পাকিস্তান: সেনা, দেনা ও পিটিআই সংকট
সেনা ও দেনার পর পাকিস্তানে এখন চলছে পিটিআই সংকট। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই নেতা ইমরান খানের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তুলে নেওয়ায় আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে বলা যায়— সমস্যা যেন পাকিস্তানের পিছু ছাড়ছেই না।
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ
এ কথা সবাই জানেন যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অভিযোগ বলতে গেলে এর জন্মলগ্ন থেকেই।
গত শুক্রবার ডনের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, পিটিআই নেতা ইমরানের 'রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে' তার গ্রেপ্তারকে সমর্থন করেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির।
এতে আরও বলা হয়, ইমরান খান তার গ্রেপ্তার নিয়ে দলের সমর্থকদের ওপর হামলার জন্য জেনারেল মুনিরকে দায়ী করেছেন।
এর আগে, প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর সময় ইমরান তার বিরোধীদের সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
তবে ওয়াশিংটনের উডরো উইলসন সেন্টার ফর স্কলারর্সের বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলমান মনে করেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশটির বর্তমান সংকট থেকে নিজেদের 'দূরে রেখেছে'।
সম্প্রতি তিনি জার্মানির সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে বলেন, 'তারা (সেনারা) পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা চায়। অর্থাৎ, রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটির সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলবে। বিশেষ করে, সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বাড়াবে।'
ইরান, আফগানিস্তান, চীন ও ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘ সীমান্ত থাকায় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে পাকিস্তানের জেনারেলরা চিন্তিত বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, চলমান গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইশাক দার ঘোষণা দিয়েছেন— তার দেশের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে কোনো 'আপস' করা হবে না। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের ওপর সেনাবাহিনী জোরালো প্রভাব আছে।
গত ১৬ মার্চ ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থমন্ত্রী ইশাক দার সিনেটর রাজা রাব্বানির প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, 'আমি আশ্বস্ত করছি, পাকিস্তানের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে কেউই কোনো আপস করতে পারবে না—সে সুযোগ নেই।'
পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চাপের কারণে চুক্তি সইয়ে দেরি হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নও তুলেছেন এই সিনেটর।
এর জবাবে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্রের পরিধি কত হবে ও এখানে কী ধরনের পরমাণু বোমা থাকবে সে বিষয়ে কথা বলার অধিকার কারো নেই।
অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যখন পাকিস্তানের জনগণ ভুগছে তখন রাজনীতিক ইশাক দারের এমন বক্তব্যে 'সেনা তোষণ' নীতির বহিঃপ্রকাশ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে।
অর্থনৈতিক সংকট
গতকাল সোমবার ডন'র প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার আগের এক বছরের তুলনায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।
অপর এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটি দেশটির জন্য চাওয়া আইএমএফের ঋণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছে, 'এটি 'রূপালি বুলেট' নয় তো?'
গত ১৪ মার্চ ভারতের বাণিজ্যবিষয়ক দৈনিক 'মিন্ট' জানিয়েছে, 'সংকটে আইএমএফ চুক্তি, শুধু চীনই পারে পাকিস্তানকে উদ্ধার করতে।'
ডনের বরাত দিয়ে 'মিন্ট'র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—'ব্যাংক অব আমেরিকা জানিয়েছে, অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে আইএমএফ ও পাকিস্তান এখনো আলোচনায় আছে। এমন পরিস্থিতিতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীনই পারে দেশটিকে উদ্ধার করতে।'
প্রতিবেদন অনুসারে, আইএমএফ থেকে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে পাকিস্তান কর বাড়ানো, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও সুদের হার গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ করাসহ বেশকিছু নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছে।
দ্য নিউজ'র বরাত দিয়ে গত ১৬ মার্চ সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ জানায়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে চীনের একটি ব্যাংক পাকিস্তানকে প্রতিশ্রুত ২ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
গত ১৭ মার্চ ডেইলি পাকিস্তান জানায়, দেশটির চরম সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে বাঁচাতে এখন সবার দৃষ্টি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের দিকে।
এর আগে ডন জানায়, চীনের পাশাপাশি খনিজসমৃদ্ধ কাতারও পাকিস্তানকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি ইসলামাবাদের বিনিয়োগবান্ধব নীতি কাজে লাগাতে চায়। বলা বাহুল্য, এগুলোর বাস্তবায়ন বেশ সময় সাপেক্ষ।
এদিকে আইএমএফের সঙ্গে চুক্তিতে দেরি হওয়ার জন্য পরোক্ষভাবে অর্থমন্ত্রী ইশাক সাবেক পিটিআই সরকারকে দায়ী করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে আইএমএফের সঙ্গে সমঝোতাগুলোকে এখন অনেকে 'নতুন কর্মসূচি' মনে করে ভুল করছেন।
সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাট জানায়, আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের চুক্তি হয় ২০১৯ সালে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত 'ঋণ কর্মসূচি'র প্রক্রিয়া চলবে।
আইএমএফের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ককে 'অম্ল-মধুর' হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এটি হবে গত ৭৫ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের ২৩তম আইএমএফ কর্মসূচি।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের মিশিগান নিউজ পোর্টালে বলা হয়েছে, গত বছরের মাঝামাঝি ভয়াবহ বন্যার পর দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির বিধ্বস্ত অর্থনীতি আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। কলকারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে। মূল্যষ্ফীতি গড়ছে নতুন রেকর্ড।
পাকিস্তান সরকার মনে করে অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে তাদের ৯ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু, এই অর্থ দেশটির সংকট দূর করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে এই সংবাদ বিশ্লেষণে।
এতে বলা হয়, এই অর্থ হয়তো দেশটির তারল্য সংকট কিছুটা কমাবে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করবে। বেসরকারি উৎস থেকে আরও অর্থ আসা প্রয়োজন।
গত ১৫ মার্চ টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ইমরান খানকে নিয়ে চলমান ঘটনা দেশটির অর্থনীতিকে সংকট আরও গভীর করে তুলবে।'
পিটিআই সংকট
মুসলিম লিগের (নেওয়াজ) নেতৃত্বাধীন বর্তমান জোট সরকারের প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। গত বছরের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই ইমরান খান জানাচ্ছেন যে, তাকে 'হত্যা'র পরিকল্পনা হয়েছে। এমনকি তিনি 'পাকিস্তান ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার পথে' বলেও মন্তব্য করেছিলেন।
সোমবার ডন জানিয়েছে, পিটিআই প্রধান ইমরান দাবি করেছেন যে তাকে 'হত্যা'র জন্য 'অপরিচিত মানুষ' ইসলামাবাদে জুডিশিয়াল কমপ্লেক্সে অবস্থান নিয়েছিল। তাই তিনি নিজের গাড়ি থেকে নামেননি।
গত শনিবার ইমরান তার বিরুদ্ধে আনা 'তোষাখানা মামলা' হিসেবে পরিচিত দুর্নীতি মামলার শুনানিতে অংশ নিতে লাহোর থেকে ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন। সেসময় তার লাহোরের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালালে দেশটির রাজনীতি নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
গত সপ্তাহে দুর্নীতি মামলায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করতে গেলে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
আজ জিও নিউজ জানিয়েছে, তথ্যমন্ত্রী মারিয়াম আওরঙ্গজেব সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে 'সন্ত্রাসী' হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, লাহোরে তার বাসভবন 'সন্ত্রাসীদের ডেরা' ও 'পেট্রোল বোমা তৈরির গবেষণাগার'।
গতকাল মারিয়াম এক সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, যদি আইন, বিচার ব্যবস্থা ও পুলিশ প্রশাসনকে 'চ্যালেঞ্জ' করা হয় তাহলে দেশে 'গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে'।
যখন সরকার ও বিরোধীদল উভয়েই বিস্তৃত সংঘাত ও গভীর সংকটের আশঙ্কা করছে তখন এমন ধারণা করাই যায় যে, অন্তত আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশটিতে সার্বিকভাবে অশান্তি থেকেই যাবে।
Comments