খুলনার কয়রায় বেড়িবাঁধে ভাঙন, আতঙ্কে স্থানীয়রা
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আজ সোমবার মধ্যরাত থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাবে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় 'সিত্রাং'র প্রভাবে উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে দমকা হাওয়া বইছে। নদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ার থেকে এক থেকে দেড় ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে।
খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগরের অন্তত ৫৩টি স্থানে বাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় অধিকাংশ স্থানীয় মানুষ আতঙ্কিত রয়েছেন। বিশেষ করে খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দারা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।
খুলনার কয়রা উপজেলার গাতিরঘের এলাকার বাসিন্দা গৌতম রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে আছি আমরা। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। ইয়াসের পরে যেসব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলাম আবার সেই বিপদে পড়বো।'
তিনি আরও বলেন, 'কোনো রকমে ধার-দেনা করে ৩ বিঘা ঘের করেছি, কিছু সাদা মাছ আর চিংড়ি আছে সেখানে। সেসব ভেসে গেলে পথে বসা ছাড়া উপায় থাকবে না।'
ওই এলাকার অপর বাসিন্দা সাধন সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় ২ বছর পানিবন্দি ছিলাম আইলার সময়। আম্পান ও ইয়াসেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কিছুদিন আগে বাঁধ সংস্কার করা হয়েছে, কিন্তু সাকবাড়িয়া নদীতে তা আবার বিলীন হয়ে গেছে। খুব আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি আমরা।'
খুলনার কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়রার হরিণখোলা ও গাতিরঘেরীর বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের নিয়ে মেরামতের কাজের প্রস্তুতি চলছে। নদীতে জোয়ার শুরু হওয়ায় সবাই ভয় ও আতঙ্কে রয়েছেন।'
তিনি বলেন, 'একটু জোরে বাতাস হলেই অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো আর টিকিয়ে রাখা যাবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'কয়রায় হোগলা, দশহালিয়া, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট, ঘাটাখালী, গাববুনিয়ার, আংটিহারা, ৪ নম্বর কয়রা সুতির গেট ও মঠবাড়ির পবনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।'
খোলার কয়রা উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. রোকুনুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের বলা হয়েছে, স্ব স্ব এলাকার বাঁধের দিকে খেয়াল রাখার জন্য। কয়রায় ১১৭টি সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।'
জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা রঞ্জিত কুমার বলেন, 'খুলনার ৪টি উপজেলায় ৩০ মেট্রিক টন চাল, ৫ লাখ টাকা ও ১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ইতোমধ্যেই পাঠানো হয়েছে।'
স্থানীয়দের সাইক্লোন সেন্টারে আনার জন্য কাজ করছেন ৫ হাজার ২০০ স্বেচ্ছাসেবক।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুইচগেটগুলো দীর্ঘদিন সংস্কার না করায়, তা পানির সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে বৃষ্টির পানি আটকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে এবং আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে মোট ১ হাজার ৯১০ কিলোমিটার। যার অধিকাংশ ষাটের দশকে নির্মাণ করা। তারপর শুধু এই বাঁধ সংস্কার করা হয়েছে, কিন্তু পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। জিও ব্যাগ ও বালুর বস্তার রিং বাঁধ দিয়ে কোনো রকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত এসব বেড়িবাঁধ।
খুলনার দাকোপ উপজেলার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৩২ নম্বর পোল্ডারের ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও ২ কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। সেই কাজ শেষ হওয়ার আগেই আবার নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। একই বাঁধ সংস্কারে প্রায় ১৫২ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে পাউবোর পক্ষ থেকে।
জানতে চাইলে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পটি ২০১৩ সালের দিকে সার্ভে হয়েছে। তখন ২ কিলোমিটার নদীশাসনের কথা বলা হয়েছে, যা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে নদীর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে। ফলে আরও ৬ কিলোমিটার জায়গা নদীশাসনে আনা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে প্রায় ১৫২ কোটি টাকা ব্যয় হবে।'
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি এড়াতে জেলার ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ জনের জন্য ৪০৯টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে দাকোপে ১১৮টি, বটিয়াঘাটায় ২৭টি, কয়রায় ১১৭টি, ডুমুরিয়ায় ২৫টি, পাইকগাছায় ৩২টি, তেরখাদায় ২২টি, রূপসায় ৩৯টি, ফুলতলায় ১৩টি ও দিঘলিয়ায় ১৬টি।
খুলনার জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, 'উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিশেষ কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। যারা ঝুঁকির মধ্যে আছে, তাদের যাতে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া যায় সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।'
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২টি বিভাগের আওতাধীন প্রায় ৭৮০ কিলোমিটার। শুধু সাতক্ষীরার উপকূলে এসব বাঁধের মধ্য ৩৫ পয়েন্টের প্রায় ২০০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এসব বেড়িবাঁধ ভাঙনের আতঙ্কে রয়েছে উপকূলের মানুষ।
সাতক্ষীরা শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জি এম মাছুদুল আলম বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, আম্পান ও ইয়াসের গাবুরার কপোতাক্ষ নদের ২৭ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ২১ কিলোমিটারই ধসে গেছে। কোনো রকমে জোড়া তালি দিয়ে তা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারিভাবে বাঁধ সংস্কারের কাজ এখনো শুরু হয়নি।'
এ ছাড়া, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের ১ হাজার ৬৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্ত হয়। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে উপকূলীয় ১০ জেলার ৪৭৮ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে বিলীন হয়ে যায়, আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৭৮ কিলোমিটার।
এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে। সবশেষ ২০২০ সালের ২০ মে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এ সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন।
Comments