কোন বিচ্ছেদ বেশি কষ্টের, বন্ধুত্বের নাকি প্রেমের
বিভিন্ন কারণে বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিত্ব ও মতাদর্শে পার্থক্য, আপনার অপছন্দের কোনো মানুষের পক্ষে অবস্থান নেওয়া কিংবা ব্যক্তিগত কোনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। এরকম ঘটনায় শুরুতে বন্ধুত্বে ফাটল ধরে, কখনো কখনো সেটি মিটমাটও হয়। তবে মাঝে মাঝে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বন্ধুত্ব ভেঙে যায়।
প্রেমের সম্পর্কে ব্রেকআপ বা বিচ্ছেদের আগে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেও বন্ধুত্বে ভাঙনের আগে কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। স্কুলজীবন থেকে যার সঙ্গে আপনি একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, তিনি কেন হঠাৎ আপনার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে?
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আরশি (ছদ্মনাম) তার স্কুলজীবনের একটি বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ার কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। জীবনের ২৪ বছরে তিনি অনেক সম্পর্কেরই উত্থান-পতন দেখেছেন। তবে বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ সম্পর্কে তার মতামত একেবারেই ভিন্ন।
তিনি বলেন, 'যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন তাহলে আমি বলব বন্ধুত্বে ভাঙন ধরা প্রেমের সম্পর্কে ভাঙন ধরার চেয়েও বেশি কষ্টকর। বন্ধুত্ব ব্যাপারটি এত ব্যক্তিগত এবং এর বন্ধন এত শক্তিশালী যে, বন্ধুত্ব শেষ হয়ে গেলে আপনি ধীরে ধীরে নিজেকেই হারিয়ে ফেলতে শুরু করবেন। বন্ধুদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে মিল থাকে, একই বিষয়ে আগ্রহ থাকে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বন্ধুরা সবসময় বিশ্বস্ত হয়। যখন আপনার সঙ্গী আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, সেটি আপনার জন্য ভীষণ কষ্টকর হলেও এতটা আশ্চর্যজনক নয়। তবে বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা ভীষণ অপ্রত্যাশিত।'
আরশি আরও বলেন, 'বিচ্ছেদের চেয়ে কঠিন হলো এর কষ্ট কাটিয়ে ওঠা। বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মতোই ক্ষত সৃষ্টি করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনি এই ক্ষত সারিয়ে তুলতে পারবেন, কেউ না শেখালেও পারবেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনি ভালো বন্ধু বানানো থেকে শুরু করে অনেক কিছু নিজেই শিখে যাবেন। আমি এখন ভালো ও খারাপ বন্ধু যাচাই করা শিখে গেছি।'
বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ সম্পর্কে বয়োজ্যেষ্ঠদের ধারণা বেশ গভীর। ৪৫ বছর বয়সী নিমা রহমান (ছদ্মনাম) বলেন, 'যখন বয়স বেড়ে যায়, তখন সাধারণত মানুষ বন্ধুদের হারায় না। তবে এমন পরিস্থিতি হলে সেটা খুব বড় কিছুর জন্যই হয়ে থাকে। তবে এই বয়সে এসে যদি কেউ বন্ধু হারায়, তাহলে আমি বলব সে কখনো আপনার ভালো বন্ধু ছিলই না! সাধারণত বন্ধুত্ব ভাঙার মূল কারণ হলো ইগো। যদি আমরা দেখি কোনো বন্ধু আমাকে বা আমার পরিবারকে শ্রদ্ধা করছে না অথবা আমাদের কঠোর পরিশ্রম বা প্রচেষ্টাকে মূল্য দিচ্ছে না, তখনই বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ ঘটে। বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ গুরুতর একটি ব্যাপার, আচমকা খুব তাড়াতাড়ি এরকম বিচ্ছেদ ঘটে না।'
এই বয়সে বন্ধুত্বে বিচ্ছেদের দুঃখ কাটিয়ে ওঠা বেশ কঠিন মনে করেন নিমা। আরও বলেন, 'বিষয়টি খুব সহজ নয়। এরকম পরিস্থিতি মেনে নেওয়া খুব কঠিন। আপনি একজনকে অনেক দিন ধরে চেনেন, আর একদিন হঠাৎ করেই তারা দূরে চলে গেল! যদি আপনারা দুজনই যথেষ্ট পরিণত হন, তাহলে বিষয়টি সমাধান করা সম্ভব। নাহলে বন্ধুদের বিদায় বলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।'
বন্ধু বিচ্ছেদের দুঃখ কাটিয়ে ওঠার কোনো সহজ উপায় নেই। একমাত্র সমাধান হলো সময় দেওয়া। বন্ধুত্বে বিচ্ছেদের দুঃখ চিরদিনের জন্য কোনো বন্ধুর পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার মতোই কষ্টের। তবে পার্থক্য এই যে বন্ধুটি পৃথিবীতে থাকলেও আপনি তার জন্য দুঃখ পাচ্ছেন।
সময় একই সঙ্গে একটি অভিশাপ ও আশীর্বাদ। আপনি নতুন মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বুঝতে পারেন পুরোনো সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু এতটা খারাপ ছিল না। বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ আপনাকে এই শিক্ষা দেয় যে, কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সময় কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। এতে আপনি সমমনা মানুষদের খুঁজে পাবেন।
বন্ধুত্ব থেকে সরে আসা কখনো কখনো স্বস্তির হতে পারে। প্রেমের সম্পর্কের মতো বন্ধুত্বও টক্সিক হয়ে যেতে পারে। এরকম সম্পর্ক থেকে না বের হয়ে আসা পর্যন্ত আপনি বুঝতে পারবেন না সেটি আপনার জন্য কত ক্ষতিকর ছিল।
বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ ঘটতেই পারে। হয়তো কখনো কখনো এটি এড়ানো যায় না। তাই এটিকে সহজভাবে মেনে নেওয়া উচিত। একটি সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মানে নতুন সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ ঘটার কষ্টকর সময়টি আমরা নিজেদের পরিবর্তনের জন্য কাজে লাগাতে পারি।
অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম
Comments