চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে এসেছেন অজস্রবার। পূর্ববঙ্গের অবারিত সৌন্দর্যে বারবার মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, পূর্ববঙ্গে না এলে এখানকার প্রকৃতির মোহনীয় রূপ দেখা থেকে বঞ্চিত হতেন।

রবীন্দ্রনাথ প্রথম পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন ১৮৮৮ সালে। ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ববঙ্গের জমিদারির দায়িত্ব নেন। ১৮৮৮ সাল থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে  অজস্রবার পূর্ববঙ্গে এসেছেন তিনি। থেকেছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। নিজের জমিদারি অঞ্চল পাবনার (বর্তমানের সিরাজগঞ্জ জেলা) শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ছিল ঠাকুরবাড়ির জমিদারির অঞ্চল। তিনি সবশেষ পূর্ববঙ্গে আসেন ১৯৩৭ সালে পুণ্যাহ উৎসব উপলক্ষে। তখন তিনি জমিদার নন, অতিথি।

পূর্ববঙ্গের বহু অঞ্চলেই রবীন্দ্রনাথ ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে ১৯০৭ সালের সফর ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওই বছরের জুন মাসে বরিশালের ব্রাহ্ম সমাজের নেতা বামুন দাশ গাঙ্গুলীর পুত্র নগেন্দ্র গাঙ্গুলীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ কন্যা মীরা দেবীর বিয়ে হয়। বিয়ের পর কন্যা ও জামাতাসহ বরিশালে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বরিশালে তিনি ১ সপ্তাহ ছিলেন। এ সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে বরিশালে সাহিত্য পরিষদ শাখা খোলার আলোচনা করেছিলেন।

সেই সফরেই রবীন্দ্রনাথ চট্টগ্রাম সফর করেছিলেন। তার চট্টগ্রাম সফরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল চট্টগ্রামের স্বদেশী আন্দোলন। এ ছাড়া বড় ভূমিকা রেখেছিলেন নাট্য নির্দেশক কেদারনাথ দাশগুপ্ত।

বলে রাখা ভালো, ওই সময় 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' নামের একটি স্বদেশী পণ্য সামগ্রী বিক্রির দোকানের মালিক ছিলেন কেদারনাথ দাশগুপ্ত। এ ছাড়া তিনি 'ভাণ্ডার' নামের একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। পরে বিশেষ অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ পত্রিকাটির সম্পাদক হয়েছিলেন। কেদারনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয়। রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠকন্যা মীরার বিয়ের প্রধান সহায়কও ছিলেন কেদারনাথ।

রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম সফরের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী যামিনীকান্ত সেনও। ১৯০৬ সালে যামিনীকান্ত সেন শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেসময় তিনি রবীন্দ্রনাথকে চট্টগ্রাম সফরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেও সে দফা তা সম্ভব হয়নি। এর কিছুদিন পরই যামিনীকান্ত সেনের বাবা কমলাকান্ত সেন মারা যান। তার মৃত্যুতে ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চট্টগ্রাম সফরে না যেতে পারায়  যামিনীকান্ত সেনের কাছে দুঃখ প্রকাশও করেছিলেন।

চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল। এটিও রবীন্দ্রনাথকে চট্টগ্রাম সফরে যেতে ব্যাপক উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাদের মধ্যে মহাকবি নবীনচন্দ্র সেন ছিলেন উল্লেখযোগ্য। মহাকবি নবীনচন্দ্র সেনের সঙ্গে ১৮৭৭ সালের হিন্দুমেলা থেকেই পরিচয় ছিল রবীন্দ্রনাথের। অন্যদিকে নবীনচন্দ্র সেন প্রেসিডেন্সি কলেজে রবীন্দ্রনাথের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহপাঠী ছিলেন।

তারও ১৫ বছর পরে নবীনচন্দ্র সেন অনূদিত কালীদাসের 'রঘু বংশের' প্রথম খণ্ডের বাংলা অনুবাদ পড়ে নবীনচন্দ্র সেনের কাছে এক দীর্ঘ প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৯৫ সালে দ্বিতীয় খণ্ড পড়ে সাধনা পত্রিকায় একটি সমালোচনাও লিখেছিলেন। নবীনচন্দ্র সেন ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যাদের সুসম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে ছিলেন কবি নবীনচন্দ্র দাস, কবি ও শিক্ষাবিদ শশাঙ্ক মোহন সেন, বৌদ্ধ ধর্মগুরু পন্ডিত ধর্মরাজ বড়ুয়া, বিখ্যাত আইনজীবী রজনীরঞ্জন সেন ও কবি জীবেন্দ্র কুমার দত্ত।

স্বদেশী আন্দোলনে চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের পরিচয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চট্টগ্রাম থেকে পরিচালিত দ্য হিন্দুস্তান কো-অপারেটিভ ইনস্যুরেন্স সোসাইটির সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ তাদের কর্মতৎপরতা,অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মানবতাবাদী সেবায় ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ইংরেজ জাহাজ কোম্পানি এম ডেভিডকে টেক্কা দিয়ে ২টি স্বদেশী জাহাজের মালামাল পরিবহনের বিষয়টি রবীন্দ্রনাথকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল। এ সবকিছুই তাকে চট্টগ্রাম সফরে আগ্রহী করে তুলেছিল।

বটতলী রেলওয়ে স্টেশন। ট্রেনে চেপে চট্টগ্রামের এই স্টেশনেই নেমেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথের আগে ঠাকুর পরিবারের কোনো সদস্যই চট্টগ্রামে আসেননি। চট্টগ্রামে তখন পর্যন্ত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কোন শাখা ছিল না। শাখা স্থাপনও ছিল রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম সফরের অন্যতম কারণ।

চট্টগ্রাম সফরের আগে রবীন্দ্রনাথ বরিশালেবঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। বরিশাল সফরে থাকা অবস্থাতেই  চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা যামিনীকান্ত সেনসহ চট্টগ্রামের শুভানুধ্যায়ীদের জানান তিনি। তার চট্টগ্রাম আগমন উপলক্ষে গঠিত হয় অভ্যর্থনা কমিটি। কমিটির প্রধান ছিলেন যামিনীকান্ত সেন। অভ্যর্থনা কমিটির পক্ষ থেকে কাজেম আলী মাস্টার ও  ত্রিপুরাচরণ চৌধুরীর উদ্যোগে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রঙিন করে তোলা হয়।

১৯০৭ সালের ১৭ জুন। দিনটি ছিল সোমবার। আগের রাত থেকেই বৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথকে বরণ করে নিতে সেই বৃষ্টির মধ্যেই ভোরবেলা কবি সাহিত্যিক, বিশিষ্ট ব্যক্তি, ভক্ত-অনুরাগীসহ হাজারও জনতার ঢল নেমেছিল চট্টগ্রামের বটতলী স্টেশনে। স্টেশনে ছিল পুষ্পবেষ্টিত টমটম বা ঘোড়ার গাড়ি।

ভোর ৬টার দিকে ট্রেনে চেপে রবীন্দ্রনাথ চট্টগ্রামে পৌঁছান। তার সফরসঙ্গী ছিলেন ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বন্ধু কেদারনাথ দাশগুপ্ত।

স্টেশন থেকে টমটমে করে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের উত্তর দিকে থাকা যামিনীকান্ত সেনের পৈত্রিক বাড়িতে। সেখানে কবিকে এক নজর দেখতে প্রাঙ্গণে এসে ভিড় করেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকসহ কবির শত শত ভক্ত অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করেন। এদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যাপক রজনীরঞ্জন সেনের পার্সিভিল হিলের 'দ্য প্যারেড' বাড়িতে যান রবীন্দ্রনাথ।

রজনীরঞ্জন সেনের এই বাড়িতে এদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে রবীন্দ্রনাথ চট্টগ্রামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শাখা খোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেন। কবি সাহিত্যিক, অধ্যাপকরাও তাদের মতামত পেশ করেছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, ব্রজকুমার সেন, আবদুর রহমান দোভাষ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মাহিমচন্দ্র গুহ, যাত্রা মোহন সেন, রামচন্দ্র বড়ুয়া, কাজেম আলীসহ চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

রাতে রবীন্দ্রনাথের সম্মানে চট্টগ্রামের বিচারক এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। কিন্তু একইসঙ্গে অধ্যাপক রজনীরঞ্জন সেনের বাড়িতে বৈঠক থাকায় রবীন্দ্রনাথ বৈঠককেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি নিজে না গেলেও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সেই বাড়িতে পাঠান। সফরের প্রথম দিন রাতে রবীন্দ্রনাথ রাত্রিযাপন করেন কমলাকান্ত সেনের বাড়িতে।

১৮ জুন ছিল রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম সফরের দ্বিতীয় দিন। এদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে ঘুরে দেখেন। এক পর্যায়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী জাহাজঘাটে। কর্ণফুলী নদীতে রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকজন মাঝিমাল্লার সঙ্গে কথা বলেন। কর্ণফুলীর প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হন তিনি।

এদিন সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর সদরঘাটের কমলবাবুর থিয়েটারে। সেখানে তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এদিন বিকেল থেকেই চট্টগ্রামে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল।  বৃষ্টি উপেক্ষা করে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীরা তো বটেই, স্বদেশী আন্দোলনের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে কোনো অনুষ্ঠানের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ বক্তব্য দেওয়ার নজির ছিল না। বরাবরই তিনি শুরুতে প্রবন্ধ পাঠ করতেন। কিন্তু চট্টগ্রামের সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে বক্তব্য দেন। বক্তব্যে কারও পক্ষাবলম্বন না করে সবাইকে স্বদেশের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তিনি সংস্কৃতিকর্মীদের সমাজের সাধারণ মানুষের প্রতি গুরুত্বারোপ করে একসঙ্গে ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার অনুরোধ জানান। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথকে একটি গান গাওয়ার অনুরোধ করেন ব্রজকুমার সেনগুপ্ত।

এ সময় কবির সফরসঙ্গীরা আপত্তি জানালেও তাতে কর্ণপাত করেননি রবীন্দ্রনাথ। অনুরোধ গ্রহণ করে তিনি বলেন, 'আমি কবির পিতার আবদার অগ্রাহ্য করতে পারি না।' উল্লেখ্য, ব্রজকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন কবি ও শিক্ষাবিদ শশাঙ্কমোহন সেনের বাবা।

১৮ জুন রাতের সাড়ে ৮টার ট্রেনেই রবীন্দ্রনাথ সফর শেষে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র:

রবীন্দ্রনাথ এই বাংলায়/ আহমদ রফিক

চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও অন্নদাশংকর/ নিতাই সেন

 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Panic grips NBR officials

The relief that followed the end of a disruptive strike by tax officials at the National Board of Revenue has quickly given way to anxiety and regret, as the government started a clampdown on those involved.

14h ago