‘এখন চক্রাকারে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়তেই থাকবে’

গত বছরের ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। এরপর গত ২১ নভেম্বর পাইকারি ও ১২ জানুয়ারি ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির সপ্তাহের ব্যবধানেই ১৮ জানুয়ারি বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। গ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও বাড়বে। ফলে বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়ানোর খবর এখন আলোচনায়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ— এগুলো একটি অপরটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটির দাম বাড়লে অপরটির দাম বাড়বেই। এই অপরিকল্পিত ও অযৌক্তিক দামবৃদ্ধির বোঝা দিনশেষে জনগণকেই বইতে হয়। আর ভর্তুকি কমাতে সরকার এখন যা করছে, তা দেশের অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড আঘাত সৃষ্টি করবে।

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ভবিষ্যতে চক্রাকারে আরও বাড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম

তিনি বলেন, 'যখনই গ্যাসের দাম বাড়ালো, তখনই আমরা বলেছিলাম, বাংলাদেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের ৬০ শতাংশই গ্যাসভিত্তিক হওয়ায় গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও আবার বাড়ানো হবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে যখন নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ালো, সেটা তো তারা শুধু একটা পরীক্ষা করল। গত সপ্তাহে যখন গ্যাসের দাম বাড়াল, তখন তো ধরেই নেওয়া হয়েছে যে বিদ্যুতের দাম আবার বাড়াবে। এগুলো তো একটা চেইন। এখন বেশি দামে গ্যাস কিনে তো অল্প দামে বিদ্যুৎ দিতে পারবে না। সামনে আবার জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম বাড়াবে, এরপর আবার বিদ্যুতের দাম— এটা আসলে বাড়তেই থাকবে। পুরো বিষয়টি এখন একটি চক্রের মতো ঘুরে ঘুরে চলবে। মানুষ ইতোমধ্যে অতিষ্ঠ, সামনে আরও অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে সব। আমি জানি না সরকার কেন এগুলো এভাবে করছে।'

তড়িঘড়ি করেই সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে উল্লেখ করে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, 'এমনিতেই তো সংকট চলছে, মানুষ কষ্টে আছে। যদি সরকার মনে করে যে দাম বাড়াতেই হবে, তাহলে একটু রয়ে-সয়ে ধীরে ধীরে সহনীয় পর্যায়ে রেখে মূল্য সমন্বয় করা যায়। যাতে জনগণের ওপর এভাবে আঘাত না আসে। এরকম নীতিই তো তাদের নেওয়া উচিত ছিল। এই যে রেকর্ড পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি, সেটা অসহনীয়। কোনো জনবান্ধব সরকার এভাবে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি করতে পারে না।'

এসব খাতে আমাদের কোনো সঠিক পরিকল্পনা নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম আরও বলেন, 'এভাবে মূল্যবৃদ্ধি অপরিকল্পিত, অবিবেচনাপ্রসূত। যুক্তিসঙ্গত উপায়ে কাজগুলো করা হচ্ছে না। অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে। সঠিক কোনো পরিকল্পনা নেই বলেই এভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে।'

গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম

তিনি বলেন, 'গ্যাসের যে গড় ক্রয়মূল্য, তার তুলনায় অনেক বেশি দাম বাড়ানো হয়েছে। এই অতিরিক্ত দাম বাড়ানোর ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটে উৎপাদন খরচ প্রায় ১ টাকা বেড়ে যাবে। আমরা আগেই আশঙ্কা করেছিলাম, গ্যাসের দাম বাড়ালে বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়বে খরচ সমন্বয়ের জন্য।'

'আমাদের পুরো অর্থনীতিই ভর্তুকির মধ্যে ছিল। সরকার এখন হঠাৎ করে প্রায় শূন্য ভর্তুকির দিকে যাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড আঘাত সৃষ্টি করবে। ভর্তুকির কারণে এ দেশের গ্যাস-বিদ্যুৎ নির্ভর অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের দাম প্রতিযোগিতামূলক ছিল। দাম বাড়ানোর পর এই দাম কতটা প্রতিযোগিতামূলক থাকবে, যেমন সেটা দেখার বিষয়; তেমনি বাজারে এর কতটা প্রভাব পড়বে, কী পরিমাণ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, কী পরিমাণ বেকারত্ব তৈরি হবে, সেটাও দেখার বিষয়', বলেন তিনি।

আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হবে উল্লেখ করে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, 'আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক বলে, এই ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের—নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত—সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে এবং সাহায্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত এই গোষ্ঠীর কাছে নগদ অর্থ সহায়তাও পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। কাদেরকে নগদ সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন সেটাও জানা থাকতে হবে, এর ডেটাবেজ থাকতে হবে। সেই ব্যবস্থা না নিয়ে হঠাৎ করে ভর্তুকি উঠিয়ে নেওয়ায় একটি বিরাট সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে বলে আমার ধারণা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র ও মধ্যম শিল্পগুলো। তাদের উৎপাদন কমে যাবে, মূল্য বৃদ্ধি হবে। যত মূল্যবৃদ্ধি হবে, তত ক্রেতা কমবে। কারণ, বাড়তি খরচ ক্রেতা যতটা সম্ভব কমাতে চাইবে, ইতোমধ্যেই যা শুরু হয়ে গেছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে পুরো অর্থনীতিতে একটি প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতির বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন দেখতে পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে, এরই মধ্যে এই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।'

'আমাদের দেশে ভর্তুকি ছিল সার্বজনীন। এ বিষয়ে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মত হচ্ছে, যাদের ভর্তুকির প্রয়োজন নেই, তাদেরকে ভর্তুকি দেওয়ার দরকার নেই। তারা মূলত সার্বজনীন ভর্তুকির বিপক্ষে', যোগ করেন অধ্যাপক ড. ম তামিম।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh exports to EU

RMG exports to EU rise by 2.99% in Jan-Nov

In the 11 months, Bangladesh shipped garments worth $18.15 billion, second highest after China

1h ago