মূল্যস্ফীতি কমানোর যুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক

সংস্কার কমিশন
স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল মঙ্গলবার নীতি সুদহার বা রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করেছে। বাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের ক্রমবর্ধমান দাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাথাব্যথা কারণ হয়ে ওঠায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই হার বাড়ানো হলো।

আগস্টে আহসান এইচ মনসুর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উদ্যোগগুলো নিয়েছেন তার মধ্যে একটি এটি। এর ফলে, বাংলাদেশে বহু বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো রাতারাতি নীতি সুদহার মূল্যস্ফীতির হারকে ছাড়িয়ে গেছে।

আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর তৃতীয়বারের মতো নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। এমনকি গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, কার্যকরভাবে অর্থের প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে নীতি সুদহার দুই অংকের ঘরে নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে অটল থাকার বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ খরচ হলে তা অর্থনীতিতে চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সময়ও ব্যাংকগুলোকে বেশি সুদ দিতে হবে। ফলে, গ্রাহকদেরও বেশি সুদে ঋণ নিতে হবে।

পণ্যের দামে লাগাম দিতে অর্থনীতিতে সামগ্রিকভাবে অর্থ সরবরাহ কমানোর জন্য নীতি সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন হয়। এর ফলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগে বিলম্ব বা কমতে পারে এবং ভোক্তারা ব্যয় কমাতে পারে। তবে, এর ফলে স্বল্পমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে।

বাংলাদেশ ২০২২ সালের মে থেকে ১১ বারের মতো নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর চেষ্টা জোরদার করছে। কিন্তু প্রকৃত নীতি সুদহার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য করায় নেতিবাচক রয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বশেষ ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ এবং আমানতে সুদহার আট শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে আট শতাংশ করেছে। নতুন এই হার ২৭ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে।

গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে কমে নয় দশমিক ৯২ শতাংশ হয়েছে। তারপরও মূল্যস্ফীতির এই হার উদ্বেগজনক, বিশেষ করে নিম্ন আয় ও নির্দিষ্ট পরিমাণ অল্প বেতনে সংসার চালানো মানুষের জন্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, দেশীয় পণ্যগুলো মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ, যা সেপ্টেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হারের ৭৪ শতাংশ। এই হার গত জুনেও ছিল ৬১ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতিতে আমদানিনির্ভর পণ্যের অবদান জুনে ছিল ৩৯ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

নীতি সুদহার বাড়ানোই একমাত্র সমাধান নয়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলেও এটি একমাত্র সমাধান নয়। মূল্যস্ফীতি চাপ কার্যকরভাবে কমানোর জন্য অন্যান্য বিষয়গুলোকে একযোগে মোকাবিলা করতে হবে।

তাদের মতে, সরবরাহ চেইনে গতিশীলতা এবং কার্যকরভাবে উৎপাদন খরচ ও দেশীয় বাজার ব্যবস্থাপনাও মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অপরিহার্য বিষয়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু মুদ্রানীতিই যথেষ্ট নয়। কারণ, আমাদের দেশে অন্যান্য বিষয়ও কাজ করছে। এখানে আর্থিক নীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেগা প্রকল্পের বিভিন্ন খরচ—যেমন: অপারেশনাল খরচ ও প্রশাসনিক খরচ—অতিরিক্ত খরচের উদাহরণ। আমাদের এসব জায়গাতেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।'

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, 'ভারত ও শ্রীলঙ্কা গত দুই বছরে যেভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, সেটা বিবেচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, তারা একটি অর্থোডক্স মুদ্রানীতি অনুসরণ করেছে। নীতি সুদহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে এবং সেটা কাজ করেছে।'

তিনি বলেন, 'আমরাও যদি একটি কঠোর মুদ্রানীতি নেই এবং প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের চেইনে বাধাগুলো দূর করতে পারি, তাহলে আমি আশাবাদী যে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমবে।'

তার ভাষ্য, 'বৃহত্তর সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা উচিত, যা মধ্যমেয়াদে সবার জন্যই উপকারী হবে।'

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন বলেছেন, 'আমি মনে করি, এটা অতি-কড়া মুদ্রানীতি হতে যাচ্ছে। এর ফলে সুদের হার আরও বেড়ে যাবে, বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে।'

তিনি বলেন, 'মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান কমাতে হবে এবং পরিবহন খরচ ও বাজারের অব্যবস্থাপনা কমাতে হবে।

'অন্যান্য এসব ব্যবস্থা একযোগে না নিলে শুধুমাত্র নীতি সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কার্যকর হবে না। বরং এটি মাঝারি থেকে দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির গতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে,' যোগ করেন তিনি।

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'মূল্যস্ফীতি খুব একটা না কমলেও নীতি সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।'

তার ভাষ্য, 'শুধু নীতি সুদহারই বাড়ানো হয়নি, আর্থিক নীতির সমন্বয়ও করা হয়েছে। এডিপি খরচ কমানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপছে না এবং সরকারকে ঋণও দিচ্ছে না।'

এসব উদ্যোগের ফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করেন এই গবেষক।

তিনি বিশ্বাস করেন, নীতি সুদহার বেশি রেখে প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল স্বাভাবিক রাখার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

সম্প্রতি সরকার চাল, গম ও ডিমের মতো কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে এবং ভর্তুকি হারে কিছু মূল পণ্য বিক্রি শুরু করেছে।

সিপিডির ফাহমিদা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক এবং স্থানীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বাজারের সিন্ডিকেট বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

তার মতে, বাণিজ্য নীতির পুনর্বিন্যাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যকারিতা অবশ্যই বাড়াতে হবে।

তিনি সরবরাহ ও চাহিদার বিষয়ে সঠিক তথ্যের ওপর জোর দিয়ে বলেন, 'বাজারের গতিশীলতা বোঝার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ।'

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'নীতি সুদহার যখন বাড়ানো দরকার ছিল আগের সরকার সেটা করেনি। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।'

তিনি যুক্তি দেন, শুধুমাত্র নীতি সুদহার বাড়ালেই হবে না। কারণ, শুধুমাত্র এই ব্যবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে চাইলে তার জন্য দীর্ঘ সময় লাগবে।

কার্যকরভাবে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পণ্যের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

রায়হান আরও বলেন, 'বাজারে প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক; বাণিজ্য, অর্থ ও খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করলে তাদের প্রচেষ্টা আরও কার্যকর হবে।'

তিনি বলেন, 'এই সমন্বিত পদ্ধতি ছাড়া মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে থাকবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Constitution should be updated

Dr Kamal Hossain, emeritus president of Gono Forum, yesterday recommended updating the constitution.

20m ago