পথ দেখানো কৃষি উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ

ছবি: স্টার

করোনা মহামারির শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পর বাড়ি ফিরে আসেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ।

কিন্তু, সে সময়টা অলস বসে থাকতে চাননি তিনি। তাই বাবার কাছ থেকে স্কোয়াশ চাষের জন্য একখণ্ড জমি চেয়ে নেন শাকিল।

চাষে আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করায় প্রথম দফায় স্কোয়াশের ফলনও হয়েছিল প্রচুর।

এরপর তিনি আরও বেশি জমিতে শসা ও তরমুজসহ অন্যান্য ফল ও সবজি চাষ করেন। এ দফাতেও প্রত্যাশিত ফল আসে। তাতে অবাক হন গ্রামের অন্যান্য কৃষকরা। তারা কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে শাকিলের পরামর্শ নিতে শুরু করেন।

ছবি: স্টার

বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ২৬ বছরের এই যুবক টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার গামজানী গ্রামে অন্যান্য কৃষকদের আধুনিক কৃষি পদ্ধতির পাঠ দিচ্ছেন। শেখাচ্ছেন, কীভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কম খরচে বেশি ফসল উৎপাদন করা যায়।

সেই সঙ্গে শাকিল নিজেও পড়ালেখার পাশাপাশি নিজ গ্রামের পৈতৃক জমিতে বিভিন্ন সবজি ও ফলের আবাদ করে চলেছেন।

কৃষিক্ষেত্রে শাকিলের সফলতা এখন অনেক তরুণের অনুপ্রেরণা। তেমন একজন হলেন একই গ্রামের জাহিদুর রহমান। মহামারির সময় মালয়েশিয়া থেকে ফিরে এসে অনেকদিন বেকার বসে ছিলেন তিনি। কিন্তু, জাহিদের সাফল্য তাকে নতুন করে পথ দেখায়।

জাহিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শাকিলের পরামর্শে ও দেখিয়ে দেওয়া কৌশল অনুসরণ করে আমি স্কোয়াশ চাষে ভালো ফল পেয়েছি। তিনি আমাকে দেখিয়েছেন কীভাবে ধানের পরিবর্তে গম বা ভুট্টা চাষ করেও আমি বেশি লাভবান হেতে পারি।'

ছবি: স্টার

প্রতিদিন নিজের জমির কাজ শেষে শাকিল গ্রামের কৃষকদের খেত ঘুরে দেখেন। তার চোখে ধরা পড়ে, কৃষি বিভাগের মাঠকর্মীরা কৃষকদের ঠিকঠাক সহযোগিতা করতে পারছে না। তাই কৃষকরা নিজেরা যা ভালো বুঝছেন, তাই করছেন। 

এ পর্যায়ে শাকিল স্থানীয় কৃষকদের দেখান কীভাবে খুব সহজে আধুনিক মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব। তখন গ্রামের অনেক কৃষক এই পদ্ধতিটি তাদের নিজেদের জমিতে ব্যবহারের উৎসাহ দেখান।

শাকিলের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে পাশের সিলিমপুর ও নাল্লাপাড়া গ্রামের তরুণ কৃষক সোহেল এবং সজীব তাদের জমিতে তরমুজ ও স্কোয়াশ চাষ করে লাভবান হন।

গমজানী গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি জমিতে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে শাকিল আমাকে দেখিয়ে দেন কীভাবে ভুট্টার সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে আলু চাষ করতে পারি। পরে একই জমি থেকে ভুট্টার পাশাপাশি প্রায় ৫০ মন আলু পেয়েছি।'

শাকিলের ভাষ্য, 'কৃষকরা আমাদের দেশের প্রাণ। তারা অনেক পরিশ্রমী, একইসঙ্গে অবহেলিত। আমাদের মাটি অনেক উর্বর হওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ কৃষক এখনো পুরনো পদ্ধতিতেই চাষাবাদ করে থাকেন। অথচ আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি কত এগিয়ে গেছে।'

ছবি: স্টার

শাকিল আরও বলেন, 'এখনো অনেক কৃষক জানেন না যে, কখন কোন জমিতে কী চাষ করলে ফলন আর লাভ দুটোই বেশি হয়। অনেকেই জানে না, কোন জমিতে সার বা কীটনাশক কীভাবে বা পরিমাণে কতটা ব্যবহার করতে হয়।'

'এসব ক্ষেত্রে বাজারের সার বা কীটনাশক ব্যবসায়ীরা তাদের যেভাবে পরামর্শ দেন, তারা সেই অনুসারে কাজ করেন। অনেক সময় তাদের হাতে টাকা থাকে না। সময়মতো বীজ, সার ও কীটনাশক সংগ্রহ করতে পারেন না। সময়মতো এগুলো কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া ছাড়াও সরকারের কৃষি বিভাগের তাদের জন্য আরও অনেক কিছু করার আছে। আমি মূলত কৃষকদের এ বিষয়গুলো বোঝানোর চেষ্টা করি,' যোগ করেন তিনি।

কৃষিকাজে শাকিলের সাফল্য এলাকায় সাড়া জাগানোর পর তা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাদের নজরে আসে। কর্মকর্তারা মাঠ পরিদর্শনে এসে তার কাজের প্রশংসা করেন, উৎসাহ দেন। আশ্বাস দেন আর্থিক সহযোগিতার।

ছবি: স্টার

এ বছর শাকিল তার জমিতে আবাদ করেছেন ২ জাতের তরমুজ- রক মেলন ও হানি মেলন। ফলনও হয়েছে খুব ভালো। ক্রেতারা জমি থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এই ফল। ফসল তুলতে শুরু করার ২ দিনের মধ্যে তিনি ৪০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন।

শাকিল জানান, একেকটি রক মেলনের ওজন দেড় থেকে আড়াই কেজির মধ্যে হয়। হানি মেলনের ওজন ১ থেকে ২ কেজির মধ্যে। জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এগুলো বেশ জনপ্রিয়। বীজ বপন থেকে ফল পরিপক্ক হতে ৭৫ থেকে ৮০ দিন সময় লাগে।

শাকিলের কাছ থেকে জানা যায়, রক মেলন ও হানি মেলন মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত এবং মধ্য জুন থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর (আষাঢ়-ভাদ্র) মাসে চাষ করা যায়। বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি থেকে বাঁচাতে পলি টানেল বা পলি হাউজ করলে খুব ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।

এ ছাড়া, বছরের প্রায় পুরো সময়ে গ্রিন হাউজে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেও চাষ করা সম্ভব এই ফল।

ছবি: স্টার

এই ফল চাষের বিষয়ে আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে শাকিল বলেন, 'উচ্চমূল্যর সুস্বাদু এই ফলটি বাংলাদেশে আমদানি করতে হয়। তাই দেশেই এর উৎপাদন নিশ্চিত করে আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য আমি এই চাষের উদ্যোগ নেই। এখন আমি এই ফল চাষাবাদের পদ্ধতি দেশের প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। যাতে করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে আমরাও এই ফল বিদেশে রপ্তানি করতে পারি।'

এই দিক থেকে শাকিল নিজেকে অনেকটা সফল বলে দাবি করেন। বলেন, 'যেসব প্রবাসীরা আমার উৎপাদিত ফল খেয়েছেন, তাদের মধ্যে চাহিদা তৈরি হয়েছে। তারা সরাসরি আমার জমিতে এসে উৎপাদিত ফল নিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে আমার এলাকার আশেপাশের কৃষকদের মধ্যেও আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে।'

এসব ফল ও সবজি চাষাবাদে শাকিল আগ্রহী কৃষকদের জন্য হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। পাশাপাশি, দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য নিজের একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন।

দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শোয়েব মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শাকিলের মতো শিক্ষিত তরুণরা কৃষিকাজে এগিয়ে আসলে দেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।'

Comments

The Daily Star  | English

US tariff at 20% 'satisfactory', says Khosru

Will comment after knowing full details of the deal

2h ago