বিলিভ ইট অর নট

টমেটো ট্রায়াল: বিচারের কাঠগড়ায় যখন টমেটো

টমেটো ট্রায়াল: বিচারের কাঠগড়ায় যখন টমেটো
ছবি: সংগৃহীত

আমেরিকানদের জনপ্রিয় সবজির কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে আলু আর টমেটোর নাম। টমেটো আসলে সবজি নয়, ফল। তবে সবজি হিসেবে তা আমেরিকানদের পছন্দের শীর্ষে। হোক তা টাটকা, ফ্রোজেন, ক্যানে ভরা কিংবা প্রক্রিয়াজাত করা। 

স্প্যাগেটি বোলোগনিজ, সস দেওয়া পিৎজা কিংবা ক্যাচআপে ডোবানো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই- টমেটো ছাড়া হয় না কিছুই। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল, যখন টমেটোর বিষয়ে মানুষের মূল্যায়ন ছিল একেবারেই ভিন্ন। নৈতিকতার জায়গা থেকে টমেটো ছিল খুবই বিপদজনক! কিন্তু সব কিছুর পরিবর্তন ঘটে সালেমের সেই বিচারে- না কোনো ডাইনীর নয়, বিচার হয়েছিল টমেটোর! 

ম্যাসাচুসেটস ও সালেম উইচ ট্রায়াল হয়েছিল ১৬৯২ থেকে ১৬৯৩ সালের ভেতর। ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগে ২০০ জনকে করা হয়েছিলো। এর ভেতর ২০ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তবে ১৮২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নিউ জার্সির সালেমে বসে এক অন্যরকম বিচারসভা; 'সালেম টমাটো ট্রায়াল।' 

এর নেপথ্যের শুরুটা কিন্তু ডাইনীদের সেই বিচারেরও বহু আগের। স্প্যানিশ বিজেতাদের কাছে টমেটোকে পরিচিত করান অ্যাজটেকরা। তাদের ভাষায় এর নাম ছিল 'ফোলা-ফাঁপা ফল।' স্প্যানিশদের এটা ভালো লেগে যায়। মেসোআমেরিকা অঞ্চলের গোত্রগুলোতেও জনপ্রিয় ছিল টমেটো। কিন্তু স্পেনে ফিরে টমেটো ফলানোর পর ইউরোপিয়ানরা তার স্বাদ নিতে উৎসাহী হয়নি। 

টমেটো খাওয়া যায়- এ জানলেও বেশিরভাগ ইউরোপীয় একে শুধু সাজসজ্জার কাজেই ব্যবহার করতো। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও আমেরিকান কলোনিগুলোরও ছিল একই অবস্থা। 

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে টমেটোর 'ভাবমূর্তি' খুব সংকটে পড়ে যায়। সে সময় ধর্মীয় ভাবাবেগের প্রাবল্যের ফলে সবকিছু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার একটি প্রবণতা তৈরি হয়। এর বাইরে ছিল না এই 'ফোলা-ফাঁপা' ফলটিও। মানুষ ভয় পেতে শুরু করে টমেটোকে, তাদের টকটকে লাল রংকে মিলিয়ে ফেলে বিপদ, মৃত্যু ও পাপের সঙ্গে। তারা এর নাম দেয় 'বিষাক্ত আপেল।' আর এর সঙ্গে মিলিয়ে নেয় আদমের স্বর্গচ্যুতির ঘটনাও! 

কেনো টমেটোকে নিয়ে তৈরি হলো এই গণ আতঙ্ক? এর পেছনে ছিল টমেটো চাষ করতে গিয়ে মানুষজনের অসুস্থ হয়ে পড়া ও ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুর মতো ঘটনা! কিন্তু এখানে মূল দায় ছিলো পিউটারের। মানুষ তা বুঝতে পারেনি। সে সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ পিউটার ধাতুর তৈরি প্লেটে খাবার পরিবেশন করতো, যার ভেতর ছিলো টমেটোও। পিউটারে অতি বিপজ্জনক মাত্রায় সীসা থাকতো। টমেটোর উচ্চমাত্রার অম্লীয় প্রকৃতির সঙ্গে মিলে এটি তৈরি করেছিলো মহা বিপর্যয়। 

পরের এক শতাব্দীতেও টমেটোর এই বদনাম ঘোচেনি। গবেষক, চিকিৎসকরা একে যৌন উত্তেজক থেকে শুরু করে অতি বিষাক্ত- কিছু বলতে বাদ রাখেননি। সবার কথা ছিল একটিই- টমেটো ভুলেও ছোঁবেন না। তবে একজন ব্যক্তির কারণে উলটে পালটে গেলো সবকিছু। তিনি কর্নেল রবার্ট গিবোন জনসন। 

টমেটো ট্রায়াল: বিচারের কাঠগড়ায় যখন টমেটো
টমেটোর অপবাদের শিকার হওয়ার নেপথ্যে ছিলো 'পিউটার' ধাতু। ছবি: সংগৃহিত

১৮২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। জনসন ঠিক করলেন তিনি চিরতরে প্রমাণ করবেন টমেটো নির্দোষ, এর আছে নিখাঁদ খাদ্যগুণ। এক ঝুড়িভর্তি টমেটো নিয়ে নিউ জার্সির সালেম কোর্টহাউসের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। উৎসুক জনতার সামনেই তিনি ঝুড়ি থেকে তুলে খেতে শুরু করলেন একেকটা লাল শয়তানকে! কিন্তু না, কিছুই হলো না তার। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দিব্যি সুস্থ রইলেন জনসন! আর বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে অপবাদ মুক্ত হলো টমেটো। 

তবে কেউ কেউ বলেছেন- কর্নেল জনসন নিউ জার্সিতে বাস করলেও এভাবে টমেটো খাওয়ার ঘটনার কোনো সুদৃঢ় প্রমাণ নেই। ঘটনার অন্তত ৯০ বছর পর এর উল্লেখ পাওয়া যায়, সমসাময়িক কোনো নথিতে এর কোনো উল্লেখ নেই! তাই গল্পটি বানানো বলেই অনেকে মনে করেন। 

তাছাড়া, বিভিন্ন রান্নার বইয়ে সে সময় বা তার আগেই টমেটোর উপস্থিতি পাওয়া যায়, এমনকি টমাস জেফারসন টমেটো খেয়েছেন এমন ঘটনারও উল্লেখ পাওয়া যায়! অবশ্য এমন হতেই পারে, খোদ প্রেসিডেন্ট খেলেও জনসাধারণের কাছে সেটি তেমন গ্রাহ্য হয়নি। 

মূলত লোকমুখেই ছড়িয়েছিল সালেমের এই টমেটো ট্রায়ালের কাহিনী। এ ছাড়া এটি প্রচার পায় সংবাদ প্রতিবেদক ও সালেমের পোস্টমাস্টার জোসেফ সিকলারের মাধ্যমে। পরে সিবিএস তাকে একটি রেডিও শো-এর জন্য একজন 'ইতিহাস বিষয়ক পরামর্শক' হিসেবে আনে ও এই ঘটনার ওপর একটি শ্রুতি নাটক তৈরি করে। সেখানে এটিকে 'সত্য ঘটনা' হিসেবেই প্রচার করা হয়। 

তবে এই ঘটনা সত্য হোক বা মিথ্যা, এখানে পুড়ে মরতে হয়নি কোনো ডাইনিকে, বরং নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলো টমেটো। 

 

তথ্যসূত্র: রিপলিস বিলিভ ইট অর নট
গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

3h ago