ড. বিজনের গবেষণায় ভিটামিন ‘সি’র কার্যকারিতা নিয়ে জানা গেল যে নতুন তথ্য

‘যথাযথভাবে ভিটামিন “সি” গ্রহণ করলে ওষুধের প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে।’
ড. বিজন কুমার শীল

'ভিটামিন "সি" মানুষকে কীভাবে সুস্থ রাখে ও শরীরে কোন প্রক্রিয়ায় কাজ করে, এর কিছু বিষয় চিকিৎসা বিজ্ঞান বহু আগেই জেনেছে। তবে কিছু বিষয় এখনো রয়ে গেছে অজানা। আমরা জানি, মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে এনজাইম। কখনো কখনো শরীরে এনজাইমের পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে যায়, যা মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর। এনজাইম বেড়ে গেলে তৈরি হয় অ্যান্টি-এনজাইম, যা অতিরিক্ত এনজাইমকে প্রতিরোধ করে।

'জানা ছিল না, অনেক সময় এনজাইম এত বেশি বেড়ে যায় যে, অ্যান্টি-এনজাইম তা প্রতিরোধ করতে পারে না এবং তখন শারীরিক সমস্যা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত এনজাইম প্রতিরোধ করে ভিটামিন "সি"। আমি গবেষণা থেকে যা নিশ্চিত হয়েছি।'

থাইল্যান্ড থেকে টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল

ড. বিজন বর্তমানে থাইল্যান্ডের হাত ইয়াই শহরের প্রিন্স অব সংক্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। সেখানেই গবেষণা করছেন ভিটামিন 'সি'র কার্যকারিতা নিয়ে।

গত ২৪ আগস্ট থাইল্যান্ডে 'ফুকেট কনফারেন্স অব ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট' শীর্ষক সেমিনারে ভিটামিন 'সি'র কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণার ফলাফল সামনে এনেছেন ড. বিজন। এই গবেষণা তিনি করোনাভাইরাস মহামারির সময় বাংলাদেশে থাকাকালীন শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তার আগেই ভিসা জটিলতায় তাকে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়। পরবর্তীতে থাইল্যান্ডে সেই গবেষণা সম্পন্ন করেছেন বলে জানিয়েছেন ডেইলি স্টারকে।

তার এই গবেষণালদ্ধ ফল ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুরে প্যাটেন্ট করা হয়েছে। গবেষণাপত্র একটি খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের জন্যে জমা দিয়েছেন। কঠিন রিভিউ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তা প্রকাশিত হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন উদ্ভাবন হিসেবে তা স্বীকৃতি পাবে বলে জানান ড. বিজন।

সাধারণত জ্বর বা বিভিন্ন সময় ফ্লুতে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকেরা ভিটামিন 'সি' গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে ভিটামিন 'সি'র কার্যকারিতা কিংবা স্বাভাবিকভাবেই ভিটামিন 'সি' খাওয়ার বিষয়টি কমবেশি সবারই জানা।

এই বিজ্ঞানী জানান, ভিটামিন 'সি' সাধারণত শরীরে ৩ ভাবে কাজ করে। এগুলো হচ্ছে—মানব শরীরে কোলাজেন টিস্যু তৈরিতে সহায়তা করা, অ্যান্টি-অক্সিডেন হিসেবে কাজ করা ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।

তার গবেষণার তথ্য অনুসারে, ইনফেকশনের কারণে শরীরে এনজাইমের পরিমাণ বেড়ে গেলে তখন তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠে। অনেক সময় এই এনজাইম এতই অতিরিক্ত হয়ে যায় যে, অ্যান্টি-এনজাইম তা প্রতিরোধ করতে পারে না। তখনই ভিটামিন 'সি' তা প্রতিরোধ করে।

ড. বিজন জানান, করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস বি, সি ও এইচআইভিসহ প্রায় ডজনখানেক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস মানবশরীরে প্রভাব বিস্তার করে এনজাইমের মাধ্যমে। ক্যানসার সেলও এনজাইম ব্যবহার করেই শরীরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। একইসঙ্গে সাপসহ বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের বিষের মধ্যেও এনজাইম আছে, যে কারণে অনেক সময় সেগুলোর কামড়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। বিশ্বের সব প্রাণীরই এনজাইম দরকার। কিন্তু সেটা পরিমিত পরিমাণে। অতিরিক্ত এনজাইম তৈরি হলে তখন এর নেতিবাচক প্রভাবটা পড়ে।

প্রাপ্তবয়স্ক একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক ২৫০-৪০০ মিলিগ্রাম এবং অসুস্থদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ সাপেক্ষে দৈনিক ১-৩ গ্রাম পর্যন্ত ভিটামিন 'সি' খাওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

ড. বিজনের ভাষ্য, 'পৃথিবীতে যেসব প্রাণী শরীরের ভেতরে ভিটামিন "সি" তৈরি করতে পারে না, মানুষ তাদের মধ্যে আছে। ফলে আমাদের ভিটামিন "সি" খেতে হয়, যা আমরা ফলমূলের মাধ্যমে বা ট্যাবলেট আকারে খাই কিংবা ইনজেকশনের মাধ্যমেও নেই।

যথাযথভাবে ভিটামিন 'সি' গ্রহণ করলে ওষুধের প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তবে, অনেক ক্ষেত্রে ভিটামিন 'সি' কার্যকরভাবে কাজ করে না—এমন মতও আছে। সে বিষয়ে ড. বিজনের ভাষ্য, 'ভিটামিন "সি" কোন ফর্মে গ্রহণ করা হয়েছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানবশরীরে ভিটামিন "সি" ২টি ইলেকট্রন ডোনেট করতে পারে। এই সক্ষমতা আছে বলেই ভিটামিন "সি" দ্রুত কাজ করে এবং অতিরিক্ত এনজাইম প্রতিরোধ করে। মুখে খেলে ভিটামিন "সি"র পূর্ণ কার্যকারিতা পাওয়া যায়। কিন্তু ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রহণ করলে এর কার্যকারিতা অর্ধেক হয়ে যায়। এ কারণেই অনেক সময় অনেকের ক্ষেত্রে ভিটামিন "সি" যথাযথভাবে কাজ করে না।

'আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, কখন ভিটামিন "সি" খাচ্ছে? একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায় গিয়ে ভিটামিন "সি" নিলে তো সেটা কার্যকর হবে না। এই জন্যই আমরা বারবার সাধারণ মানুষকে ভিটামিন "সি" খাওয়া শুরু করতে বলি। এতে ইনফেকশন প্রতিরোধ করা না গেলেও এর তীব্রতা কমবে এবং শরীর দ্রুত সেরে উঠতে সহায়তা করবে।'

ভিটামিন 'সি' অতিরিক্ত খেলেও তা শরীরে থাকে না উল্লেখ করে তিনি জানান, ভিটামিন 'সি' ওয়াটার-সলিউবল। শরীরে ভিটামিন 'সি'র অভাব হতে পারে। কিন্তু চাইলেও অতিরিক্ত ভিটামিন 'সি' শরীরে থাকে না। শরীর যখন বুঝতে পারে যে অতিরিক্ত ভিটামিন 'সি' আছে, তখন ইউরিনের মাধ্যমে সেটা বের করে দেয়। তাই অতিরিক্ত না খেয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাওয়াই ভালো।

করোনাভাইরাস মহামারির সময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সহায়তায় করোনা শনাক্তের 'জি র‍্যাপিড ডট ব্লট' কিট উদ্ভাবন করে দেশে আলোচিত হন ড. বিজন কুমার শীল। যদিও নানা জটিলতায় পরবর্তীতে সেই কিট আর অনুমোদন পায়নি। এর আগে ছাগলের রোগ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন ও সার্স ভাইরাস শনাক্তের কিট উদ্ভাবন করে বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

9h ago