স্মরণ

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইয়েটসের বন্ধুত্বের অবনতি যেভাবে

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্কটিশ কবি ইয়েটসের দেখা হয়েছিল উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের বাসায়। সময়টা ১৯১২ সালের ২৭ জুন, ইয়েটসের বয়স তখন ৪৭ আর রবীন্দ্রনাথের ৫১। প্রথম থেকে দুজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠলেন, তাদের সেই বন্ধুত্ব টিকেছিল ৩৭ বছর। যদিও এর মাঝে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। 

ইয়েটসকে দেখেই কবির অনুভূতি ছিল—ভিড়ের মাঝখানেও তিনি চাপা পড়েন না, তাকে বিশেষ কেউ বলে চেনা যায়। যেমন তিনি তার দীর্ঘ শরীর নিয়ে মাথায় প্রায় সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন, তেমনি তাকে দেখলে মনে হয় যেন তার সকল বিষয়ে জ্ঞান আছে। তিনি যেন ফোয়ারার মতো চারিদিকের সমতলতা থেকে বিপুলভাবে উচ্ছ্বসিত করে তুলছেন।

জাহাজে বসে কবির ইংরেজিতে অনুবাদকৃত গীতাঞ্জলির খাতাটি বন্ধু রোদেনস্টাইনের হাত ঘুরে ইয়েটসের হাতে আসল। তিনি অনুবাদগুলো পাঠ করে অভিভূত হলেন। ৭ জুলাই অন্য একটি আমন্ত্রণে যোগ না দিয়ে ইয়েটস রোটেনস্টেইনের বাড়িতে আয়োজিত 'ঠাকুর সন্ধ্যায়' যোগ দিলেন। ইয়েটস তার কণ্ঠে ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করলেন যা শুনে সেখানে (লন্ডন) আমন্ত্রিত সুধীজন অভিভূত হলেন।

সেই পাঠের পর ইয়েটস আর রবীন্দ্রনাথ উবার্ণ বিল্ডিং-এ একত্রিত হয়ে গীতাঞ্জলির ইংরেজি কিছুটা ঘষামাজা করলেন। একদিন কবি এজরা পাউন্ড সেখানে উপস্থিত হলে ইয়েটস মন্তব্য করলেন, "ঠাকুর আমাদের সবার চেয়ে উত্তম" যা পাউন্ড তার পরবর্তী লেখায় উল্লেখ করেছেন। 

১২ জুলাই সন্ধ্যায় 'দ্য নেশন' পত্রিকা লন্ডনের ট্রাকেডেরো রেস্তোরাঁয় ঠাকুরের জন্য একটা নৈশভোজের আয়োজন করল। ইয়েটস ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের হোস্ট। সেখানেও তখনকার অনেক সাহিত্যিক শিল্প ও বুদ্ধিজীবী নেতারা সমবেত হন। এই নৈশভোজে ইয়েটস সর্বজনীনভাবে ঠাকুর এবং তার কবিতার প্রতি তার দুর্দান্ত প্রশংসা প্রকাশ করলেন। সম্মানিত অতিথিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করলেন, "শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াটা আমার জীবনের একটি বড় ঘটনা। আমি আমার সময়ে এমন কোনো লোককে জানি না যিনি ইংরেজি ভাষায় তাঁর সমান কিছু করেছেন।"

১৯১২ সালের নভেম্বরে ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে গীতাঞ্জলি প্রকাশ হলো, ইয়েটস তাতে দীর্ঘ ভূমিকায় লিখেন,
....এই অনুবাদগুলির পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি দিনের পর দিন, রেল গাড়িতে বসে পড়েছি, বাসে বসে পড়েছি, খাবার দোকানে বসে পড়েছি – পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝেই খাতা বন্ধ করে ফেলতে হয়েছে, যদি কোন অচেনা লোক দেখে ফেলে আমি কাঁদছি। এই সব গীতিকবিতা – আমার ভারতীয় বন্ধুদের কাছে শুনেছি, মূল রচনার ভাষা ও ছন্দের অনিন্দ্য সব সূক্ষ্ম সুষমায় ভরা, তার রঙের সুকুমারত্ব, তার ছন্দের অভিনব অনুরণন-- সেই অনুবাদ যা সকল চেষ্টার অতীত – এদের চিন্তার মধ্যে দিয়ে এমন একটি পৃথিবীকে প্রকাশ করা যার কথা আমি সারাজীবন ধরে স্বপ্নের মধ্যে ভেবেছি। একটি সুপ্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির চরম প্রকাশ এই কাব্য, কিন্তু এমন স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত হযয়েছে যেমন সহজে মাটিতে জন্মান ঘাস, জলে নলখাগড়া, একটি ঐতিহ্য যেইখানে কবিতা আর ধর্মবোধ সমার্থক, শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে এসেছে, শিক্ষিত ও নিরক্ষর উভয়ের কাছ থেকেই গ্রহণ করেছে উপমা ও আবেগ, তারপর মহান চিন্তার প্রকাশকে বহন করে জনসাধারণের কাছে ফিরে গিয়েছে ।...

কিন্তু পরবর্তীকালে নানা কারণে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইয়েটসের উৎসাহ ম্লান হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কবি হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়া পড়ল বিশ্বময়। কিন্তু এই সময়ে ইয়েটস রবীন্দ্রনাথকে একটা চিঠি লিখেও অভিনন্দন জানান নাই। হয়তো রবীন্দ্রনাথের এই অপ্রত্যাশিত নোবেল পুরস্কার লাভে ইয়েটস-এর কিছুটা ঈর্ষার সঞ্চার হয়েছিল কিংবা হয়তো এই কৃতিত্বের কিছুটা ভাগীদার হওয়ার ইচ্ছা তারও হয়েছিল —ইয়েটস পরে রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে অনুযোগ জানালেও তাঁহার গদ্য রচনার অনুবাদ সম্পর্কে উৎসাহ হারান নি; বিশেষত, তাঁর  'জীবনস্মৃতি'-র অনুবাদ বিষয়ে খুবই আশাবাদী ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের করা জীবনস্মৃতি অনুবাদ 'My Reminiscences' লন্ডনের ম্যাকমিলান প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হলে, ২৪ এপ্রিল ১৯১৮ তারিখে তিনি রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন,  ... অনেক দিন আপনাকে চিঠি লিখা হয় নাই, কিন্তু আপনার কথা যে মনে পড়ে না তা নয়। আপনার জীবনস্মৃতি' পড়তে খুব ভাল লাগল। পরের অংশটাও লিখুন না, আমাদের জন্য? ...

এর পর ১৯৩১-এ রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে 'The Golden Book of Tagore'-এ ইয়েটস লিখেন, ... আমি আপনাকে বলতে চাই, আমি এখনো আপনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছাত্র ও গুণগ্রাহী।... আপনি তো জানেন, আপনার কবিতা আমার কাছে এসে ছিল এক বিরাট উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা হিসেবে; সম্প্রতিকালের বছরগুলিতে আমি আপনার গদ্যে প্রজ্ঞা ও সৌন্দর্যের পরিচয় পেয়েছি -- 'ঘরে বাইরে'-তে, আপনার ছোটগল্প গুলিতে ও আপনার জীবনস্মৃতিতেও।... 

আমাদের দেখা হওয়ার পর আমি বিয়ে করিয়াছি। আমার এখন দুটি সন্তান একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে রয়েছে এবং আমি জীবনে আরও বেশি বোনা অনুভব করি; এবং জীবনকে যখন আমি মনে করি যে এটি সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন যা নিজের নয়, এবং যা জটিল এবং যান্ত্রিক সবকিছু থেকে। আমার মনে একটি প্রাচ্যদেশীয় রূপ-- যা আমি প্রথমে আপনার বই এবং পরে কিছু চীনা কবিতা এবং জাপানি গদ্য লেখকদের কাছ থেকে পেয়েছি। আপনার কবিতার প্রথম পাঠটি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ -- যা মাঠ এবং নদী থেকে বের হয়ে এসেছিল বলে মনে হয়েছিল।

১৯৩৯ সালে ইয়েটস-এর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন, ... মৃত্যুতে লুপ্ত হওয়া ইয়েটস-এর জন্য নয় জীবিতকালেই তিনি সাহিত্যের ধ্রুপদী উচ্চতায় আরোহণ করেছেন। আজ আমার মনে পড়ছে সেই সময়ের কথা যখন আমি প্রথম তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম – জীবনের, তারুণ্যের অজস্রতায় পরিপূর্ণ, তার দীপ্যমান প্রতিভার এই ছবি মানুষের চিরকালের স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। শেষ পর্যন্ত এই গর্ব আমার থাকবে যে আমার জীবনের সঙ্গে আধুনিক ইউরোপের এক বিরলতম কবির স্মৃতি গাঁথা হয়ে রইল।...
ইয়েটস রবীন্দ্রনাথে ১০ বছর পর ১৯২৩ সালে নোবেল পুরস্কার পায়েছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ তার ইংরেজিতে অনূদিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'The Gardener' ইয়েটসকে উৎসর্গ করেছিলেন।

তথ্যসহায়ক
1. William Rothenstein, Men and Memories: 1900-1922
2. Gitanjali (London, 1913), Introduction, p xiii
3. The Letters of W. B. Yeats (London, 1954), p. 569
4. On the Edges of Time (Bombay, 1958), RathindranathTagore, pp. 116-11
5. The Golden Book of Tagore: Homage to Rabindranath Tagore from India
and the World in Celebration of his Seventieth Birthday, ed. Ramananda Chatterjee (Calcutta, 1931), p. 291.
6. The letters of Ezra Pound 1907-1941 Edited by DD Paige
7. The Hindustan Standard 31 January 1939

 

Comments

The Daily Star  | English

Indian Media Reporting on Bangladesh: Fake or Fact?"

Why is the Indian media's coverage of Bangladesh markedly different from that of Bangladeshi news outlets?

6h ago