প্রথম দেখায় প্রেম: সত্যি নাকি রূপকথা?

প্রথম দেখায় প্রেম
ছবি: সংগৃহীত

অনেকের কাছেই গল্প শোনা যায়, প্রথম দেখাতেই প্রেম তাদের কাছে ধরা দিয়েছিল অলীক স্বপ্নের মতো। এ বহু গল্প-সিনেমাতেও দেখা যায়। কিন্তু বাস্তব জীবনেও কি প্রথম দেখায় প্রেম হয়? নাকি সবই রূপকথা?

'লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট' — এই কথাটি দিয়ে সাধারণত কারো সঙ্গে প্রথমবার দেখা হওয়ার পরপর তাৎক্ষণিক ভালোলাগাকে বোঝায়। কারো কাছে তা আকাশ জোড়া আতশবাজি, তো কারো কাছে একেবারে উল্টোটা। কারো কাছে সেই একটি মুহূর্ত যেন থেমে যাওয়া অনন্তকাল। 

প্রথম প্রেমের স্মৃতিতে ডুব দিয়ে শায়রা মোবারক বললেন, 'আমার প্রেমিক আর আমার দেখা হয় দুজনেরই এক বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। আমি খুব একটা রোমান্সঘেঁষা ছিলাম না। কিন্তু সেদিন, যে মুহূর্তে ওর সঙ্গে আমার দেখা হলো আমার মনে হলো, কোনো রম-কম থেকে তুলে আনা দৃশ্য। বাটারফ্লাইস, থমকে যাওয়া সময়কিচ্ছু বাকি নেই।'

সাধারণত প্রথম দেখায় প্রেম এমন একটি তীব্র অনুভূতি, যা দুজন মানুষের মধ্যকার পোশাক-আশাক, তাদের চলাফেরা, কথা বলা, এমনকি তাকানোর ভঙ্গির উপরও নির্ভর করে।

গবেষণায় বলা হয়, হতে পারে প্রথম দেখায় প্রেমের বিষয়টির জৈবিক ভিত্তিও রয়েছে। কোনো এক শারীরবৃত্তীয় উপাদানের উপস্থিতিতে এ ধরনের গাঢ় অনুভূতির মুখোমুখি হয় মানুষ। তাৎক্ষণিক ওই আকর্ষণ থেকে ভালো লাগার হরমোন, অর্থাৎ ডোপামিন আর অক্সিটোসিন নিঃসরণও হতে পারে।

তবে ভালোবাসা অনেকটা সময় নিয়ে আস্তে আস্তে গড়ে তোলার বিষয়, এমন গতানুগতিক প্রেমের ধারণার সঙ্গে এই বিষয়টি একেবারেই খাপ না খেলেও এটি সিনেমা, উপন্যাস এবং হরহামেশাই গণমাধ্যমে চর্চিত। সবার কপালে কি আর প্রথম দেখায় প্রেম হয়? এটি আদ্যোপান্ত নিয়তির খেল ছাড়া আর কিছুই নয়।

কমিকস ও ভিডিওগেমপ্রেমী আহমেদ সারফজানালেন তার অভিজ্ঞতা, 'আমি যখন প্রথম আরিতাকে দেখি, তখনই বুঝেছিলাম– এই সেই মানুষ! এমনকি বাসায় এসে আমি আমার ভাইকেও একই কথা বলেছিলাম।'

তবে সবার মনের মধ্যে এমন রোমান্টিসিজম বাসা বাঁধে না।

পপ-রক মিউজিকপ্রেমী এবং ভ্রমণবিলাসী রহিম জাহান চৌধুরী বলে, 'আমার মতে, ভালোবাসা প্রথম সাক্ষাতের চেয়ে অনেক গভীর কিছু। সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগে। আমি মনে করি, প্রথমেই কাউকে ভালো লাগলে সেটির সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু বাহ্যিক আকর্ষণের বিষয় থাকে। আর মানুষটিকে জানার পর তার ব্যক্তিত্বটা বড় ভূমিকা রাখে। তাই মানুষ যেটাকে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলে, ওটা আসলে তীব্র আকর্ষণের ভাসা ভাসা রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।'

বহু বিশেষজ্ঞের মতে, ভালোবাসার তিনটি উপাদান– বিশ্বাস, অন্তরঙ্গতা এবং প্রতিশ্রুতি। সাধারণত এই তিনটি বিষয় খুঁজে পেতে বাহ্যিক চেহারার প্রতি আকর্ষণ থেকেও অনেক বেশি কিছুর প্রয়োজন হয়। কারণ মানুষের খারাপ দিকগুলো প্রথম দিকেই নজরে পড়ে না। বিশেষত কারো মধ্যে যদি বাজে অভ্যাস বা আচরণ থেকেও থাকে, সেটি জানতে সময় লেগে যায়। অন্য ব্যক্তি সম্পর্কে ভালোমতে জানতে ও সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রয়োজন যথেষ্ট সময় ও প্রচেষ্টা।

আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সিনেমা ও গল্প-উপন্যাসে প্রথম দেখায় প্রেম মানেই রূপকথার সেই 'অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল'। এটা বাস্তব জীবনে সত্যি নাও হতে পারে। তাই বাস্তবে কোনো সম্পর্কে যাওয়ার সময় নিজের মনের মধ্যে সম্ভাবনা থাকবে, আশাও থাকবে। কিন্তু সেই আশা সবসময় আমাদের কল্পনার মতো সত্যি হয়ে ধরা দেয় না।

নিজের জীবনের প্রেম সম্পর্কে মাহদির খান বলেন, 'আমার লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট ছিল এক সিনিয়রের সঙ্গে। সে দেখতে খুবই সুন্দর ছিল। কিন্তু পরে আমি খেয়াল করি যে সে বেশ বদমেজাজি, যা আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু আমার বর্তমান প্রেমিকার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তাৎক্ষণিক ছিল না। আমরা কথা বলেছি, একে অপরকে জেনেছি, বন্ধু হয়েছি এবং ধীরে ধীরে একে অন্যের জন্য টানটা অনুভব করেছি। আমরা একে অপরের ব্যক্তিত্ব দিয়ে প্রভাবিত হয়েছি, বাহ্যিক কোনো বৈশিষ্ট্যের জন্য নয়।'

গবেষকদের মতে, সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগে। কিন্তু পজিটিভ ইল্যুশন বা ইতিবাচক ভ্রমের কারণে অনেক মানুষ বিশ্বাস করে যে তারা পরিচয়ের একেবারে শুরু থেকেই প্রেমে ছিল।

মানব মস্তিষ্কে প্রেমের ধাপগুলো যেকোনো ধরনের আসক্তির পর্যায়গুলোর সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ। সত্যিকার ভালোবাসার ক্ষেত্রে যখন বন্ধনটা তৈরি হয় এবং শেষমেশ থেকে যায় তখন এর মধ্য থেকে আসক্তির বিষয়টি দূর হয়।

তাহলে সবকিছুর মোটমাট অর্থটা কী দাঁড়াল? আমাদের জীবনে কখনোই প্রথম দেখায় প্রেমের জাদুকরী স্পর্শ আসবে না? প্রেমের ক্ষেত্রে কি তবে খুবই ভেবেচিন্তে, সতর্কতার সঙ্গে এগোনো উচিত?

কথায় আছে, বোকারাই তাড়াহুড়ো করে। কিন্তু কিন্তু কেউ কেউ তো প্রেমে বোকা হতেও রাজি। তবে যাই হোক না কেন, সত্যিকার প্রেম আর তাৎক্ষণিক মোহের মধ্যকার পার্থক্যটা চিহ্নিত করতে পারলেই বোঝা সম্ভব যে সম্পর্কটি আদৌ টিকবে কি না। কখনো শুধু দেখে ভালো লাগল বলেই যাতে আমরা যুক্তি ও আবেগের তালগোল পাকিয়ে না ফেলি।

আবার একেবারে আশা ছেড়ে দেওয়ারও কিছু নেই। কারণ মানুষের জীবনে প্রেম এবং আবেগীয় সব সম্পর্কই অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে আসে। তাই নিরাশ না হয়ে আশায় বুক বাঁধুন, দুরন্তভাবে বাঁচুন হোপলেস নয়, 'হোপফুল রোমান্টিক' হয়ে!

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

12h ago