কেন খাবেন দেশি ফল, বিশেষজ্ঞ-পুষ্টিবিদের পরামর্শ

ছবি: সংগৃহীত

বিদেশি ফলের পুষ্টিগুণ বেশি, অনেকেরই ধারণা এমন। তাই রোগীর জন্য আঙুর, মাল্টা, আপেল, নাশপাতি কেনার দিকে ঝোঁকও বেশি থাকে। 

কিন্তু দেশি এমন অনেক ফল আছে যার পুষ্টিগুণ অনেক বিদেশি ফলের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। পুষ্টিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এমনটাই বলছেন।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, 'অনেকের ধারণা বিদেশি ফলে পুষ্টি বেশি। অথচ আমাদের দেশি ফল সবগুলোই কিন্তু ভালো, অনেক পুষ্টিসমৃদ্ধ।'

তিনি বলেন, 'বেশি দামের বিদেশি ফলের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট বেশি, কিন্তু দেশি ফলের দাম কম, অত্যন্ত রুচিকর ও পুষ্টিগুণে ভরপুর।'

ডা. আব্দুল্লাহর মতে, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিদেশি ফলের পাশাপাশি দেশি ফলও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু হলে লিকুইড সমৃদ্ধ ফল, পানি, গ্লুকোজ, ওরস্যালাইন, ফলমূলের রস খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

দেশি ফলের মধ্যে কলা, পেয়ারা, জাম, লটকন, বেল, আমড়া, গাব, সফেদা, বাতাবি লেবু, আনারস, আমলকি পুষ্টিগুণে ভরপুর। 

তবে রোগীদের ফল খেতে বললে তারা বিদেশি ফল খেতেই বেশি পছন্দ করেন বলে জানান পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ ও ডিপার্টমেন্ট অব ডায়েটেটিকসের বিভাগীয় প্রধান ডা. নিশাত শারমিন নিশি।

তার মতে, সচেতনতার অভাবেই বিদেশি ফলের দিকে ঝোঁক বেড়েছে।

তিনি বলেন, 'কোন ফল কেনা উচিৎ, কখন খাওয়া উচিৎ বা কী পরিমাণ খাওয়া উচিৎ সেই সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই অনেকের। বাংলাদেশে ঋতু অনুযায়ী যেসব ফল পাওয়া যায় সেগুলো এক ধরনের আশীর্বাদ। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের রোগ বা ফ্লু আক্রমণ করে মানবদেহে। সবসময় সবধরনের ফ্লু আক্রমণ করে না। আবহাওয়া পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে আসে।'

পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি বলেন, 'আমাদের দেশে যেসব ফল উৎপন্ন হয় সেগুলো আবহাওয়াকে কেন্দ্র করেই হয়। তাই যে ঋতুতে যে ফল পাওয়া যায়, সে ঋতুতে যেসব রোগ হয় তার অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির জন্য আমাদের শরীরে ওই ফলগুলো ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। বৃষ্টির সময়, শীতের সময় যে ফল পাওয়া যায় বা প্রচণ্ড গরমের সময় যে রসালো ফলগুলো পাচ্ছি, সেগুলোকে যদি ওই সময়ের রোগ-ব্যাধির সঙ্গে বিবেচনা করে ফল বাছাই করে খেতে পারি তবে সেগুলো দেহে শক্তি যোগাবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।'

ত্বকের সমস্যা, চুল পড়া রোধসহ শারীরিক নানা সমস্যায় ঋতু অনুযায়ী দেশীয় ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি।

আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন না হলেও, সপ্তাহে ৩ দিন যদি 'সিজনাল' ফল রাখা যায়, তবে তা ওষুধ থেকে দূরে রাখতে সহায়ক হবে বলে জানান এই পুষ্টিবিদ।

কোন ফলে কী পুষ্টি

বাজারে সারা বছর ঋতুভেদে বিভিন্ন ধরনের দেশি ফল পাওয়া যায়। বিভিন্ন দেশি ফলে আছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, প্রোটিন প্রভৃতি খাদ্য উপাদান।

আমলকি

ডা. নিশাত শারমিন জানান, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল আমলকিতে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। এই ফল ক্ষুধামন্দা দূর করে, মুখের রুচি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া সর্দি-কাশি কমাতে, ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য ধরে রাখতেও সাহায্য করে আমলকি। 

রক্তস্বল্পতার জন্যও আমলকি কার্যকরী। বিশেষ করে নারীদের পিরিয়ডের সময় আমলকি খাওয়া খুবই উপকারী।

আমড়া

টক জাতীয় ফল ভিটামিন 'সি' এর উৎস। আমড়াতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন 'সি' থাকার পাশাপাশি আছে ক্যালসিয়াম, আয়রন ও প্রচুর ফাইবার।

ডা. নিশাত বলেন, 'একটি আমড়ায় আপেলের তুলনায় প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রন বেশি।'

পেয়ারা

সারা বছর পাওয়া যায়, এমন ফলের মধ্যে পেয়ারায় প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফাইবার আছে।

পেয়ারা দাঁতের মাড়ির সমস্যা দূর করে। বাচ্চাদের চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পেয়ারা দারুণ কাজে দেয়। মাড়ি গঠনে পেয়ারা সাহায্য করে। 

তবে পেয়ারা খাওয়ার সময় সেটি পরিপক্ব কি না, তা খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদ নিশাত। কাঁচা পেয়ারা খেলে অনেক সময় হজমে অসুবিধা হয় এবং পরিপূর্ণ পুষ্টিগুণ থাকে না।

কামরাঙা

কামরাঙা ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিজেন সমৃদ্ধ। এর পুষ্টিগুণ বেশি থাকলেও, কামরাঙায় অক্সালিক অ্যাসিড বেশি থাকে। তাই একটির বেশি কামরাঙা খেলে শরীর টক্সিক হতে পারে। 

কিডনিজনিত যে কোনো সমস্যা বা কিডনি রোগীদের কামরাঙা না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন।

লটকন

অন্যান্য ফলের মধ্যে লটকন ভিটামিন 'বি' এর ঘাটতি দূর করে। এছাড়া এতে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম আছে। 

নিশাত শারমিন বলেন, 'যাদের নার্ভ দুর্বল তাদের জন্য লটকন খুব উপকারী। মানবদেহের নার্ভাস সিস্টেম ঠিক রাখতে, নিউরো ভালো রাখতে লটকন দারুণ কাজ করে।'

জামরুল

ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ ফল জামরুলে নায়াসিন নামে একটি উপাদান আছে যা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। দুই রঙের জামরুলই খুব উপকারী। 

জামরুলে প্রচুর ফাইবার থাকে। এই ফল স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়, লিভার ভালো রাখতে সহায়তা করে।

পেঁপে

পাকা পেঁপেতে ভিটামিন এ, ফাইবার, বিটা ক্যারোটিন পাওয়া যায়। ত্বকের জন্য পেঁপে খুব উপকারী। 

ডা. নিশাত বলেন, 'চুলকানি-খোসপাঁচড়ার জন্য পেঁপে খুব ভালো। এই ফল বাচ্চাদের চোখের সমস্যা দূর করে। যাদের হজমে সমস্যা তাদের পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে পেঁপে।'

এছাড়াও খুব গরমে পেঁপের শরবত শরীরে শক্তি যোগায়, ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা করে।

বেল

বেলে পাওয়া যায় ভিটামিন এ, সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও প্রোটিন।  

তবে, কিডনি রোগীরা বেল খাবেন কি না, সেটি চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে বলেছেন পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি।

সফেদা

অ্যান্টি-অক্সিজেন আছে সফেদায়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এতে আরও আছে সোডিয়াম ও ফলিক, যা অ্যানিমিয়া দূর করে। 

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই হয় অনেকের। এটি রোধেও কাজ করে সফেদা।

গাব

গাবে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, আয়রন পাওয়া যায়। 

গাব ডায়াবেটিক কমায়, বিপি নরমাল রাখতে সাহায্য করে বলে জানান নিশাত শারমিন। এটি অন্ত্রের সুস্থতা রক্ষা করতেও সাহায্য করে। 

বাতাবি লেবু
 
ভিটামিন সি এর একটি বড় উৎস বাতাবি লেবু। এটি ওজন কমাতে, খুশকি দূর করতে, ত্বক ভালো রাখতে সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। 

তবে মশলা দিয়ে না মাখিয়ে ফ্রেশ বাতাবি লেবু বা শরবত বানিয়ে খাওয়ার পরামর্শ পুষ্টিবিদের।

কলা

কলা অত্যন্ত শক্তিবর্ধক। এটি হজমে সহায়তা করে। এতে প্রচুর ক্যালরি ও আয়রন পাওয়া যায়। ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে কলা। তবে কোল্ড অ্যালার্জিজনিত সমস্যা থাকলে কলা না খাওয়াই ভালো।

পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি বলেন, 'বর্তমান প্রজন্ম দেশি ফল সম্পর্কে জানে না। এতে করে দেশি ফল খাওয়ার সংস্কৃতি তা হারিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি ফল কেনার পাশাপাশি যখন যে ঋতু আসবে সেই অনুযায়ী দেশি ফল কিনতে হবে। সুস্থ থাকার উদ্দেশে এবং একইসঙ্গে দেশি ফলের সংস্কৃতি ও বাজার ধরে রাখতেই তা করা উচিৎ।'

তার মতে, দেশি ফল না কিনলে, চাষিরা উৎপাদনে আগ্রহ হারাবে। একসময় পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ দেশি ফলের বাজারও বিলুপ্ত হবে। বর্তমানে অনেক দেশি ফলই প্রায় বিলুপ্ত।

বিদেশি ফলের দিকে ঝোঁকার পেছনে দেশি ফলের বাজার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারানোকে দায়ী করছেন পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি।

তিনি বলেন, 'দেশি ফলে ফরমালিন ও কেমিক্যাল কমপাউন্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে একটা ভয় এসে গেছে জনমনে। যেমন-কলা পাকানোর জন্য অনেক সময় কার্বাইড ব্যবহার করা হয়, এসব জানার পর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে।'

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, 'দ্রব্যমূল্যের চড়া বাজারে বেশি দাম দিয়ে বিদেশি ফল না কিনে দেশি ফল খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যালেন্স ডায়েট অর্থাৎ প্রয়োজনমতো প্রোটিন, কার্বোহাইট্রেড, শাকসবজি খাওয়ার পাশাপাশি ফল খেতে হবে। শিশুদের ফল খাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে।'

 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

5h ago