মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাটের রফিক বাহিনী
(১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা বাংলাদেশে একাধিক আঞ্চলিক বাহিনী গড়ে উঠেছিল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত বাহিনীর প্রশিক্ষিত ও সাব সেক্টরের অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ঠিক তেমনি আঞ্চলিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে অসীম বীরত্ব দেখিয়েছেন। বিজয়ের মাসে আমরা তুলে ধরছি ১০টি বাহিনীর কথা। দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে রফিক বাহিনীর অনন্য বীরত্বগাঁথা।)
মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাট শহরের ভৈরব-দড়টানা নদীর অপর পাড়ে চিরুলিয়ার বিষ্ণুপুরে গড়ে উঠেছিল দুর্ধর্ষ এক গেরিলা বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির অনুসারীদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনী পরবর্তীতে পরিচিতি পেয়েছিল রফিক বাহিনী নামে।
স্বরোচিষ সরকার রচিত 'একাত্তরের বাগেরহাট মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস' গ্রন্থ ও শাহাদত হোসেন বাচ্চুর লেখা 'চিরুলিয়া বিষ্ণুপুরের মুক্তিযুদ্ধ' থেকে জানা যায়, 'সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাগেরহাটের ১৫০ কিলোমিটার এলাকা শত্রুমুক্ত রাখতে পেরেছিলেন রফিক বাহিনীর সদস্যরা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত হলেও একপর্যায়ে রফিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল অন্তত পাঁচশ জন।
রফিক বাহিনী নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরির কাজে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাগেরহাট সদর, চিতলমারী, ফকিরহাট সফর করেন এই প্রতিবেদন। এ সময়ে রফিক বাহিনীর অন্তত ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয়।
রফিক বাহিনীর একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একাত্তরের মার্চের আগে থেকেই রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ বাগেরহাট শহরে ও চিরুলিয়ার বিষ্ণুপুরে গোপনে সংগঠিত হয়েছিল। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি গ্রুপের সদস্যরা সম্ভাব্য জনযুদ্ধের জন্যও প্রস্তুতি নিয়েছিল।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার সংবাদ পাওয়ার পর বাগেরহাট শহর ছেড়ে দলটির সব সদস্যই বিষ্ণুপুরে অবস্থান নেয়। এ প্রসঙ্গে রফিক বাহিনীর নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা জুবায়ের নোমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওই এলাকায় আমরা পূর্বে কৃষক সমিতির রাজনীতি করায় সবার মাঝেই পরিচিত ছিলাম। ফলে ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পরপর রফিক ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা পাকাপাকিভাবে বিষ্ণুপুরে চলে যাই।'
একটামাত্র রিভলবার
শাহাদত হোসেন বাচ্চুর লেখা 'চিরুলিয়া বিষ্ণুপুরের মুক্তিযুদ্ধ' বই থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা আসাদের সংগৃহীত একটি রিভলবার ছিল বাহিনীর প্রথম ও একমাত্র অস্ত্র।
রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই খুলনার বড়বাজারে অস্ত্রের দোকান লুট করে সাধারণ মানুষ। ভাগ্যক্রমে আমি তখন খুলনায় চাচার বাসায়। লুটের খবর পেয়ে আমিও গেলাম। পথে দেখা হলো আমাদের গ্রামের এক পূর্বপরিচিতের সঙ্গে। তিনি খালিসপুরের একটি মিলে কাজ করতেন। তার হাতে রিভলবার দেখেই আমি বললাম, 'তুমি আমাকে এটা দিয়ে দাও আমার কাজে লাগবে।' কিন্তু সে দেবে না। এদিকে আমার হাতে টাকাও নেই যে আমি বিনিময় পরিশোধ করব। শেষে আমার হাতে থাকা দামি সিটিজেন ঘড়ি অদল-বদল করে রিভলবারটি নিয়ে নিলাম। তখন এটাতে কোনো গুলি ছিল না।'
মুক্তিযোদ্ধা আসাদের সংগৃহীত রিভলবারটি ছাড়াও এপ্রিল মাসের শেষদিকে নানাভাবে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করেন রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। ২৭ এপ্রিল রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহরের ফাইন আর্ট প্রেসের সামনে টহলরত চার পুলিশ ও দুই আনসার সদস্যের কাছ থেকে ছয়টি রাইফেল ছিনিয়ে নেন। পরবর্তীতে মে মাসে ফজলুল হক খোকনের নেতৃত্বে অস্ত্রাগার লুটের ১৯টি রাইফেলও পেয়েছিলেন রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।
রফিক বাহিনীর অন্যতম সদস্য আলী আহসান খসরু ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রাথমিকভাবে অস্ত্র জোগাড়ের পর আমরা বিভিন্ন থানা আক্রমণ, রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণের মাধ্যমে অস্ত্রের জোগান পাই। পরবর্তীতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধেও আমাদের বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করি। অস্ত্রের ঘাটতি দূর করার জন্য আমরা এক ধরনের পাইপ বোমাও তৈরি করতাম।'
পুরো মুক্তিযুদ্ধকালেই রফিক বাহিনীর সদর দপ্তর বিষ্ণুপুরের খালিশপুর গ্রামে। এছাড়া সন্তোষপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চিতলমারী ইউনিয়নের সুড়িগাতী গ্রামে রফিক বাহিনীর আরও দুটি ঘাঁটি ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে ২৫টিরও বেশি সফল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসব যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়েছিল।
প্রথম অপারেশন
মুক্তিযুদ্ধের রফিক বাহিনীর প্রথম অপারেশন ছিল ৩০ এপ্রিল বাগেরহাট সদর থানা আক্রমণ। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বিষ্ণুপুর ক্যাম্প ছেড়ে বাগেরহাট শহরে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ অজিয়র রহমান। তখন পাকিস্তানি বাহিনী তাকে আটক করলে তাকে উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেয় রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।
অজিয়র রহমানকে মুক্ত করার লক্ষ্যে রফিক বাহিনী, সোহরাব হোসেন ও কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে দুটি গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা থানায় আক্রমণ চালাবে, অন্যদিকে টুকু ও সোহরাব গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা হাজত থেকে অজিয়র রহমানকে মুক্ত করবে।
৩০ এপ্রিল রাতে রফিক বাহিনীর থানা আক্রমণের পাশাপাশি টুকু গ্রুপ জেলখানা আক্রমণ করলে পাকিস্তানিরা জেলখানার পার্শ্ববর্তী ট্রেজারি আক্রান্ত হয়েছে ভেবে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এসময় দুই পুলিশ ছাড়াও টুকু গ্রুপের দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরবর্তীতে পাকিস্তানি সেনারা অজিয়র রহমানকে খুলনা নিয়ে হত্যা করে।
গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই রূপসা থেকে বাগেরহাটগামী রাজাকারদের বহনকারী একটি বিশেষ ট্রেনে আক্রমণ চালিয়েছিলেন রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এতে পঞ্চাশ জনের বেশি রাজাকার হতাহত হয়। অপারেশন শেষে রফিক বাহিনী প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেয়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রফিক বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল মাধবকাঠির যুদ্ধ।
১ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা বিষ্ণুপুর গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার দুই সহোদরকে হত্যা করে সমস্ত গ্রামে আগুন দেয়। তখন স্থানীয় জনগণকে সংগঠিত করতে ব্যাপক প্রচারণা চালান রফিকুল ইসলাম। রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন বলেন, '৬ তারিখে মিলিটারি ও রাজাকারেরা মাধবকাঠি মাদ্রাসায় অবস্থান নিলে পরদিন রাত ১২টায় আমরা দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা মাদ্রাসার চারপাশ ঘেরাও করে আক্রমণ শুরু করি। ৮ তারিখ দুপুর পর্যন্ত ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে তারা টিকতে না পেরে পিছু হটে লঞ্চে করে নদী পথে পালিয়ে যায়।'
এই যুদ্ধে ৩ জন পাকিস্তানি সেনা ও ১৬ জন রাজাকার নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে রফিক বাহিনীর অস্ত্রের সংকট প্রকট হলে পাকিস্তানিদের একের পর এক আক্রমণে অসহায় হয়ে পড়েন রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এমতাবস্থায় ২৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মানস ঘোষের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য রওনা হন রফিকুল ইসলাম। ভারত সীমান্তের কাছে অস্ত্র সংগ্রহের পরিকল্পনা থাকলেও পথিমধ্যে পাকিস্তানিদের আক্রমণে আহত হন রফিকুল ইসলাম। একই দিন দেবীবাজারের কাছে রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে তিন পাকিস্তানি সেনা ও পাঁচ রাজাকার নিহত হয়।
আগস্ট মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী রফিক বাহিনীর সন্তোষপুর ক্যাম্প পুড়িয়ে দেয়। ৩০ আগস্ট আহত অবস্থাতেই বাহিনী পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন রফিকুল ইসলাম।
অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই
সেপ্টেম্বরের শুরুতে চিরুলিয়া বিষ্ণুপুরের ক্যাম্পগুলো ধ্বংসের লক্ষ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর যাত্রাপুর ইউনিয়নের পানিঘাট এলাকায় জড়ো হতে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। যা রফিক বাহিনীর কাছে ছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা এসময় ভৈরব নদীর দুইশ গজ দূরত্বের মাঝে নদীর বাঁকের দুদিকেই বাঙ্কার খুঁড়ে প্রতিরক্ষা লাইন নির্মাণ করে অবস্থান নেয়। রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ শেখ বলেন, 'আমরা প্রতি বাঙ্কারে দুজন করে ছিলাম। মিলিটারি যখন লঞ্চ নিয়ে গুলি করতে করতে আমাদের সামনে এগোতে লাগলো তখন আমরা গুলি শুরু করলে লঞ্চের সারেং মারা যায়। তলা ফুটো হয়ে লঞ্চ চারদিকে ঘুরতে থাকে। গুলিতে মিলিটারির পাশাপাশি বহু রাজাকারও মারা যায়।' এমতাবস্থায় সড়কপথে পাকিস্তানি সেনারা অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে কারফিউ জারি করে ১৬ জন পাকিস্তানি সেনার লাশ উদ্ধার করে পাকিস্তানি বাহিনী।
১৩ সেপ্টেম্বর দোপাড়া ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রফিক বাহিনীর যুদ্ধে তিন জন পাকিস্তানি সেনা ও পাঁচ রাজাকার নিহত হয়। যুদ্ধে রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা বিজয় পাল শহীদ হন।
৩০ অক্টোবর বাগেরহাট সদরের গোটাপাড়া ইউনিয়নের বাবুরহাট বাজারে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে রফিক বাহিনীর যুদ্ধে এক ক্যাপ্টেনসহ চারজন পাকিস্তানি সেনা ও তিন রাজাকার নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ নভেম্বর বাবুরহাটের আরেকটি যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচ সেনা ও বহু রাজাকার নিহত হয়। ওই যুদ্ধ প্রসঙ্গে রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা তফসির উদ্দিন শেখ বলেন, 'সে যুদ্ধ বেশিক্ষণ না হলেও পাকিস্তানি মিলিটারির প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। 'বাবুরহাটের এই যুদ্ধটিই ছিল রফিক বাহিনীর সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়জুড়েই রফিক বাহিনীর নিজস্ব গঠনতন্ত্র বজায় ছিল। রফিকুল ইসলাম ছিলেন বাহিনী প্রধান, বাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন শেখ আনিসুর রহমান। বাহিনী প্রধান রফিকুল ইসলাম মারা যান ২০০১ সালের ২৪ অক্টোবর, শেখ আনিসুর রহমান মারা যান ২০০৮ সালের ২১ মে।
Comments