‘অঘ্রানের ভরা ক্ষেতে’ রবীন্দ্রনাথের দেখা ধান

এখনো বাংলাদেশের পাহাড় থেকে সমতল অঞ্চলে প্রায় তিন হাজারের বেশি জাতের ধানের আবাদ হয়। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

একশ বছরেরও বেশি সময় আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ব বাংলার মাটিতে ঠিক কোন কোন জাতের ধান দেখেছিলেন তা আন্দাজ করাটা কঠিন। কারণ গত শতাব্দীর শুরুর দিকেও এ অঞ্চলে ১৮ হাজারের বেশি স্থানীয় জাতের ধান ছিল। ফুল-পাখি-নদীসহ বিচিত্র সব নামে নামকরণ করা ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের এসব ধানে সমৃদ্ধ ছিল বাংলার উর্বর পললভূমি।

রবিঠাকুরের সঙ্গে পূর্ব বাংলার যোগাযোগের খতিয়ান পাওয়া যায় ১৮৮৮ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত। এর ভেতর বিভিন্ন সময়ে ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কুমিল্লা ও চাঁদপুরের মাটিতে তার পা পড়েছে। এ ছাড়া জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহ, পতিসর ও শাহজাদপুরে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন অন্তত ১০ বছর।

এ সময়কালে পূর্ব বাংলার প্রকৃতির রূপে প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, বস্তুত এই সময়ের মধ্যে তার মনভূমিও ভবিষ্যৎ সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের জন্য প্রস্তুত হয়। প্রমত্ত পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য, গ্রাম বাংলার প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর রূপ, এখানকার প্রান্তিক মানুষের জীবন তাকে সুন্দর ও সত্যের কাছে যাওয়ার জন্য উজ্জীবিত করে তোলে।

ছবি: শেখ নাসির/স্টার

সেই সময়ে ধানই ছিল এ অঞ্চলে সমৃদ্ধির শেষ কথা। শস্যকেন্দ্রিক নানা রীতিনীতি প্রচলিত ছিল বাঙালি সমাজে। তার পরম্পরায় এবারও কার্তিকের শেষে অগ্রহায়ণ আসতে না আসতেই বাংলায় শুরু হয়েছে আমন ধান কাটার মৌসুম। কুয়াশাভেজা মাঠ থেকে পাকা ধান কেটে আনার তোড়জোড় চলছে গ্রামে গ্রামে। গৃহস্থ বাড়ির উঠানে এই ধান মাড়াই-মলন শেষে নতুন চালের ভাত আর পিঠা-পুলি-পায়েসে চলছে নবান্নের আয়োজন। এর ভেতর দিয়েই শুরু হয়েছে গ্রামবাংলার উৎসবের বর্ষপঞ্জি।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে মাঠে মাঠে পেকে ওঠা সোনালি ধানের অপূর্ব শোভা যে চিত্রময়তা বাঙালির মানসপটে এঁকে দেয়, তার অনেকটা ধরা পড়ে স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ রচিত আমাদের জাতীয় সংগীতেই।

বাঙালির চিরন্তন ভালোবাসার এই গানটিতে একদিকে যেমন মা-মাতৃভূমির বন্দনা গীত হয়েছে, তেমনি উঠে এসেছে এখানকার মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির অনুপুঙ্খ চিত্র। গীতবিতানের স্বদেশ পর্বে অন্তর্ভুক্ত 'আমার সোনার বাংলা' গানটিতে রবীন্দ্রনাথ 'অঘ্রানের ভরা ক্ষেতকে' তুলনা করেছিলেন মধুর হাসির সঙ্গে।

আবার 'ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা' দেখে বিমোহিত হওয়ার বর্ণনাও পাওয়া যায় তার আরেকটি গানে।

১৮৯১ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত পূর্ববাংলায় স্থায়ীভাবে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ দুহাতে লিখেছেন। অসংখ্য ছোট গল্প, সোনার তরী ও চিত্রা কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাও এখানে লেখা। সোনার তরীতেই তিনি তার সৃষ্টির 'সোনার ধান' তরী বেয়ে চলে যেতে থাকা মাঝিকে নৌকায় উঠিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

ছবি: শেখ নাসির/স্টার

এদিকে ধানের প্রতি রবিঠাকুরের আলাদা অনুরাগ ধরা পড়ে 'পনেরো-আনা' শীর্ষক 'বিচিত্র' প্রবন্ধেও। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, 'সকল ঘাস ধান হয় না। পৃথিবীতে ঘাসই প্রায় সমস্ত, ধান অল্পই।'

এ প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'বোধ করি ঘাসজাতির মধ্যে কুশতৃণ গায়ের জোরে ধান্য হইবার চেষ্টা করিয়াছিল—বোধ করি সামান্য ঘাস হইয়া না থাকিবার জন্য, পরের প্রতি একান্ত মনোনিবেশ করিয়া জীবনকে সার্থক করিবার জন্য তাহার মধ্যে অনেক উত্তেজনা জন্মিয়াছিল—তবু সে ধান্য হইল না।'

রবীন্দ্রনাথের পত্র-সংকলন ছিন্নপত্রে জায়গা পাওয়া অধিকাংশ পত্র রচনার জায়গাও শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসর। পত্রগুলোর রচনাকাল সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৮৯৫।

পতিসর থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে পাঠানো একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে বলতে শোনা যায়, 'বোলপুরে একটা ধানভানা কল চলছে—সেই রকম একটা কল এখানে (পাতিসরে) আনতে পারলে বিশেষ কাজে লাগবে।…এখানকার চাষীদের কোন্ ইন্ডাস্ট্রি শেখানো যেতে পারে সেই কথা ভাবছিলুম। এখানে ধান ছাড়া আর কিছু জন্মায় না।'

ছবি: শেখ নাসির/স্টার

সেই সময়ের ধান

ধানকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ দানা শস্য। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে এক লাখ ৪০ হাজার বিভিন্ন জাতের ধানের কথা জানা যায়। ভারতের পরিবেশবিজ্ঞানী ও ধান সংরক্ষক দেবল দেব জানাচ্ছেন, ষাটের দশকের শেষের দিকে সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার আগে ভারতে ৪২ হাজারেরও বেশি স্থানীয় জাতের ধানের চাষ হতো।

দেবল দেব তার 'লুঠ হয়ে যায় স্বদেশভূমি' গ্রন্থে বলছেন, 'আদি কৃষককূল যে ধানের নানান জাত বাছাই করেছিল, সেটা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিভিন্নতার উপযোগী করে ফসল উৎপাদনের কারণেই নয়। রসনার মজা ও নান্দনিক তৃপ্তিও কারণ। সুন্দর, সরু চালের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল সীতাশাল, রূপশাল, বাঁশকাঠি ধান। সুস্বাদু অন্নের জন্য কয়া, বকুলফুল, মধুমালতী, ঝিঙেশাল। অপরূপ খৈ এর জন্য কনকচূড়, বিন্নি, ভাসামানিক, লক্ষীচূড়া। চমৎকার মুড়ির জন্য রঘুশাল, লাল ঝুলুর, চন্দ্রকান্ত, মুর্গিবালাম। … এবং তালিকাটি এখানেই শেষ নয়।'

এদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্য বলছে, গত শতাব্দীর শুরুর দিকেও এ অঞ্চলে ১৮ হাজার স্থানীয় জাতের ধান ছিল। গত শতাব্দীর আশি দশকের শুরুতেও (ব্রি) সারাদেশে আবাদকৃত প্রায় ১২ হাজার ৫০০ জাতের নাম সংগ্রহ করেছিল। আর এখনো ব্রি'র জিন ব্যাংকে আট হাজারের বেশি স্থানীয় জাতের ধানের জার্মোপ্লাজম সংরক্ষিত আছে। অর্থাৎ এক শতাব্দীর ভেতর ১০ হাজারের বেশি স্থানীয় জাতের ধান পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।

ছবি: শেখ নাসির/স্টার

পাখির নামে, ফুলের নামে নাম

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া তার 'ফসলের জীববৈচিত্র্য ও জিন সম্পদ' গ্রন্থে ধানের নামকরণের বিষয়ে বলছেন, 'কত ভাবেইনা এক একটি জাতকে অন্য জাত থেকে নানা রকম নামের মাধ্যমে আলাদাভাবে চেনাবার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনও অতি প্রিয় জাতটিকে অতি আদরের নাম দিয়ে অন্য জাত থেকে আলাদা করা হয়েছে।...নানা বর্ণের ধানকে বোঝাবার জন্য নানা রকম উপমা উৎপেক্ষার মাধ্যমে নামকরণ করা হয়েছে। ফুলের নাম, ফলের নাম, নানা রকম ফসলের নাম কিংবা অন্য ফসলের জাতের নামের সাথে মিল রেখে রাখা হয়েছে কত ধানের জাতের নাম। ঋতুর নাম, বস্তুর নাম, মাছের নামেও রাখা হয়েছে কোন কোন ধান জাত। সবজির নাম আর পাখির নামও বাদ যায়নি। পশুর নাম জুড়ে দিয়ে রাখা হয়েছে কত জাতের নাম। বাদ যায়নি নদীর নামও।'

এসব নামের অর্থ ও নান্দনিকতার বিষয়ে তার বক্তব্য হলো, 'কোন কোন দেশী ধানের জাতের নাম এত চমৎকার যে বার বার এদের নাম উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করে। কোন কোন নাম এত সুন্দর আর অর্থবহ যে আমাদের পূর্ব পুরুষদের নান্দনিকতাবোধ আমাদের অবাক করে।'

'ফসলের জীববৈচিত্র্য ও জিন সম্পদ' গ্রন্থে পাওয়া স্থানীয় জাতের এমন কিছু ধানের নাম—

বর্ণের নামে: কালা সোনা, কালো কুমারী, কালা ষাইট্টা, ধলা ষাইট্টা, সাদা কলম, সিঁদুর কোটা, কৃষ্ণজিরা।

ফুলের নামে: নয়নতারা, বাঁশ ফুল, সূর্যমূখী, কামিনী, মরিচ ফুল, কদম ফুল।

ফলের নামে: লিচু, জামরুল, ডুমুর, বাদাম, মরিচ পাল, নারিকেল বেদি, খেঁজুর ঝোপা।

ফসলের নামে: হাসি কুমড়া, মরিচা ডুলি, কাঁচা হলুদ, এলাচী, বাদাম, তিল বাযাল, খৈয়া মটর।

গাছের নামে: বট, পাথর কুচি, বাঁশ পাতা, কেওড়া।

মাছের নামে: কৈঝুরি, রুই, কইয়াবোরো।

পশুর নামে: গয়াল, বকরি, মহিষ পাল, হরিণ কাজলি, শিয়াল লেজী।

পাখির নামে: ঘুঘু শাইল, চড়–ই, ময়না, মাছরাঙ্গা, বকফুল।

স্থানের নামে: বটেশ্বর, ময়নামতি, ভাউয়াল, হাতিয়া, ফরাসডাঙা, লক্ষীপুরা।

মানুষের নামে: ফুলমতি, মইরম, মানিক মোড়ল, কাঞ্চন বিবি, কামাই মল্লিক।

নদীর নামে: গঙ্গাসাগর, মধুমতি।

মাসের নামে: আশ্বিনা, কার্তিক দুল, বৈশাখী, চৈতা।

আরও আছে ঠাকুর ভোগ, দয়াল ভোগ, বাদশাহ ভোগ, সুলতান ভোগ, গোপাল ভোগ, রসুল ভোগ, রাধুনি পাগল, বৌ সোহাগী, জামাই নাড়ু, বৌ পাগলা, জলকুমারী, আয়নামহল, লক্ষ্মীলতা, দুধসাগর, চন্দ্রহার, বৌ পালানী'র মতো শত শত নাম।

ছবি: শেখ নাসির/স্টার

এখনকার জনপ্রিয় জাত

ব্রি'র মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর জানাচ্ছেন, এখনো বাংলাদেশের পাহাড় থেকে সমতল অঞ্চলে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুম মিলিয়ে প্রায় তিন হাজারের বেশি জাতের ধানের আবাদ হয়। তবে অধিক উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে চাষ করা হয় মাত্র কয়েকটি জাতের ধান।

এগুলোর মধ্যে আছে রোপা আমন হিসেবে পরিচিত উচ্চ ফলনশীল ব্রি ধান ৮৭, ব্রি ৭১, ব্রি ৭৫ ও ব্রি ৭৬। এ ছাড়া বোরো মৌসুমে এক সময় জনপ্রিয় ছিল ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯। এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ব্রি ৯৬।

আর আউশ জাতের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি আবাদ হচ্ছে ব্রি ৪৮ জাতের ধান, যার চাল মাঝারি মোটা আর ভাত ঝরঝরে।

এর বাইরেও আছে জিঙ্ক ও প্রোটিন সমৃদ্ধ বেশ কিছু জাতের ধান। সবমিলিয়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্রি এখন পর্যন্ত ১১৩টি উচ্চ ফলনশীল আধুনিক জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে।

বেসরকারি সংস্থা রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চার প্রসারের মাধ্যমে নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণনের কাজে কৃষকদের উজ্জীবিত করে যাচ্ছে। সংস্থাটির গবেষক মো. ইফতেখার আলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় জাতের ধান সংরক্ষণে কৃষকদের উৎসাহিত করতে তারা এই মুহূর্তে নীলফামারী, বগুড়া ও সাতক্ষীরার কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন। পাশাপাশি আরেকটি সংস্থা উবিনীগ কাজ করছে টাঙ্গাইল ও পাবনায়, বারসিক রাজশাহী ও নেত্রকোণায় এবং লোকজ কাজ করছে খুলনায়।

ইফতেখার বলেন, 'সংস্থাগুলো নিজেদের ভেতর আলোচনা করে দেশটাকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে কাজ করছে ধানের স্থানীয় জাতগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য। অন্তত এগুলো যাতে কৃষকের মাঠে থাকে। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগেও স্থানীয় জাতের ধান সংরক্ষণ করছেন, অন্যদের বীজ দিচ্ছেন এগুলো প্রসারের জন্য।'

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk30 lakh: Prof Yunus

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus today said each martyr's family will get Tk 30 lakh from the government, reiterating that his government will rehabilitate families of all mass-uprising martyrs and bear the full expanses of the treatment of all the injured..In a televised address to the n

6m ago