প্রেম নাকি লাভ বম্বিং: পার্থক্য বুঝবেন যেভাবে

লাভ বম্বিং
ছবি: সংগৃহীত

লাভ বম্বিং হলো প্রেমের এক অপ্রতিরোধ্য প্রদর্শন, যা সঙ্গীর চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে মানসিকভাবে পরাধীন করে রাখার প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেয়। কারো আত্মসম্মান কম হলে লাভ বম্বিংয়ের মাধ্যমে সহজেই তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যায়, তার সামনে আবেগীয় সম্পর্কের একটি মিথ্যা সংযোগের ধারণা তৈরি করা যায়। সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রেমে ব্যক্তিগত সীমারেখা লঙ্ঘন করে না। সঙ্গীর আত্মমর্যাদায় আঘাত হানে না।

বসে বসে নিজের মনে মোবাইলে ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটক স্ক্রল করছিলাম। তখনই ২২ বছর বয়সী এক লাইফ কোচের দেখা পেলাম। সম্ভবত এআই দিয়ে তৈরি খুব শান্ত কণ্ঠে সে বলল 'লাভ বম্বিং' এর কথা। যখন নতুন এই শব্দবন্ধের কথা শুনলাম তখন স্ট্রেস কমাতে চিপস চাবাচ্ছিলাম আমি। লাভ বম্বিংয়ের কথা শুনে চিপস খাওয়াও মাঝপথে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। কেবল ভাবলাম, কী শুনলাম এটা? এ আবার নতুন প্রজন্মের কোন আবিষ্কার?

সাধারণত, আমরা যারা মিলেনিয়াল আছি তাদের প্রতিদিন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে শিক্ষাঋণের চাপ আর পরিবেশগত নানা প্রভাবের বিপদও। এখন তাহলে আমাদের এমন মানুষদের সঙ্গেও লড়াই করতে হবে যাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আক্রমণাত্মক!

যারা জানেন না, তাদের জন্য একটু ব্যাখ্যা করি তাহলে।

লাভ বম্বিং হলো, যখন কেউ তীব্র প্রেম নিয়ে আপনার দিকে ছুটে আসে এবং আপনাকে এমন অনুভূতি দেয় যে, আপনিই বুঝি তার পৃথিবী, তার সব। সপ্তাহে সাত দিন, ২৪ ঘণ্টাই তিনি আপনাকে মেসেজ পাঠান, দামি দামি উপহার দেন, আপনার চোখ নিয়ে শেক্সপিয়ারের সনেটের স্তবক তুলে এনে প্রশংসা করেন। এমন চমৎকার ভালোবাসার প্রকাশ দেখে আপনার ঠিক যখন মনে হয় যে, এই বুঝি পেয়ে গেলেন মনের মানুষকে, তখনই সেই মানুষটি আপনাকে ফেলে চলে যান। ঠিক যেন আগের দিন মিলিয়ে ফেলা শব্দজট, পরদিন আর যার কোনো দাম নেই।

এর আগে যখেই কেউ প্রেমের প্রথম ভাষা হিসেবে আত্ম-অবমাননাকর ভাষায় কৌতুক করত, আমার বেশ ভয় করত। এর মানে কি সেই সময় আমি লাভ বম্বিংয়ের শিকার হতাম? নাকি আমিই বুঝতে ভুল করতাম? এত প্রশ্ন, কিন্তু এত সমস্যার থেরাপি নেওয়ার বাজেটও আমার নেই।

একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। এই প্রজন্ম বিভিন্ন ধরনের আবেগের অনুপস্থিতি আর ইনস্টাগ্রাম ফিল্টারের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। এদের সঙ্গে আমাদের মিল নেই। আমাদের বাবা-মায়েরা সহজে কখনও বলতেন না যে তারা আমাদের জন্য গর্বিত। সহজে প্রশংসাও তারা করতেন না। তাই যখনই কেউ মিষ্টি হেসে দুটো কথা বলত, আমাদের মনে হতো এটাই বুঝি ভালোবাসা।

আপনারও যদি এমন মনে হয়, তাহলে এক্ষুনি সতর্ক করে দিচ্ছি। এটা আসলে ভালোবাসা নয়। এটা হলো মুদি দোকানে কোনো পণ্য কিনলে তার সঙ্গে বিনামূল্যে পাওয়া উপহারের মতো আবেগ। সত্যিটা হলো, এই ভালোবাসার মধ্যে আপনি টিকে থাকতে পারবেন না।

সাধারণত লাভ বম্বারদের একটা পরিকল্পনা থাকে। তারা আপনার জীবনে এমনভাবে প্রবেশ করবে যে হৃদয়কে নাড়িয়ে দেবে ভালোবাসার কথায়। কিন্তু একই সঙ্গে আপনার আত্মসম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। তারপর যখন তারা বুঝতে পারবে যে, আপনি প্রেমে পড়েছেন ঠিক তখনই পিঠটান দিতে শুরু করবে।

তবে পুরোপুরি চলে যাবে না। তখন দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। কারণ ততক্ষণে তো আপনি প্রেমে পড়ে গেছেন। তখন আপনি নিজেই তার পেছনে ঘুরবেন, আপনিই ভালোবাসা দেখাবেন।

কিন্তু কথা হলো, কেন আমরা এভাবে আরেকজনের পেছনে ভালোবাসার কাঙাল হয়ে ঘুরব? কেনই বা আমরা কারও হাতে দেব নিজের জীবনের নাটাই?

প্রিয় পাঠক, এর কারণটা সেই মুহূর্তে আমরা প্রেমের জন্য মরিয়া হয়ে থাকি। আমাদের আত্মসম্মান এতটাই তলানিতে চলে যায় যে মনে হয় তা পৃথিবীর একদর গভীর কোনো গর্তে গিয়ে হারিয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকের কথা। তখন বিমানবন্দরে কাউকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া ছিল দারুণ রোমান্টিক। সত্যি বলতে, সেটাও ছিল এক ধরনের লাভ বম্বিং। এখন যদি আমাকে কেউ এভাবে প্রস্তাব দেয়, নিশ্চিতভাবেই আমি পুলিশকে ফোন করব।

আত্মসম্মান কম থাকলে সাধারণত মানুষ লাভ বম্বিংয়ের ঝুঁকিতে পড়ে। কারণ আত্মবিশ্বাস কম থাকায় আমরা মনে করে যে, কেউ হয়ত সত্যিকার অর্থে আমাদের ভালোবাসবে না। আমরা মনে করি, ভালোবাসার যোগ্য হতে হলে নিজেকে অনেক নমনীয় হতে হবে। তাই যখন কেউ আতশবাজি দিতে চায়, তখন সেটাইকেই আলোর উৎস ধরে এগুতে চাই আমরা। ভুলেই যাই যে, আমাদের হাতেও আছে দেশলাইয়ের মতো আগুনের সূত্র। তাই যখনই প্রেমের সম্পর্কে রেড ফ্ল্যাগ দেখতে পাওয়া যাবে, তখনই সেখান থেকে সরে আসতে হবে। আর নিজেকে বোঝাতে হবে, এটা হতেই পারে।

ঘটনা হলো, লাভ বম্বিং কেবল আপনার বিষয়ে নয়, লাভ বম্বারের সম্পর্কে। তাদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সুযোগ, তাদের মনোভাবকে বৈধতা দেওয়াই হলো এর উদ্দেশ্য। তাদেরকে নায়ক বানানোও এর উদ্দেশ্য বলা যেতে পারে।

অন্যদিকে, লাভ বম্বার দূরে সরে যেতে চাইলে আপনিই নিজের মধ্যে খুঁত খুঁজবেন। ভাববেন, দোষটাই বোধহয় আপনার ছিল। আর এটাই লাভ বম্বিংয়ের শিকার হওয়ার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।

মনে রাখবেন, লাভ বম্বাররা আবেগ নিয়ে খেলতে ভীষণ পটু। অথচ সুস্থ সম্পর্কে এটা মোটেই উচিত নয়।

তো এখন সমাধানটা কী?

প্রথম কাজ হলো নিচের আত্মসম্মান তৈরি করা। আমি জানি কথাটা বলা যতটা সহজ করা ততটা নয়। কারণ আত্মবিশ্বাস বা আত্মসম্মান তো আর দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না কিংবা কোনো কিছু দিয়ে তৈরিও করা যায় না। এর জন্য আপনাকে কাজ করতে হবে। নিজের পেছনে সময় দেতে হবে। নিজের চারপাশে সীমারেখা টানতে হবে, প্রয়োজনীয় থেরাপি নিতে হবে আর অবশ্যই নিজেকে ভালোবাসতে হবে।

আমি জানি কথাগুলো খুব বইয়ের ভাষা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এগুলোই সত্যি। যদি আপনি নিজেকে ভালোবাসতে না পারেন তাহলে এমন লোকেরাই সুযোগ নেবে যারা আপনার ভালোবাসা নিয়ে খেলা করবে।

এখন যদি আপনার মনে হয় যে আপনি লাভ বম্বিংয়ের শিকার তাহলে জেনে রাখুন আপনি একা নন। আপনার চারপাশে বহু মানুষ পাবেন যারা লাভ বম্বিংয়ের শিকার হয়েছেন, হচ্ছেন।

এই সমস্যার চাবিকাঠি হলো যত দ্রুত আপনি লাভ বম্বিং ধরতে পারবেন তত দ্রুত এখান থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। নিজের আবেগ সামলে রাখতে পারবেন।

সবশেষে বলতে চাই, লাভ বম্বিং হলো ফ্রি সাবস্ক্রিপশনের মতো। শুরুতে খুব ভালো লাগবে কিন্তু আপনি যদি সাবধান না হন তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে।

তাই সতর্ক থাকুন, নিজের আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলুন এবং মনে রাখবেন সত্যিকারের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য এত বাড়-বাড়ন্তের প্রয়োজন নেই। এটি নীরবে আসে এবং থেকে যায়।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Beximco workers' protest turns violent in Gazipur

Demonstrators set fire to Grameen Fabrics factory, vehicles, vandalise property

1h ago