যেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষের দিনগুলো ও শেষযাত্রা

বোলপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। এটিই জীবিতাবস্থায় তার শেষ ছবি। ছবি: বিনোদ কোঠারি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান আজ থেকে ৮০ বছর আগে ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট। বাংলা পঞ্জিকায় দিনটি ছিল ২২শে শ্রাবণ। এদিন বেলা ১২টা ১০ মিনিটের তার অন্তিম নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে অন্ত হয় বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাবানের জীবনের। যে জীবন কেবল সাহিত্য সৃষ্টির মহোৎসবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সমাজ সংস্কার থেকে শিক্ষা সংস্কার, দর্শন, স্বদেশীয়ানা থেকে প্রতিবাদের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল সে জীবনে।

রবীন্দ্রনাথের শেষের দিনগুলো বললে প্রথমেই আসবে ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। তখন রবীন্দ্রনাথের কিডনির সমস্যা প্রকট আকার ধারন করে। হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সেই যাত্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। 

১৯৪০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে কালিম্পংয়ে পুত্রবধু প্রতিমা দেবীর কাছে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কালিম্পংয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা দিতে ছুটে আসেন দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জন। রক্ত পরীক্ষার পর দেখা গেল প্রস্টেট গ্ল্যান্ডে সমস্যা। দ্রুতই অস্ত্রোপচার করতে হবে। কলকাতা থেকে চিকিৎসক নিয়ে কালিম্পংয়ে গেলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। রবীন্দ্রনাথকে কলকাতায় আনা হলো অজ্ঞান অবস্থায়। এ সময় প্রায় এক মাস শয্যাশায়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একটু সুস্থ হয়েই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ফিরে যেতে ব্যকুল হয়ে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ১৮ নভেম্বর শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন। 

শান্তিনিকেতনে উদয়ন বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, নার্স রাখা হলো। তখন তার শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজ হাতে লিখতে পারতেন না বলে শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সচিব অনিলকুমার চন্দের স্ত্রী ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা রাণী চন্দকে দিয়ে লেখাতেন। এসময় রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি কবিতার সৃষ্টি করেছিলেন। 

শান্তিনিকেতন থেকে শেষবারের মতো কলকাতায় যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। আশ্রমের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মীরা তাকে বিদায় জানাচ্ছেন।

এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করল। কয়েকদিনের মাথায় তার সুস্থ হওয়া নিয়ে সবাই সন্দিহান হয়ে উঠলেন। কারণ কিছুতেই রোগের উপশম হচ্ছে না। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, কবিরাজি কোন ধরনের ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। অপারেশনে একটি ভরসা ছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অপারেশনের বিষয়ে ঘোর আপত্তি। তার যুক্তি ছিল, 'এক ভাবে না এক ভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেন হোক না শেষ। ক্ষতি কি তাতে? মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছিঁড়ি করার কি প্রয়োজন?' 

১৯১৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ চিকিৎসা করছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক স্যার নীলরতন সরকার। বলে রাখা ভালো স্যার নীলরতনও চাননি রবীন্দ্রনাথের এই বয়সে অপারেশন হোক। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ অপারেশন পরবর্তী ধকল নিতে পারবেন না বলেই তার ধারনা। তাই তিনি ঔষধ চালিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন। হঠাৎ স্ত্রী মারা যাওয়ায় গিরিডিতে চলে যান তিনি। 

দেখা যাক, আরও কিছুদিন দেখা যাক এই ভেবে আরও কিছুকাল কাটল। এই সুস্থ তো এই অসুস্থ এই অবস্থা তখন রবীন্দ্রনাথের। ১৬ জুলাই রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য শান্তিনিকেতনে আসেন ডা. বিধানচন্দ্র রায়, ডা. ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডা. ইন্দুভূষণ বসু। আলোচনার এক পর্যায়ে বিধানচন্দ্র রায় রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, 'আপনি আগের থেকে একটু ভালো আছেন। সে কারণে অপারেশনটা করিয়ে নিতে পারলে ভালো হবে, আর আপনিও সুস্থ বোধ করবেন।' সবাই অপারেশনের পক্ষে মত দিলে রবীন্দ্রনাথ সবার অনুরোধে রাজি হলেন। এরপরই সিদ্ধান্ত হলো রবীন্দ্রনাথের অপারেশন করা হবে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে। 

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই জীবনের অন্তিম দিনগুলো কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় ফেরা

২৫ জুলাই ১৯৪১ সাল। দিনটি শুক্রবার। রবীন্দ্রনাথ অজান্তেই যেন বুঝতে পেরেছিলেন এটিই তার শেষ যাত্রা। সাতসকালেই আশ্রমের শিক্ষার্থী, কর্মী, শিক্ষকেরা সমবেত কণ্ঠে এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার' গাইতে গাইতে রবীন্দ্রনাথকে অর্ঘ্য অর্পণ করল। যাওয়ার আগে মোটরগাড়িতে চেপে শান্তিনিকেতন আশ্রমের সবার সঙ্গে দেখা করলেন রবীন্দ্রনাথ। গাড়িতে করেই গোটা আশ্রম ঘোরানো হলো তাকে। আশ্রমের চিকিৎসক শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ডেকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'শচী, আমার আশ্রম রইল, আশ্রমবাসীরাও রইলেন। তুমি দেখে রেখো।' পুরো আশ্রমের মানুষ তাকে দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল চোখে বিদায় জানাল। বোলপুর স্টেশন থেকে ট্রেনের বিশেষ কোচে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়া হলো কলকাতায়।' 

কলকাতার শেষ দিনগুলো যেমন ছিল

২৫ জুলাই দুপুর সোয়া ৩টার দিকে রবীন্দ্রনাথকে আনা হলো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। সাধারণ মানুষ না জানায় স্টেশন কিংবা বাড়িতে কোথাও ভিড় হয়নি তেমন। সারাদিনের ট্রেন ভ্রমণে গরমে বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

তাকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হলো জোড়াসাঁকোর পুরনো বাড়ির পাথরের ঘরে। ভীষণ ক্লান্তিতে স্ট্রেচারের উপরই ঘুমিয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, 'এখন আমাকে নাড়াচাড়া কোরো না, এইভাবেই থাকতে দাও।' তাই আর খাটে আর তোলা গেল না তখন। অপারেশন হবে বলে ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে পুরো ঘর পরিষ্কার করা হয়েছিল। বিকেল নাগাদ কয়েকজন স্বজন তাকে দেখতে এলেও রবীন্দ্রনাথ কারো সঙ্গে কথা বলতে পারলেন না। সন্ধ্যার দিকে খানিকটা দুর্বল অনুভব করলেও সারারাত বেশ স্বস্তিতেই ঘুমান।

২৬ জুলাই সকালটা বেশ আনন্দেই কাটল রবীন্দ্রনাথের। ৮০ বছরের কাকাকে দেখতে এলেন ৭০ বছর বয়সী ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কাকা আর ভাইপো মেতে উঠলেন ছোটবেলার নানা গল্পে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রবীন্দ্রনাথকে গ্লুকোজ ইনজেকশন দেওয়া হয়। ব্যথা অনুভব করে রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'দ্বিতীয়া, গেল সব জ্বলিয়া'। সন্ধ্যার দিকেই হঠাৎ ভীষণ কাঁপুনি উঠল রবীন্দ্রনাথের। আধাঘণ্টা পর ঘুমিয়ে গেলেন তিনি। 

২৭ জুলাই সকালে রাণী চন্দকে দিয়ে শ্রুতিলেখনের মাধ্যমে 'প্রথম দিনের সূর্য' কবিতাটি লেখালেন রবীন্দ্রনাথ। এরপর রাণী চন্দের হাত থেকে খাতা নিয়ে নিজেই সংশোধন করলেন। রসিকতাও বাদ গেলনা। উপস্থিত সবার উদ্দেশে বললেন, 'ডাক্তাররা বড় বিপদে পড়েছে। কতভাবে রক্ত নিচ্ছে, পরীক্ষা করছে কিন্তু কোন রোগই পাচ্ছে না তাতে। এ তো বড় বিপদ ডাক্তারদের। রোগী আছে, রোগ নেই।'

শেষবারের মতো রবীন্দ্রনাথকে দেখতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে মানুষের ভিড়ে ভেঙে যায় বাড়ির ফটক।

২৯ জুলাই সকালবেলা অপারেশন নিয়ে বেশ বিমর্ষ ছিলেন তিনি। বললেন, 'যখন অপারেশন করতেই হবে তখন তাড়াতাড়ি চুকিয়ে গেলেই ভালো।' রবীন্দ্রনাথ জানেন না আগামীকালই তার অপারেশন হবে। এদিন বিকেলে রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা লেখালেন রাণী চন্দকে দিয়ে। 

৩০ জুলাই ১৯৪১, অপারেশনের দিন 

সকাল থেকেই জোড়াসাঁকোতে তোড়জোড় চলছে। আজই অপারেশন হবে রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথ জানেন না আজই তার অপারেশন হবে। কারণ সবকিছু নিঃশব্দে করা হচ্ছে। লম্বা বারান্দার দক্ষিণ দিক ঘেঁষে অপারেশনের টেবিল সাজানো হয়েছে। তিনি কিছুই টের পেলেন না। এদিন সকালে রাণী চন্দকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখালেন তার সর্বশেষ সৃষ্টি। 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে,/হে ছলনাময়ী।/মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে /সরল জীবনে….। একইসঙ্গে পুত্রবধুকে লিখলেন চিঠি।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ডা. ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় অপারেশনের সবকিছু ব্যবস্থা করে রবীন্দ্রনাথের ঘরে ঢুকলেন। বললেন, 'আজ দিনটা ভালো আছে। তাহলে আজ আজই সেরে ফেলি কি বলেন? রবীন্দ্রনাথ একটু হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, 'আজই?' এরপর রাণী চন্দের দিকে পরক্ষণেই বললেন, 'তা ভালো, এরকম হঠাৎ হয়ে যাওয়াই ভালো।' 

বেলা ১১টার দিকে রবীন্দ্রনাথকে স্ট্রেচারে করে অপারেশনের টেবিলে আনা হলো। ক্লোরোফর্মের বদলে অজ্ঞান করা হলো লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে।

মাত্র ২০ মিনিটে অপারেশনের কাঁটাছেঁড়া সম্পাদিত হলো। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগের কারণে ভীষণ ব্যথা পেলেও রবীন্দ্রনাথ অপারেশনের সময় তা প্রকাশ করেননি। অপারেশন পরবর্তী গুমোট হাওয়া উড়িয়ে দিতে বললেন, 'কি ভাবছো তোমরা? খুব মজা না?'

বিকেলের দিকে বেশ ব্যথা অনুভব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সন্ধ্যা ৭টার ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে দেখতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'অপারেশনের সময়ে কি লেগেছিল আপনার? স্বভাবসুলভ রসিকতায় রবীন্দ্রনাথ জবাব দিয়েছিলেন, 'কেন মিছে মিথ্যে কথাটা বলাবে আমাকে দিয়ে।' এদিন রাতে মোটামুটি ঘুম হলো রবীন্দ্রনাথের। 

রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রায় সমাবেত হয়েছিলেন লাখো জনতা।

অপারেশন পরবর্তী সময়

৩১ জুলাই: অপারেশনের পর এদিন বেশ যন্ত্রণা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এদিন দুপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে লাগল। 

১ আগস্ট: সকাল থেকে রবীন্দ্রনাথ কোন কথাই বলছেন না। অসাড় হয়ে পড়ে রইলেন। দুপুরের দিকে কিছু জিজ্ঞেস করলে কেবল মাথা নেড়ে সায় দিলেন। 

২ আগস্ট: এদিন সারাদিনই ভীষণ আচ্ছন্নভাবে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মাঝেমাঝে তার খুব হিক্কা উঠেছিল। 

৩ আগস্ট: এদিন রবীন্দ্রনাথের অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে। সন্ধ্যার ট্রেনে শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকোতে আসেন রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধু প্রতিমা দেবী।

৪ আগস্ট এদিন ভোরবেলায় একটু কথা বললেন রবীন্দ্রনাথ। কেউ ডাকলে সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু রাতের দিকে তার পরিস্থিতির অবনতি হলো।

৫ আগস্ট এদিন সকালে রবীন্দ্রনাথের অপারেশনের একটি সেলাই খুললেন ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্ধ্যার দিকে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে এলেন স্যার নীলরতন সরকার এবং বিধানচন্দ্র রায়। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না রবীন্দ্রনাথের। তারা বারবার নিরীক্ষা করে বুঝতে পেরেছিলেন সময় আর বাকি নেই। এদিন রাতে স্যালাইন দেওয়া হয় রবীন্দ্রনাথকে, রাখা হয় অক্সিজেন। নাকটা বাঁ দিকে হেলে গেছে। বাঁ চোখ লাল বর্ণের হয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির হয়ে গেছে। 

৬ আগস্ট এদিন সকাল থেকে পুরো জোড়াসাঁকো লোকে লোকারণ্য। গত কয়েকদিন ভিড় থাকলেও এদিন আর কাউকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। হঠাৎ হঠাৎ কেশে উঠছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিকেল থেকে হিক্কাও উঠেছিল সমানে। রবীন্দ্রনাথের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। এদিন রাত ১২টার দিকে রবীন্দ্রনাথের অবস্থার ভীষণ অবনতি হলো। সেদিন ছিল শ্রাবণের পূর্ণিমা।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত

দিনটি ৭ আগস্ট ১৯৪১ ২২শে শ্রাবণ। ভোর চারটা থেকেই মোটরগাড়ির আনাগোনা জোড়াসাঁকোর সরু গলিতে। নিকট আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন সবাই দেখতে আসছেন রবীন্দ্রনাথকে। ক্রমেই ভোরের আকাশ ফর্সা হলো। রামানান্দ চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে উপাসনা করলেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে সংস্কৃত মন্ত্র পড়লেন, 'ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি/ নমস্তেহস্তু মা মা হিংসীঃ…।' 

বাইরের বারান্দায় কেউ গুণগুনিয়ে গেয়ে উঠলেন, 'কে যায় অমৃতধামযাত্রী'। বেলা নয়টার দিকে অক্সিজেন দেওয়া হলো রবীন্দ্রনাথকে। ক্ষীণ শব্দে নিঃশ্বাস পড়ছে। সেই ক্ষীণ শ্বাস ক্ষীণতর হয়ে নেল। পায়ের উষ্ণতা কমে এলো। বেলা দ্বিপ্রহর। সময়টা বেলা ১২টা ১০ মিনিট। জীবনের গোধূলি বেলায় অন্তিম নিঃশ্বাস ফেললেন রবীন্দ্রনাথ। বাইরে তখন বাঁধভাঙা কোলাহল। সারা কলকাতা শহর যেন ভেঙে পড়েছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সামনে।

যেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রা

সাদা বেনারসি জোড় পরানো হলো রবীন্দ্রনাথকে। পরনে কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবী, পাট কড়া চাদর গলার নিচ থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো। কপালে চন্দন, গলায় গোড়ে মালা। দুপাশে রাশিরাশি শ্বেতকমল রজনীগন্ধা। যেন রাজা ঘুমাচ্ছেন রাজশয্যার উপরে। ব্রহ্মসংগীত হতে লাগলো শান্তকণ্ঠে। ভিতরের উঠোনে নন্দলাল বসু নকশা এঁকে মিস্ত্রিদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রার পালঙ্ক তৈরি করলেন। দুপুর ৩টার দিকে জোড়াসাঁকো থেকে লাখো জনতার মিছিল তাকে নিয়ে গেল নিমতলা মহাশ্মশানের উদ্দেশে। সেখানেই যে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে রবীন্দ্রনাথের। পথে লাখো জনতার পুস্প বৃষ্টিতে ভিজে গেলেন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠতম প্রতিভা।

তথ্য সূত্র - গুরু দেব/ রাণী চন্দ স্মৃতিচিত্র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য/ প্রতিমা দেবী  

রবি জীবনী/ প্রশান্তকুমার পাল

Comments

The Daily Star  | English
crimes against journalists

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

16h ago