এখনো ‘ঘুমিয়ে’ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, আশাবাদী পরিচালক

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, আগের সরকারের মতোই  হকারের ভিড় মূল ফটকে। দূর থেকে বুঝার উপায় নেই প্রবেশ গেইট কোন দিকে। ছবি: স্টার

বই ও প্রকাশনা শিল্পের বিকাশে কাজ করার ক্ষেত্রে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। 'জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও গ্রন্থমনস্ক জাতি গঠন'র লক্ষ্যে প্রায় ৫২ বছর আগে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এর যথাযথ কার্যক্রম কী, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই অনেকের। কারণ গত অন্তত দুই দশক ধরে ঢিমেতালে চলছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। বই ও প্রচ্ছদে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার, নতুন বই প্রকাশ ও বিক্রি এবং প্রদর্শনী কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে তারা।

গত ১৪ নভেম্বর সকাল ১০টা নাগাদ সরেজমিনে গুলিস্তান মাজার সংলগ্ন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, আগের সরকারের মতোই  হকারের ভিড় মূল ফটকে। দূর থেকে বুঝার উপায় নেই প্রবেশ গেইট কোন দিকে। উপরে তলায় মেলা ও বেসরকারি গ্রন্থাগারে বই সরবরাহের জন্য একটি 'সেলস সেন্টার' আছে প্রতিষ্ঠানটির গ্রন্থ ভবনে। সেখানে 'মহানগর পাঠাগার' নামে একটি লাইব্রেরিও আছে। খবরের কাগজ পড়ার কক্ষের টেবিলে ১৫টির মতো জাতীয় দৈনিক পত্রিকা থাকলেও সেখানে কোনো পাঠক দেখা যায়নি। পাঠাগারের নিবন্ধন খাতার তথ্য অনুসারে, গত এক সপ্তাহে সেখানে গিয়েছেন মাত্র ১৫০ জন।

গ্রন্থকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ইউনেসকোর ঘোষণা ও জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল বুক সেন্টার ফর পাকিস্তান। ঢাকায় এর একটি শাখা খোলা হয়। স্বাধীনতার পর এর নামকরণ হয় 'জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বাংলাদেশ'। ১৯৯৫ সালে জাতীয় সংসদে নতুন আইন প্রণয়ন করে প্রতিষ্ঠানটির নাম 'জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র' করা হয়। একইসঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হয়।

ওই আইনে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কার্যক্রম উল্লেখ করা আছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির কাজগুলো হলো—

১। সৃজনশীল প্রকাশনাকে উৎসাহিতকরণ ও পাঠক সৃষ্টি করা, ২। গ্রন্থন্নোয়নে পাঠসামগ্রীর ওপর গ্রন্থপঞ্জি প্রকাশ এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রকাশ করা, ৩। বই বা গ্রন্থ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনা ও তৎসম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা, ৪। আন্তর্জাতিক বা বিভাগীয় বা জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে বইমেলার আয়োজন, ৫। গ্রন্থাগার সেবার মান উন্নয়ন ও জনসাধারণের মধ্যে পাঠ সচেতনতা সৃষ্টি করা, ৬। গ্রন্থ প্রকাশনাকে উৎসাহিত করার জন্য শ্রেষ্ঠ প্রকাশককে পুরস্কৃত করা, ৭। শিল্পসম্মত ও উন্নতমানের পুস্তক মুদ্রণকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ মুদ্রাকরকে পুরস্কৃত করা, ৮। বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে আর্থিক অনুদান ও বই প্রদান করা, ৯। বেসরকারি গ্রন্থাগারের সক্ষমতা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাগারের কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, ১০। গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ে সরকারকে সহায়তা দেওয়া, ১১। গ্রন্থবিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা, ১২। মাসিক পত্রিকা 'বই' মুদ্রণ করা এবং ১৩। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষ দিবস উদযাপন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রের এই ১৩ কাজের মধ্যে এক ও তিন নম্বরটি কোনোরকমে চলছে। দুই নম্বর কাজের ক্ষেত্রে তারা কেবল অনলাইনে প্রকাশ করে থাকে। চার নম্বর কাজের ক্ষেত্রে কেবল বিভাগীয় বইমেলার আয়োজন করা হয়। পাঁচ ও ছয় নম্বর কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ। ১২ নম্বরে থাকা মাসিক পত্রিকা 'বই' এখন তিন মাসে একবার বের করা হয়। তবে চলতি অর্থবছরে এখনো 'বই' প্রকাশিত হয়নি।

'বই' পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা সূত্রে জানা যায়, আগে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র নিজেরাই বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশ করত এবং কখনো কখনো বইয়ের পরিবেশকও হতো। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তারা নিজেদের বাইরের প্রকাশনার বইও বিক্রি করতেন। শিল্পসম্মত ও উন্নতমানের বই মুদ্রণকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ মুদ্রাকর ও প্রচ্ছদ শিল্পীকে পুরস্কৃত করা হতো ২০০৫ সাল পর্যন্ত। তারপর এগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। মাসিক 'বই' পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ হতো ২০১৬ সাল পর্যন্ত।

উপপরিচালক ফরিদ উদ্দিন সরকারও এই তথ্য সমর্থন করে জানান, ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর কেন্দ্রের ৮০তম সভায় 'বই' পত্রিকাকে মাসিক থেকে ত্রৈমাসিক করে দেওয়া হয়। সেই সভায় ছিলেন কেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক নজরুল ইসলাম ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

গ্রন্থকেন্দ্রের বেশিরভাগ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, 'কাজের তুলনায় আমাদের লোক কম। আর "বই" পত্রিকা নিয়মিত করা ঝামেলার কাজ এবং ভালো লেখাও পাওয়া যায় না। তাই সেটা অনিয়মিত হয়ে গেছে।'

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের নতুন পরিচালক কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক আফসানা বেগম।

গত ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে নতুন পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে এখন কী কাজ চলছে—জানতে চাইলে বর্তমান পরিচালক কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক আফসানা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি যোগ দেওয়ার পর বেসরকারি গ্রন্থাগারে বই সরবরাহের 'অসমাপ্ত' কাজটি সমাপ্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন। একইসঙ্গে বিভাগীয় বইমেলা আয়োজন, প্রায় ৮০ জন গ্রন্থাগারিকের প্রশিক্ষণসহ বেশকিছু সেমিনার-সভার আয়োজন করেছেন। পাশাপাশি কেন্দ্রের কাঠামো সংস্কার এবং বই কেনার বিষয়ে কাজ করছেন।

বিষয়টি নিয়ে পরিচালক আফসানা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এত কাজ যে করার আছে, সেটা আগে জানা ছিল না। এসেই জানলাম- আমাদের জনবল কম, কাঠামো নেই। তথাপি আমি ধীরে ধীরে কাজগুলো করার চেষ্টা করব। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের যে চরিত্র, তা ফিরিয়ে আনব।'

প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক, গ্রন্থাগার বিশেষজ্ঞ ফজলে রাব্বী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই প্রতিষ্ঠানে যেসব পরিচালকরা আসেন, তারা কেউই কাজ করতে আগ্রহী হন না। সেই কারণেই আমার সময়ে নেওয়া উদ্যোগগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। পুরস্কার, বই প্রকাশ, বই বিক্রি ও "বই" পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যাগ বন্ধ হয়ে যাওয়া মোটেই ভালো লক্ষণ না। এটা আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণে খারাপ বার্তা দেয়। সবাই এগিয়ে যায়, আর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পিছিয়ে যাচ্ছে।'

 

Comments

The Daily Star  | English

NBR revises VAT, SD on 9 items following public outcry 

The tax authority brought down the indirect taxes two weeks after the government hiked rates of nearly 100 goods and services drawing opposition from criticisms that the spike would stoke inflation which has been staying over 9 percent since March 2023

16m ago