অধ্যাপক এম শামসুল আলমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণ
সামগ্রিকভাবে অব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণেই সারাদেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম।
মঙ্গলবার রাতে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে লোড সাইড (বিদ্যুতের চাহিদা) ও জেনারেশন সাইডের (বিদ্যুৎ উৎপাদন) ভোল্টেজ কন্ট্রোল বা ডিস্ট্রিবিউশন (বিতরণ) সাইডের ক্ষেত্রে সে সব টেকনিক্যাল নির্দেশনা অনুসরণ করা দরকার বাংলাদেশে সেগুলো সাধারণত মেনে চলা হয় না। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার বা এনএলডিসি অসহায়। মানে এখানে সমন্বয়ের বড় ধরনের অভাব আছে।'
'যেমন ভোল্টেজ কন্ট্রোল করতে না পারলে, ফ্রিকোয়েন্সি কন্ট্রোল করা যাবে না। ফ্রিকোয়েন্সির ক্ষেত্রে অল্প ভ্যারিয়েশন অ্যালাউ করা যায়। বেশি তারতম্য হয়ে গেলে সিনক্রোনাইজেশনে সমস্যা তৈরি হয়। একের পর এক জেনারেশন ট্রিপ করতে থাকে,' বলেন তিনি।
'বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হলে ফ্রিকোয়েন্সি স্ট্যাবল রাখতে হবে' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয়ভাবে লোড ডিস্ট্রিবিউশনে কন্ট্রোল রাখতে হলে অনেক সময় লোড ডিসকানেক্ট করা হয়, অনেক সময় জেনারেশন ডিসকানেক্ট করা হয়। যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হলে যেখানে কম উৎপাদন হচ্ছে, সেগুলোকে আগে উৎপাদনে আনা হয়, পর্যায়ক্রমে লোড বাড়ানো হয়। আবার উৎপাদন কমে গেলে শাটডাউন বা ডিসকানেক্ট করা হয়। এসব কাজগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হওয়ার কথা।'
'এর সঙ্গে বিদ্যুৎ জেনারেশনের প্ল্যান্টগুলোর সঙ্গে লোড সাইডের কো-অর্ডিনেশন যদি সঠিকভাবে না হয়, টেকনিক্যাল এবং ম্যানেজমেন্ট কো-অর্ডিনেশন দুটোই যখন সঠিকভাবে না হয় তখন গ্রিড বিপর্যয়ের ঝুঁকি থাকে,' যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, 'ট্রান্সমিশন লাইন বা ডিস্ট্রিবিউশন লাইনের ত্রুটির কারণেও গ্রিড বিপর্যয় ঘটে। তবে আমার মনে হয় না এ কারণে আজকের এ বিপর্যয় ঘটেছে। তারপরও এটা জানার অপেক্ষায় আছি।'
তিনি আরও বলেন, 'পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের যে ফর্মুলা ছিল, সেখানে লোড সাইডে বিভিন্ন সময়ে তাদের লোড ভ্যারিয়েশন কী ধরনের ছিল সেটার সব তথ্য তারা দেয়নি। আবার জেনারেশন সাইডে তারা কখন কতটা জেনারেট করতে পারছে, সেই তথ্যও তারা দেয়নি।'
'অনেক ক্ষেত্রেই মনগড়া তথ্য দিয়ে এনএলডিসিকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে' উল্লেখ করে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, 'অনেক সময় দেখা গেছে যে লোড বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু শাটডাউন করা হচ্ছে না বা ডিসকানেক্ট করছে না। তখন বাধ্য হয়ে এনএলডিসি নিজেই এই কাজটা ম্যানুয়ালি করে।'
ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার বা এনএলডিসি হলো দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয়কারী সংস্থা।
চুয়েটের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, 'জেনারেশন সাইডে যত মেগাওয়াট উৎপাদন করার কথা বলছে, তারা হয়তো তত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে পারেনি। কিন্তু এর ওপর পরিকল্পনা করেই তো ডিস্ট্রিবিউশন করা হয়। এসব বিষয় ছাড়াও দেশে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৩০ শতাংশ এখনো এনএলডিসির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে লোড কন্ট্রোল করা হয়।'
'তাদের আইনের আওতায় এনে তথ্য দিতে বাধ্য করা এনএলডিসির এখতিয়ারেও পড়ে না, ক্ষমতাও নেই। এটা মন্ত্রণালয় থেকেই করতে হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এসব বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, তারা এগুলো বোঝেও না,' যোগ করেন তিনি।
রুটিন লোডশেডিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'লোডশেডিংয়ের ফরমান জারি করা হলো পরিপত্র আকারে, কিন্তু সেটা প্রতিপালিত হচ্ছে না কেন, তার অগ্রগতি কী, তার খোঁজখবর রাখেনি। তখন যদি এগুলো ঠিকভাবে মনিটরিং করা হতো তাহলে লোড ও ফ্রিকোয়েন্সি স্ট্যাবিলাইজেশনের একটা প্র্যাকটিসে আমরা অভ্যস্ত হতে পারতাম। এটা একটা সুযোগ ছিল।'
'আমি বলতে চাই অব্যবস্থাপনার কারণে সিস্টেমের ওপর কন্ট্রোল নেই। তার মানে হচ্ছে আপনি সবসময় ফ্রিকোয়েন্সি স্ট্যাবল রাখতে পারবেন এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখন আজকের ঘটনায় কী ঘটেছে, সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু এরকম একটা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন হচ্ছিল। সেটা একটা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে,' তিনি বলেন।
অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, 'কিছুদিন আগে পরিকল্পিত লোডশেডিং বিভিন্ন জায়গায় কার্যকর না হওয়ায় যখন পরিদর্শনে গিয়েছি, তখন এগুলো আমার কাছে পরিষ্কার হলো। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কাছে পরিষ্কার না কেন, আর মন্ত্রণালয় কেন কড়াকড়ি করবে না? কড়াকড়ি করলেই তো সিস্টেমটা একটা স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিসের মধ্যে চলে আসে। তারপরও ট্রিপ করত কি না সেটা বলা মুশকিল, কিন্তু আমি মনে করি এত বড় একটা বিষয় এভাবে অরক্ষিত রেখে আপনি যত যা-ই করেন, এতে কোনো ফল পাবেন বলে আমার মনে হয় না।'
'পুরো বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা বা লোডের ক্ষেত্রে যে ধরনের ম্যানেজমেন্ট করা দরকার, লোড সাইডে এবং জেনারেশন সাইডে কখন কতটুকু জেনারেট করতে হবে, জেনারেট করতে না পারলে কতটুকু লোড কন্ট্রোল করতে হবে এবং এগুলো কন্ট্রোলের মধ্য দিয়ে সিস্টেমের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রাখার মতো বিষয়গুলো হুমকির মধ্যে ছিল, ঝুঁকির মধ্যে ছিল।'
'লোড সাইডকে টেকনিক্যাল ইনস্ট্রাকশনের আওতায় আনা যায়নি, জেনারেশন সাইডকেও আনা যায়নি। ভোল্টেজ কন্ট্রোলের ব্যবস্থা এনএলডিসিতে থাকতেই পারত। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানটিকে সেভাবে উন্নীত করা হয়নি,' যোগ করেন তিনি।
'জেনারেশনের ক্ষেত্রে এনএলডিসিতে বসে যদি প্রতি মুহূর্তের ভোল্টেজ-ফ্রিকোয়েন্সি দেখা যেত, কমবেশি হলে নিয়ন্ত্রণ করা যেত, কিন্তু সেটা করা হয়নি।'
'যেমন লোড সাইডে কোথাও স্যাংশন আছে ৩০ মেগাওয়াট, আপনি সেখানে ৪০ মেগাওয়াট নিয়ে বসে আছেন, আপনাকে বাধ্য করা যাচ্ছে না লোড কাটডাউন করতে। তখন দেখা যায় এনএলডিসি বাধ্য হয়ে লোড ডিসকানেক্ট করে দেয়।'
তিনি বলেন, 'কো-অপারেট না করার যে বিষয়গুলো, টেকনিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড না মেনে চলার মতো অপেশাদার আচরণ তো সিস্টেমের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিদ্যুতের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ইউটিলিটির ক্ষেত্রে যদি নন-প্রফেশনাল আচরণ থাকে, সেটা তো সিস্টেমের জন্য খুবই ক্ষতিকারক।'
'প্রফেশনাল এথিকস ও স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এথিকস পড়ানো হয়। কিন্তু এগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে সিরিয়াসনেস না থাকলে তখন কী হবে?'
'এরকম একটা অবস্থার মধ্যে যদি বিদ্যুৎ বিভাগ চলে, তাহলে কী কারণে এ বিপর্যয় ঘটেছে, সেটা বলার আগে এটা বলতে হবে যে এ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকলে যে কোনো সময় এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে এবং ঘটবেই,' বলেন তিনি।
মঙ্গলবার দুপুর থেকে দেশের প্রায় সব অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর রাতে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ ফিরতে শুরু করে।
এর কারণ হিসেবে জানা গেছে যে ঘোড়াশাল পাওয়ার প্ল্যান্টে ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, 'ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাওয়া মানে লোড ফল করেছিল বা কমে গিয়েছিল। লোড ফল করা মানে জেনারেশনের গতি বেড়ে যাওয়া। অর্থাৎ লোড বাড়া-কমার সঙ্গে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়া-কমা নির্ভর করে। একটার ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে, অপরটা স্ট্যাবল থাকে না।'
এটাকে বিপর্যয়ের একটা কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এনএলডিসির যদি এই কো-অর্ডিনেশন ঠিকভাবে থাকত, তাহলে তারা সেখানকার ফ্রিকোয়েন্সি বাড়তে দিত না, হয় লোড বাড়িয়ে দিত, না হয় ৪ ইউনিটের মধ্যে ১ ইউনিটের লোড কেটে দিত।'
Comments