টমেটোর এই পুষ্টিগুণগুলো জানেন কি
টমেটো একটি জনপ্রিয় সবজি, যা সারা বিশ্বে বিভিন্ন রকম রান্না এবং সালাদে ব্যবহৃত হয়।অনেকে কাঁচা টমেটো খেতে পছন্দ করেন। টমেটো স্বাদে ও পুষ্টিগুণে অনন্য। বর্তমানে এদেশে সারাবছর টমেটো পাওয়া গেলেও শীতকালে এটির ফলন বেশী হয়। তাই টমেটো মোসুমি সবজি হিসেবে বিবেচিত হয়। আর যেকোনো মৌসুমি সবজি শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী।
চলুন জেনে নিই টমেটোর পুষ্টিগুণ। জানিয়েছেন এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ আঞ্জুমান আরা শিমুল।
তিনি বলেন, টমেটো তাজা, রসালো, মিষ্টি এবং সামান্য টক জাতীয় ফল যেটি সাধারণত সবজি হিসেবেই বেশি পরিচিত। টমেটো বিভিন্ন ধরনের খাবারে ব্যবহৃত হয়। এটি সালাদ, স্যুপ, রান্না করা খাবার, জুস, সস এবং পিউরির মতো বিভিন্ন রূপে ব্যবহার করা যায়। রান্না করা টমেটোতে লাইকোপিনের শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যা শরীরের জন্য আরও উপকারী।
টমেটোর পুষ্টি উপাদান
টমেটোতে ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান রয়েছে যা স্বাস্থ্যকর। একটি বড় টমেটো (প্রায় ১৮২ গ্রাম) থেকে পাওয়া যায় -
পানি- প্রায় ৯৫%
শক্তি - ৩২.৮ কিলোক্যালরি
প্রোটিন - ১.৬ গ্রাম
চর্বি - ০.৩৬৪ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট - ৭.০৮গ্রাম
ফাইবার - ২.১৮ গ্রাম
চিনি - ৪.৭৯ গ্রাম
গ্লুকোজ - ২.২৮ গ্রাম
ফ্রুক্টোজ - ২.৪৮ গ্রাম
ক্যালসিয়াম - ১৮.২ মিলিগ্রাম
আয়রন - ০.৪৯২ মিলিগ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম - ২০ মিলিগ্রাম
ফসফরাস - ৪৩.৭ মিলিগ্রাম
পটাসিয়াম - ৪৩১ মিলিগ্রাম
সোডিয়াম - ৯.১ মিলিগ্রাম
দস্তা - ০.৩০৯ মিলিগ্রাম
তামা - ০.১০৭ মিলিগ্রাম
ভিটামিন এ - ৪২ মাইক্রোগ্রাম
ভিটামিন কে - ৭.৯ মাইক্রোগ্রাম
টমেটোর উপকারিতা
টমেটোর স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় টমেটো অন্তর্ভুক্ত করলে রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা হ্রাস পায়। টমেটো পোস্টপ্র্যান্ডিয়াল লিপেমিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে এবং এটি করার ফলে এথেরোস্ক্লেরোসিস হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়। এ ছাড়া নিয়মিত টমেটো খেলে এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে।
অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহ হ্রাস
টমেটো লাইকোপিন, বিটা-ক্যারোটিন, লুটেইন, ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড এবং নারিনজেনিন সহ বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পূর্ণ। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি আমাদের শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের ফলে সৃষ্ট সমস্যা ঠিক করতে সাহায্য করে। দূষণ থেকে শুরু করে অতিবেগুনি রশ্মি অনেক কিছু এই অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের কারণ হতে পারে। টমেটোতে লুটেইনও রয়েছে, যা বয়স-সম্পর্কিত ম্যাকুলার অবক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে। ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে এবং টমেটোর ত্বকে থাকা নারিনজেনিন প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
একটি সুস্থ ইমিউন সিস্টেম তৈরিতে সাহায্য করে
টমেটো শরীরের ভিটামিন সি এর দৈনিক চাহিদার ২৫% পূরণ করতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রামে ১৩.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি পাওয়া যায়। ভিটামিন সি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট,যা ইমিউন কোষ তৈরি করতে সাহায্য করে এবং কোষ বৃদ্ধি এবং নিরাময় করে। ভিটামিন ই এর মতো শরীরের অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলির তৈরি করাও ভিটামিন সি'র উপর নির্ভর করে।
নিরামিষাশী অর্থাৎ যারা প্রাণীজ খাবার থেকে আয়রন পান না তাদের জন্য ভিটামিন সি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি শরীরকে উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবার থেকে আয়রন আরও সহজে শোষণ করতে সাহায্য করে।
অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে
টমেটো অদ্রবণীয় ফাইবারে পূর্ণ, যা মলকে নরম করে। যদি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকে তবে এটি বিশেষভাবে উপকারী। দ্রবণীয় ফাইবার থাকায় খাদ্যতালিকায় টমেটো অন্তর্ভুক্ত করলে এটি রক্তের গ্লুকোজ (চিনির) মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এটি কার্বোহাইড্রেটের হজম এবং শোষণকে ধীর করে দেয়, তাই রক্তে শর্করার মাত্রা খুব দ্রুত বাড়ে না এবং খাওয়ার পরে বেশি সময় ধরে পেট ভরা অনুভুতি দেয়। দ্রবণীয় ফাইবার আমাদের অন্ত্রে একটি প্রিবায়োটিক হিসাবেও কাজ করে।প্রিবায়োটিক হল এমন খাবার যা আমাদের স্বাস্থ্যকর অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকে পুষ্ট করে। সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় ২৫ গ্রাম এবং পুরুষদের ৩৮ গ্রাম ফাইবার রাখা উচিত। একটি মাঝারি টমেটো ১.৫ গ্রাম ফাইবার সরবরাহ করে, যা অদ্রবণীয় এবং দ্রবণীয় ফাইবার দ্বারা গঠিত। উভয়ই হজমের জন্য প্রয়োজনীয় এবং সহায়ক।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
টমেটো আমাদের পটাসিয়ামের চাহিদা পূরণ করে স্বাস্থ্যকর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। রক্তে পটাসিয়ামের উপস্থিতি কিডনির রক্তপ্রবাহে সোডিয়ামের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যা রক্তচাপ কমিয়ে দেয়।
রক্ত এবং হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নয়নে সহায়ক
একটি মাঝারি টমেটোতে ভিটামিন কে-এর দৈনিক চাহিদার প্রায় ১৫ শতাংশ থাকে। ভিটামিন কে প্রোটিন গঠন এবং সক্রিয় করতে ভূমিকা রাখে যা রক্ত জমাট বাঁধতে এবং হাড়কে শক্তিশালী করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে রক্তে বেশি লাইকোপিন থাকলে হৃদরোগ এবং এমনকি কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করে।
কোষের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে
টমেটোতে রয়েছে ফোলেট বা ভিটামিন বি৯। এটি টিস্যুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং কোষের কার্যকারিতা সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য বিশেষভাবে কাজ করে। যারা অন্তঃসত্ত্বা তাদের জন্য ফোলেট গর্ভাবস্থায় ক্রমবর্ধমান ভ্রূণের নিউরাল টিউব ত্রুটি প্রতিরোধে সহায়তা করে, যা অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
শ্বাসযন্ত্রের উন্নয়ন
টমেটোতে আছে লাইকোপিন, ক্যারোটিনয়েড যা ফুসফুস ভাল রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সঠিক কার্যকারিতার সঙ্গে যুক্ত। প্রকৃতপক্ষে, এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ধূমপায়ীদের ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
ব্যায়ামের পর ক্লান্তি দূর করে
টমেটোর রস পটাসিয়াম এবং সোডিয়ামের মতো ইলেক্ট্রোলাইটের একটি চমৎকার উৎস টমেটো। তীব্র, ঘামযুক্ত ওয়ার্কআউটের পরে টমেটোর রস পান করলে বা টমেটো খেলে শক্তি ফিরে পেতে সাহায্য করতে পারে এবং ক্লান্তির পরিবর্তে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করতে পারে।
স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে
টমেটোতে থাকা লাইকোপিন উপাদান হার্টের কিছু জটিলতাও কমাতে পারে। যাদের রক্তে লাইকোপিনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি কম দেখা গেছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে যাদের রক্তে সবচেয়ে কম পরিমাণে লাইকোপিন রয়েছে তাদের তুলনায় যাদের রক্তে বেশি পরিমাণে লাইকোপিন আছে তাদের স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ৫৫ শতাংশ কম।
ত্বক ভালো রাখে
টমেটোতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি ত্বকে ইউভি রশ্মির ক্ষতিকারক প্রভাব প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। টমেটো ত্বকের বার্ধক্যের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। লাইকোপিন সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে ত্বককে সুরক্ষা দেয়। এটি কোলাজেন ভেঙে যাওয়া প্রতিরোধে এবং আমাদের ত্বকে কোলাজেন উৎপাদন বাড়াতেও ভূমিকা রাখে।
চোখ ভালো রাখে
টমেটোতে থাকা আরেকটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হল বিটা-ক্যারোটিন, যা শরীরে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়। ভিটামিন এ চোখের স্বাস্থ্য এবং ইমিউন সিস্টেমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সতর্কতা
- যদিও টমেটো সাধারণত একটি পুষ্টিকর এবং উপকারী খাবার হিসাবে বিবেচিত হয়, তবে কিছু শারীরিক অসুস্থতায় টমেটো সেবন কম করা উচিত।
- ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়শই নির্দিষ্ট খাবারের প্রতি উচ্চ সংবেদনশীলতা থাকে। আইবিএস রোগীদের টমেটো খাওয়ার ফলে অস্বস্তিবোধ হতে পারে। আইবিএস আক্রান্ত ব্যক্তিদের তাদের উপসর্গগুলি পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং প্রয়োজনে অস্বস্তি রোধ করার জন্য টমেটো খাওয়া সীমিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
- টমেটোকে মাঝারি থেকে উচ্চ হিস্টামিন জাতীয় খাবার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। হিস্টামিন অসহিষ্ণুতাযুক্ত ব্যক্তিরা টমেটো খাওয়ার পরে মাথাব্যথা, ত্বকে ফুসকুড়ি, নাক বন্ধ হওয়া বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ব্যাঘাতের মতো লক্ষণগুলি অনুভব করতে পারে।
- কিছু ধরনের কিডনিতে পাথর যেমন ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর খাদ্যের কারণে তৈরি হতে পারে। টমেটোতে অক্সালেট থাকে যা কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে।
- যদিও তুলনামূলকভাবে বিরল কিছু ব্যক্তির টমেটোতে অ্যালার্জি বা সংবেদনশীলতা হতে পারে। টমেটো অ্যালার্জির লক্ষণগুলো হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে। এরমধ্যে ত্বকের ফুসকুড়ি, চুলকানি, আমবাত, ফোলাভাব বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ব্যাঘাত অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
- টমেটোতে অ্যাসিড বেশি থাকে, যা অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।
- এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে টমেটো খাওয়ার ফলে অ্যালকালয়েড সোলানিনের কারণে হজমের সমস্যা এবং বমি বমি ভাব হতে পারে।
Comments