অন্য রাজনৈতিক দলকে।

রাষ্ট্র সবসময়ই নজর রাখে জনগণের উপর। ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সেই রাষ্ট্রে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা হলো অপরাধ। কেউ প্রশ্ন করলে পেতে হয় নির্যাতন, দমন করা হয় অন্য রাজনৈতিক দলকে।

এটা কোন বাস্তব ঘটনা নয়; এটা একটি উপন্যাসের গল্প। এই ধরণের উপন্যাসকে বলা হয় 'স্পেকুলেটিভ ফিকশন' বা দূরকল্প সাহিত্য। অদূর ভবিষ্যতে এই ধরণের বাস্তবতা হলেও হতে পারে, এমনই মনে করতেন লেখকেরা।

এই ধরণের সাহিত্যে জর্জ অরওয়েল বেশ চর্চিত একটি নাম। তার লেখা 'অ্যানিমেল ফার্ম' কিংবা '১৯৮৪' বই এখনও পঠিত হয়। ১৯৮৪ বইতে আমরা ওশেনিয়া নামক একটি কাল্পনিক দেশ দেখতে পাই, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালককে বলা হয় 'বিগ ব্রাদার'। এই বিগ ব্রাদার যা বলেন, তা ধ্রুব সত্য। তিনি যদি কখনও বলেন, আগামী বছর বর্ষায় সব ডুবে যাবে কিন্তু দেখা গেল পরের বছর বর্ষায় কিছুই ডুবল না, তবে ইতিহাস থেকে তার কথা বদলে দেয়া হয়। ইতিহাস, সংবাদপত্র ও ডকুমেন্ট থেকে মুছে দেয়া হয় তার বর্ষায় ডুবে যাওয়ার কথা। এমনভাবে বিগ ব্রাদারের সত্যকে বিনির্মাণ হয়, যেন তিনি এই কথা কখনও বলেননি। এই কাজে নিযুক্ত আছে স্বয়ং একটা মন্ত্রণালয়। সেখানের একজন কর্মী উপন্যাসের মূল চরিত্র।

এই দেশে কোন ভিন্নমত বলে কিছু নেই। ওশেনিয়ায় রাষ্ট্রীয় কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা যায় না। যদি প্রশ্ন করা হয়, তবে পেতে হয় চরম নির্যাতন। এমনকি ভিন্নমত ও ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা সেই 'আসামি'র চিন্তাশক্তি ও স্মৃতি নষ্ট করে দেয়া হয়। যেন তার মনে না থাকে যে, সে কোন একদিন ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছিল।

তবে মজার ব্যাপার হলো, সেই দেশে কিছু নির্দিষ্ট স্থান আছে, যেখানটায় মূলত দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা মানুষেরা থাকে। তাদেরকে বলা হয় 'প্রোল'। এই প্রোলেদের বিষয়ে রাষ্ট্র খুব একটা চিন্তা করে না। তাদেরকে প্রচুর মদ, অশ্লীলতা ও জুয়া খেলার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে, নেই কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বালাই। ওশেনিয়ায় সারা বছরই যুদ্ধ চলে। কেন যেন যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিগুলো সবসময় এই প্রোলদের এলাকাতেই হয়। এখানেই বোমাগুলো পরে ও মানুষ হতাহত হয়।

তবে এই রাষ্ট্রে আরেকটি বহুল প্রচলিত আচার আছে। সেটা হলো, দুই মিনিটের ঘৃণা। একসময় রাষ্ট্রের সঙ্গে থাকা জনৈক ইমানুয়েল গোল্ডেস্টাইন নামক ব্যক্তিকে টিভিতে দেখানো হয়, যিনি একসময় সরকারেরই একজন হলেও, এখন রাষ্ট্রের চরম শত্রু। তার প্রতি ঘৃণা ব্যক্ত করা ওশেনিয়ার প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। নিয়মিতই টিভিতে তার ভিডিও দেখানো হয়, যেখানে তিনি 'বাক স্বাধীনতা চাই, মুক্ত সাংবাদিকতা চাই' ইত্যাদি 'অশ্লীল' কথাগুলো বলতে থাকে। আর জনগণ নিয়ম অনুযায়ী তার প্রতি ঘৃণা ছুড়তে থাকে।

১৯৮৪ নামের বইয়ের এই বইটি পড়েননি এমন কাউকে বললে চমকে যেতে দেখা যায়। তারা ভাবে, এটা কোন উপন্যাস নয়; এ যেন আধুনিক সময়ের পরিচিত কোন দেশের কথা। কিন্তু আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই; বরং এটা নিছক স্পেকুলেটিভ ফিকশন।

১৯৮৪ উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নজরদারি। সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীন বিগ ব্রাদারের পক্ষ থেকে সবাইকে নজরদারিতে রাখা হয়। কেউ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বলছে কিনা কিংবা রাষ্ট্রকে নিয়ে কেউ নেতিবাচক কিছু ভাবছে কিনা সে ব্যাপারেও থাকে আলাদা নজর। এমনকি ভাবনা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রয়েছে আলাদা লোকও। মজার ব্যাপার হলো, উপন্যাসের রাষ্ট্রের সবাই এটা জানে বটে, তবে কোন বিকার তারা করে না। আর এই স্বচ্ছ নজরদারির বিষয়টি বিচার বিভাগের আওতামুক্ত রাখা হয়।

ঠিক যে বছর জর্জ অরওয়েলের লেখা এই উপন্যাসটি প্রকাশকের কাছে জমা দেন, ঠিক সে বছরই জাতিসংঘে 'মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র' গৃহীত হয়। সেই ঘোষণাপত্রের ১২ নং ধারায় ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার ও ১৮ নং ধারায় চিন্তার স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর জাতিসংঘের এই মানবাধিকারের ধারাগুলো কি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হয়েছে?

আধুনিক সময়ে শুধুমাত্র চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতেই প্রতি ১০০ জন মানুষের জন্য গড়ে ১৪টি ক্যামেরা রয়েছে নজরদারি করার জন্য। এছাড়াও গণনজরদারির জন্য আছে ইন্টারনেটে আড়ি পাতার বিভিন্ন ব্যবস্থা। নাগরিকের কোন ধরণের অনুমতি ছাড়াই তার ইন্টারনেট সেবা ব্যহত করা, বন্ধ করে রাখা কিংবা আড়ি পাতার মতো কাজগুলো হচ্ছে অনায়াসে। ভাগ্যিস জর্জ অরওয়েল মশাই আমাদের দেশ সম্পর্কে জানতেন না।

গত বছর প্রকাশ হওয়া 'ফিউচার মার্কেট ইনসাইট' নামের একটা সংস্থার জরিপের বরাত দিয়ে প্রথম আলো বলছে, বিশ্ববাজারে শুধুমাত্র নজরদারি ও আড়িপাতার যন্ত্র বিষয়ক বাজারের আকার প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরে যা ৩০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারে। অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় রিজার্ভের পরিমাণও এরচেয়ে কম। তবে এটা থেকে বোঝা যায়, রাষ্ট্র তার জনগণকে নজরদারিতে রাখার জন্য যে পরিমাণ খরচ করছে, তা খাদ্য খাতে ব্যয় করলেও অনেক দেশ থেকে ক্ষুধা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যেত।

তবে আমরা সুখী থাকার জন্য চোখ বুজে ধরে নিতেই পারি, এগুলো কোন বাস্তব ঘটনা নয়। এগুলো বরং স্পেকুলেটিভ ফিকশনের ধারণা। তবে চলুন আরেকটি স্পেকুলেটিভ ফিকশনের গল্প শোনা যাক। রে ব্র্যাডবেরির লেখা বই 'ফারেনহাইট ৪৫১'। এই উপন্যাসের গল্পে আমরা দেখি এমন একটি শহর, যেখানে বই পড়া নিষেধ। 

এই বইয়ের গল্পের দিকে খেয়াল করলে দর্শনটি বুঝতে সুবিধে হয়। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে পারা কিংবা অন্যান্য দেশে কী ঘটেছে তার উদাহরণ দেখানো, এই পুরো জ্ঞান অর্জনটার অনেকাংশই হয়ে থাকে বইয়ের পাতা থেকে। এমনকি বইয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থেকেও যেসব জ্ঞান আহরণ হয়, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে শেখা অথবা জ্ঞানী মানুষের কাছ থেকে জ্ঞান নেয়ার বিষয়টিও কিন্তু পরোক্ষভাবে বই থেকেই জ্ঞান অর্জন করা। কারণ যাদের কাছ থেকে আপনি শিখছেন বা জানছেন, তারাও কোন না কোনভাবে হয়তো সেগুলো বই থেকেই জেনেছে। যেহেতু বই-ই জ্ঞানের একটা বড় উৎস, তাই বই-ই পড়তে দেয়া যাবে না।

'ফারেনহাইট ৪৫১' উপন্যাসে দেখানো শহরের দমকল বাহিনীর কাজ আগুন নেভানো নয়; বরং বই দেখলেই আগুনে পুড়িয়ে দেয়া। গল্পের মূল চরিত্র সেই দমকল বাহিনীর সদস্য।

মূল চরিত্র একটি কিশোরীর সঙ্গে পরিচিত হয়, যেই কিশোরী তাকে প্রশ্ন করে সে কি জীবন নিয়ে সুখী। এই প্রশ্ন আমাদের মূল চরিত্রকে একধরণের জটিল সংকটে ফেলে দেয় এবং সে তার নিজের স্ত্রী'কে কল্পনা করতে থাকে। কারণ তার স্ত্রী যে রাতে আত্মহত্যা করার জন্য ঘুমের ঔষধের প্রায় পুরো বোতলটাই খেয়ে নিয়েছিল, সে সকালে কোনভাবে বেঁচে ওঠার পর স্বাভাবিকভাবেই টিভিতে অনুষ্ঠান দেখছিল। যেন কিছুই হয়নি। এই একঘেয়ে ও প্রশ্নহীন জীবন আদৌ তাদেরকে কতটুকু সুখী করেছে এই ধরণের প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরতে থাকে।

বই পড়া মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ বই পড়ার কারণে মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন জন্মায়, নানা মতামত উঠে আসে। বই নেই, কোন মতামতও নেই, পোড়াও বই। রাষ্ট্রের মতামতই সেখানে একমাত্র মতামত।

এই গল্পে আমরা দেখতে পাই, কেন সেখানে বই পড়া নিষিদ্ধ হয়েছিল। কারণ মানসিকভাবে ভেঙে পরার পর ফায়ার হাউজের নেতা এসে মূল চরিত্রকে বোঝায়, টেলিভিশন আবিষ্কার হবার পর মানুষের বই থেকে আগ্রহ ক্রমেই কমতে থাকে। কিন্তু ক্রমেই শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে, বই আসলে কাউকে সুখী করে না। বই পড়ে অনেকেই অনেক রকম প্রশ্ন করতে শিখে, যেগুলো তাদের ভেতর অস্থিরতা তৈরি করে। এই ধরণের অসমতা, অস্থিরতা বন্ধ করতেই মূলত বইকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এখানেই জর্জ অরওয়েলের লেখা '১৯৮৪' উপন্যাসটি আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কারণ '১৯৮৪' উপন্যাসে দেখানো রাষ্ট্রেও কিন্তু সরকারের নির্দেশে বই পোড়াতে দেখা যায়। সেখানে 'সরকারের অনুমোদিত' তিনটে বই ছাড়া কোন বই পড়াকেও অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। সরকার ঠিক করে দেয়, আপনি কী পড়বেন এবং কী ভাববেন।

তেমনি রে ব্র্যাডবেরির 'ফারেনহাইট ৪৫১' উপন্যাস আমাদের দেখায়, বই পড়া মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ বই পড়ার কারণে মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন জন্মায়, নানা মতামত উঠে আসে। বই নেই, কোন মতামতও নেই, পোড়াও বই। রাষ্ট্রের মতামতই সেখানে একমাত্র মতামত। 

রে ব্র্যাডবেরি ও জর্জ অরওয়েলের আলোচিত বই থেকে আমরা একটি জিনিস খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি, রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন করা ও ভিন্নমত একটি হুমকির বিষয়। বাক স্বাধীনতা ও ভিন্নমত দমন করার জন্য তাই এই দুই উপন্যাসের রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ হাতে নেয়। কেউ হয়তো দমকল বাহিনী দিয়ে বই পুড়িয়ে দেয়, আবার কেউ হয়তোবা রাষ্ট্রের কণ্ঠস্বরকেই একমাত্র কণ্ঠস্বর হিসেবে বাস্তবায়িত করতে চায়।

এই অন্ধকারের কথা আসছে তার সাহিত্যে। এই দু'টো বই প্রকাশের অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও বইগুলো নতুন মনে হয়। যেন এবছরের কেউ লিখেছে। জানিয়ে রাখি, এসব বই নিষিদ্ধও হয়েছে কোন কোন দেশে। কেউ জেলে গেছেন শুধুমাত্র বই পড়েছিলেন বলে। তাই যে অন্ধকার পৃথিবীর কথা বলে গেছেন সাহিত্য, জানালা খুললে সেই পৃথিবী আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে সহসাই। এখন সেই পৃথিবী থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন না জানালা বন্ধ করে রাখবেন- একান্ত আপনার ব্যাপার। 

Comments