কলকাতায় কোথায় কেনাকাটা করবেন

কলকাতায় শপিং
গড়িয়াহাট বাজার। ছবি: ইউএনবি থেকে নেওয়া

সামনে আসছে কোরবানির ঈদ। ঈদের আগের দিনগুলো মানেই পোশাক, উপহার এবং সুস্বাদু খাবারের কেনাকাটা। রঙিন ব্যানার ও আলোক-সজ্জার রাস্তাগুলো যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ক্রেতা-বিক্রেতার দর কষাকষিতে। এ দোকান সে দোকান ঘুরে প্রিয় জিনিসটি খুঁজে বের করার উন্মাদনা ঈদের আনন্দের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। আর এই কেনাকাটা ঐতিহ্যবাহী শহর কলকাতায় হলে সেই উৎসব মুখরতার সঙ্গে যেন যোগ হয় ভ্রমণের আনন্দ।

শত বছরের সংস্কৃতি মিশে থাকা এই শহরের কোলাহলপূর্ণ বাজারগুলো যেন রং এবং স্বাদের চির অর্বাচীন ফেরিওয়ালা। শপিং উৎসাহী বাঙালিদের প্রত্যাশিত এই গন্তব্যকে নিয়েই আজকের নিবন্ধ। চলুন কলকাতায় গিয়ে কোথায় কী কিনবেন তার বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

কলকাতা নিউ মার্কেট

ঔপনিবেশিক যুগের প্রাচীনতম বিপণিগুলোর মধ্যে অন্যতম এই শপিংমল যে কোনো উৎসবে কলকাতার ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ। জুতা, শাড়ি, বিদেশি ফুল ও স্থানীয় প্রসিদ্ধ খাবারের দোকানগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভিড়। কারণ সুনামের পাশাপাশি এদের রয়েছে বিশদ সংগ্রহ। তাছাড়া একটি নির্দিষ্ট আইটেমের সব দোকান আলাদা আলাদা ব্লকে সুবিন্যস্তভাবে সাজানো। তাই ২ হাজারেরও বেশি দোকান থাকলেও পছন্দের জিনিসটি খুঁজে পেতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না ক্রেতাদের। লিন্ডসে স্ট্রিটে অবস্থিত এই সুপরিচিত জায়গাটি নিমেষেই খুঁজে পান বাইরে থেকে আগত পর্যটকরা।

কলকাতা
কলকাতা নিউমার্কেট। ছবি: ইউএনবি থেকে নেওয়া

গড়িয়াহাট বাজার

বালিগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন বাজারটি গড়িয়াহাটের অন্যতম বিখ্যাত মল। দীর্ঘ প্রসারিত জায়গা জুড়ে বিস্তৃত রাস্তার দুপাশে দোকানগুলো জামাকাপড়, গহনা এবং ইলেকট্রনিক আইটেমের বিশাল সংগ্রহশালা। বড় দোকান ছাড়াও ছোট ছোট অস্থায়ী তাঁবুগুলোতে বসে স্বল্প দামের বিপণি। দোকানের বাইরে ঝুলে থাকা নানা আইটেমের সঙ্গে চকচকে আলোগুলো মাঝের দীর্ঘ রাস্তাকে আলোকিত করে রাখে। এখানকার রেস্তোরাঁ এবং খাবারের দোকানগুলোর অবস্থান এমন জায়গাতে যেন কেনাকাটার ফাঁকেই হুট করে যে কেউ খেতে বসে যেতে পারে।

অবনী রিভারসাইড মল

হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই ৫ তলা শপিংমলটি যেন নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেছে। এর ভেতরে ২০০টিরও বেশি ব্র্যান্ডেড স্টোর সারা দিন ধরে আটকে রাখে ক্রেতাদের। শুধু কি তাই! সুপারশপের মুদি থেকে শুরু করে প্যান্টালুনের পোশাক এবং আর্চিসের অনন্য উপহার সবকিছু পাওয়া যায় এখানে। এ ছাড়া সিনেমা উপভোগ করার জন্য আছে একটি পিভিআর থিয়েটার। কেনাকাটা করতে গিয়ে খিদে পেয়ে গেলে তার জন্যও রয়েছে জনপ্রিয় সব রেস্তোরাঁ এবং ফুড ক্যাফে।

সাউথ সিটি মল

কলকাতা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে প্রায় ১০ লাখ বর্গফুটের জায়গা নিয়ে এই মলটির অবস্থান। এই অত্যাধুনিক মলে একচেটিয়াভাবে ব্যবসা করে চলেছে দেশ-বিদেশের নামকড়া সব ব্র্যান্ডগুলো। সম্প্রতি চালু হওয়া নতুন বিশাল ফুড কোর্টে জায়গা পেয়েছে মেইনল্যান্ড চায়না, চিলিস, স্টারবাক্স সহ স্বনামধন্য অনেক খাবারের ব্র্যান্ড। সারা বিপণি ঘুরতে গিয়ে স্বাদ বদলের জন্য রয়েছে মাল্টিপ্লেক্স। এখানে শপিং উৎসাহী ও সিনেমাপ্রেমী দুই শ্রেণির মানুষেরই ভিড় হয়।

কোয়েস্ট মল

পার্ক সার্কাসের সৈয়দ আমির আলী এভিনিউয়ের এই অভিজাত মলটি তরুণ এবং ব্যবসায়ী উভয়কেই আকর্ষণ করে। ২০১৩ সালে উদ্বোধন করা এই মল শহরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মলগুলোর একটি। মানসম্পন্ন পোশাকের দোকানের পাশাপাশি খাবার, গেমিং ও মাল্টিপ্লেক্স সুবিধা খুব কম সময়েই কোয়েস্ট মলের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। এখানে আইনক্স মাল্টিপ্লেক্সে রয়েছে ছয়টি স্ক্রিন। এ ছাড়া রয়েছে চিলিস, বোম্বে ব্রাসেরি, স্মোক হাউস ডেলি, ও সেরাফিনার মতো কলকাতার সেরা সব রেস্তোরাঁ।

সিটি সেন্টার ১ শপিং মল

সল্টলেকের এই টুইন মলটিতে শহরের সব ধরনের লোকেরই সমাগম ঘটে। স্বভাবতই মলের প্রতিটি আউটলেটেই থাকে উপচে পড়া ভিড়। বিশাল এই মলের অন্যতম আকর্ষণ হলো এর কেন্দ্রে জলাশয় সমৃদ্ধ কয়েকটি ধাপযুক্ত প্লাজা, যাকে কুণ্ড বলা হয়। এই বিরাট স্থাপনাকে ঘিরে দর্শনার্থীরা বসে সময় কাটাতে পারেন। মনোরম অভ্যন্তরীণ সজ্জার অ্যাম্ফিথিয়েটারে চলে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। আর হাল ফ্যাশনের পোশাকের দোকানগুলো স্বতন্ত্র শৈলী নিয়ে আকৃষ্ট করে ক্রেতাদের।

কেনাকাটার জন্য কলকাতার প্রসিদ্ধ কিছু আইটেম

কাঁথা, বালুচরী ও তাঁতের শাড়ি

বাঙালি কারিগরদের গর্বের সূচনালগ্নটা মূলত বিশেষায়িত হয় তাদের জাদুকরী শৈলীর শাড়ি দিয়ে। আর সেই কারিগরদের স্বর্গরাজ্য এই কলকাতা, যেখানে শাড়িকে ঘিরে উন্মুক্ত হয় শত সৌন্দর্যের কারিশমা। কারিশমার নেপথ্যে রয়েছে বৈচিত্র্যময় আদিবাসী বাঙালি তাঁত, বালুচরী এবং কাঁথা। এগুলো শুধু পরিধেয় বস্ত্রের উপাদান নয়, বরং যুগ যুগ ধরে চলে আসা অনবদ্য শিল্প। তাঁতের নরম আভরণে ফুটে ওঠা নারীত্ব আর কাঁথার সেলাইয়ের পরতে পরতে কিংবদন্তির গল্প যেন বহু যুগের নৈপুণ্যগাঁথা।

সেই সঙ্গে বালুচরীর অসামান্য দোলনাগুলো হাতছানিতে কাছে টানতে থাকে শৈল্পিক ও শৌখিন হৃদয়কে। এগুলোর সবই মিলবে কলকাতার প্রধান শাড়ির দোকান নিউ মার্কেটে। এ ছাড়া সোদপুর, গড়িয়াহাট মার্কেট এবং হাতিবাগানও শাড়ির জন্য বিখ্যাত।

দার্জিলিংয়ের চা

বাঙালি মাত্রই চাপ্রেমী। আর দার্জিলিং চায়ে সেই প্রেম যেন পূর্ণতা পায়। এই চায়ের খ্যাতি জগৎ জোড়া। কলকাতার অনেক দোকানেই পাওয়া যায় এই চা। এমনকি কাঁচা থেকে শুরু করে পরিশোধিত নিম্ন গ্রেড পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের দার্জিলিং চা পাতা পাওয়া যায়। কালো কিংবা সবুজ দানা; সবই পাওয়া যায় কলকাতায়। এগুলোকে কলকাতার পথেঘাটে নিসর্গ শহর দার্জিলিংয়ের বিপণন বলা যেতে পারে। কারণ পর্যটককে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের সবুজ পাহাড়ের দিকে নিয়ে যেতে এই চায়ের শুধু এক কাপই যথেষ্ট।

মিষ্টি

খাবারের রাজধানী কলকাতা মিষ্টির লোভ মেটাতে কখনোই ব্যর্থ হয় না। এখানকার মিষ্টি রান্নায় নিবেদন করা যত্ন প্রতিটি বাঙালিয়ানা ও ভোজনরসিক মনকে ন্যায্যতা দেয়। হোক সে ভাজা বা রসে ডোবা; সেগুলোর বিভিন্ন পরিমাণকে খুব সহজেই চিত্তাকর্ষক মোড়কে ভরা যায়। এগুলোর মধ্যে সন্দেশের জাতগুলো শুকনো হলেও জিহ্বাকে শুকনো রাখবে না। আর একবার কলকাতা ঘুরে এসে রসগোল্লার গল্প করার সময় ফের নকশা করতে হবে কলকাতা ভ্রমণের।

এখানেই শেষ নয়, শহরের আনাচে-কানাচে বাহারি মিষ্টির রকমারি স্বাদ যাচাইয়ের সময় মিষ্টির নাম মনে রাখাটাই হবে দায়। তবে এর পেছনে অনুপম রন্ধন শিল্পের গুণকীর্তন অবশ্যই করতে হবে। কারণ মিষ্টির এই ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই রন্ধন শিল্পী সম্প্রদায়ের হাতেই।

কলকাতার প্রধান মিষ্টির দোকানগুলোর মধ্যে রয়েছে ভীম চন্দ্র নাগ, নবিন চন্দ্র দাস, কে.সি. দাস, গাঙ্গুরাম এবং মাখন লাল দাস।

বেত ও পাটের তৈরি জিনিস

২১ শতকের প্লাস্টিকের যুগে পাট ও বাঁশ বেশ সেকেলে ঠেকলেও কলকাতা ঘুরে দেখার সময় এগুলোকে উপেক্ষা করা যায় না। কারণ বেত ও পাটের পণ্য বুননের বিস্মৃত কালজয়ী শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছে এই কলকাতায়। অবশ্য বিগত কয়েক দশকজুড়ে কলকাতার বাজারগুলোতে পরিবেশ বান্ধব ব্যাগ শোভা পাচ্ছে। এর পেছনে মূল কারণ এগুলোর টেকসই বুনন, সস্তা দাম এবং নজরকাড়া নকশা।

এখানে এখনও কিছু সম্প্রদায় আছে যারা বংশ পরম্পরায় পাটের দড়ি এবং বেতের ব্যাগের মতো প্রচুর পণ্য তৈরি করে। এগুলোতে তাদের সৃজনশীলতা ও কায়িক শ্রম অবাক করে দেয়। পাটজাত পণ্যের মধ্যে আরও রয়েছে পাটের ঝুড়ি, জুতা, ও টেবিল ক্লথ বা ন্যাপকিন।

কলকাতার এই জনপ্রিয় শপিংমল এবং বিপণির পসরাগুলোর সঙ্গে মিশে রয়েছে বিশ্ব জোড়া সব বাঙালির স্পন্দন। কয়েক যুগের পুরোনো নিউ মার্কেট থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক কোয়েস্ট মল প্রতিটি ধারণ করে রয়েছে বাঙালির সাজ-পোশাক ও পছন্দের বিবর্তন।

Comments

The Daily Star  | English

Crowd control: Police seek to stop use of lethal weapon

The police may stop using lethal weapons and lead pellets for crowd control as their widespread use during the July mass uprising led to massive casualties and global criticism.

3h ago