সাঁওতালদের রক্তে ভেজা মাটিতে এখন সোনালি ধানের ফোয়ারা
মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া গ্রামের আদিবাসীদের অনেক পরিবার অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটিয়েছে। কিন্তু সেই চিত্র এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। পূর্ব পুরুষদের জমি উদ্ধারের যে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের বিপক্ষে ছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার। দীর্ঘ জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পতন হয়েছে সেই সরকারের।
কিন্তু, ভূমিতে আদিবাসী-বাঙালিদের সেই সংগ্রাম এখনও চলমান। সংগ্রামে গাইবান্ধার সাঁওতালরা পুরোপুরি সফল না হলেও দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বিনিময়ে যে ভূমি তারা দখলে নিয়েছে, সেই অনুর্বর জমিকে করে তুলেছে উর্বর। সেখানে এ বছর আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফসলের হাসিতে ঝলমল করছে গোটা সাঁওতালপল্লি।
গত ১০ নভেম্বর সাঁওতালপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রায় সবটুকু জমিতে হয়েছে আমন ধানের চাষ। পাশাপাশি কলা, লাউ, ভুট্টা, মরিচ, ফলজ গাছসহ সবধরনের শাকসবজি চাষে ব্যস্ত সেখানকার নারী-পুরুষ। কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর প্রায় এক হাজার ৬০০ একর জমিতে উফশী জাতের ধান লাগিয়েছেন তারা। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার ফলন হয়েছে প্রচুর।
পাকা ধানের সোনালী আভা যেন দোল খাচ্ছে হেমন্তের সকালে-বিকেলে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ বছর সাঁওতালপল্লিতে প্রায় এক লাখ মণ ধানের ফলন হবে।
এ বছর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ধানের যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে তুলনায় এই ধান নগণ্য হলেও অবহেলার মতো কিছু নয়। শুধু ধান নয়, সারা বছর এখন এই জমিতে বাহারি ফসল ফলছে। ঘরে ঘরে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলও পালন করছেন পল্লির বেশিরভাগ মানুষ। শনিবার হয়ে গেল তাদের নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের নানা পদের খাবার তৈরি হয়েছে। সেইসঙ্গে নতুন ফসল ঘরে তোলা উপলক্ষে হয়েছে সাঁওতালী নাচ-গান, সঙ্গে অতিথি আপ্যায়ন।
সাঁওতালদের সেই দুর্দিন হয়তো সহজে ভোলা যাবে না। ভোলা যাবে না তাদের আত্মত্যাগ। কিন্তু আপাতত অনেকদূর এগিয়েছে এই পল্লির অনেক ছেলে-মেয়ে। অনেকে স্কুল-কলেজে পড়ছে। অথচ আট বছর আগেও এই জমিতে আখ চাষ করে কোটি কোটি টাকা লোকসান করেছে রংপুর সুগার মিল। অন্যদিকে ফার্মে সাঁওতালদের গরু-ছাগল ঢুকলে তাদের মারধর করা হয়েছে। অনেক সময় দেওয়া হয়েছে সাঁওতালদের বিরুদ্ধে মামলা।
আমাদের স্মৃতি খুব বেশি ঝাপসা না হলে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মে কী হয়েছিল তা মনে থাকার কথা। সদ্য বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ (গাইবান্ধা-৪) এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও সাপমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুলের নেতৃত্বে সেদিন মাদারপুর-জয়পুরপাড়ার সাঁওতালদের ওপর নেমে এসেছিল পাশবিক নির্যাতন। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, রংপুর সুগার মিলের কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং বুলবুলের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনী হামলে পড়েছিল সাঁওতালপল্লির সংগ্রামী মানুষের ওপরে। গুলি করে এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল রমেশ টুডু, মঙ্গল মার্ডি এবং শ্যামল হেমব্রমকে।
শুধু তাই? ৬ ও ৭ নভেম্বর দুদিন ধরে লুটপাট করা হয় সাঁওতালপল্লি। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় পুলিশের পোশাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় সাঁওতালদের বাড়িঘর। সেই চিত্র পরে আলজাজিরার একটি প্রতিবেদনে আমরা সবাই দেখেছি।
সাঁওতালদের পূর্ব পুরুষদের এই জমি উদ্ধারের নেতৃত্ব দেওয়া সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে আজও ভুলতে পারেন না কীভাবে এই শাকিল আকন্দ বুলবুল ২০১৩ সালে স্থানীয় সাঁওতাল ও বাঙালিদের নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করে। শাকিল আকন্দ ছিলেন এই আন্দোলনের মধ্যমনি। তিনি ছিলেন সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি এবং ফিলিমন বাস্কে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।
কিন্তু ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সাঁওতালদের ভোটে সাপমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর বদলে যান বুলবুল। এরপর থেকেই সাঁওতালদের উচ্ছেদে যড়যন্ত্র করতে থাকেন।
গত আট বছরে হত্যার বিচারের দাবিতে শত শত আন্দোলন, প্রতিবাদ, সম্মেলন করেছে এই এলাকার আদিবাসী-বাঙালিরা। কিন্তু বিচারের নামে একটা প্রহসন দাঁড় করিয়েছিল আওয়ামী সরকারের স্থানীয় বিচার বিভাগ।
তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার এখন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। একটার পর একটা লোক দেখানো তদন্ত হয়েছে এবং হত্যা মামলার মূল ১১ আসামিকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অথচ মূল আসামিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিভাবে পদোন্নতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
মামলার মূল আসামি সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। সাঁওতালদের ওপর হামলাকারী শাকিল আকন্দ বুলবুল পরপর দুবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ বছর নাম পরিবর্তন করে শাকিল আকন্দ থেকে শাকিল আলম হন এবং গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে পরাজিত করে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনেও কেন্দ্র দখলে নিয়ে ভোট চুরির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর এসব কর্মকাণ্ডে তার মাথার ওপর হাত ছিল সাঁওতাল হত্যার প্রধান আসামি সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় বারবার বিচারিক কার্য পিছিয়ে গেছে। সাঁওতালদের আইনজীবীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই মামলার প্রথম চার্জশিট দিয়েছিল গাইবান্ধা পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)। পিবিআইয়ের দেওয়া চার্জশিটে এমপি আবুল কালাম আজাদসহ আরও ১০ জন মূল আসামির নাম বাদ দেওয়া হয়। পিবিআই যে অভিযোগপত্র দেয়, সেখানে ৯০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়, শাকিল আকন্দ বুলবুলের নাম রাখা হয় ৯০ নম্বরে।
সাঁওতালরা এই চার্জশিটে নারাজি দেয় ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। এর পর আদালত সিআইডিকে মামলাটি তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। সিআইডি পিবিআইয়ের চার্জশিট হুবহু নকল করে আদালতে জমা দেয় বলে অভিযোগ করেন সাঁওতালরা। ২০২১ সালের নভেম্বরে গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুনরায় নারাজি দাখিল করেন তারা।
এরপর থেকে আদালত বারবার শুনানির দিন ধার্য করেন। এভাবে কেটে যায় প্রায় সাড়ে তিন বছর। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর আদালত সাঁওতালদের নারাজি গ্রহণ করে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের মাধ্যমে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন গাইবান্ধার পুলিশ সুপারকে। গত আট বছর ধরে এভাবে ধুঁকে-ধুকে চলছে সাঁওতাল হত্যার বিচারকার্য। সাঁওতালরা বারবার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাইলেও অজ্ঞাত কারণে সেই আবেদনে সারা দেননি আদালত।
এ তো গেল সাঁওতাল হত্যা মামলার ইতিহাস। অন্যদিকে যে জমিতে সাঁওতালরা ফসল ফলাচ্ছে, সেই জমি নিয়ে বারবার হয়েছে ষড়যন্ত্র। জমি হারানোর ভয় সারাক্ষণ বিচলিত করছে সাঁওতালপল্লির এক হাজার ২০০ আদিবাসী পরিবারকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ইন্ধনে ২০১৯ সালের নভেম্বরে সরকার এখানে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল স্থাপনের ঘোষণা দেয়।
এরপরে স্থানীয় প্রশাসন শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সাঁওতালপল্লির এক হাজার ৮৩২ একর জমির মূল্য নির্ধারণ করে মাত্র ২১৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই টাকার বিনিময়ে শিল্প মন্ত্রণালয় বেপজাকে এই জমি হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু স্থানীয় আদিবাসী সাঁওতাল ও বাঙালিরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে। ফলে শেষ পর্যন্ত ঝুলে থাকে রংপুর ইপিজেড নির্মাণের কাজ। উন্নয়নবঞ্চিত এবং অবহেলিত উত্তরের জেলা গাইবান্ধায় অবশ্যই ইপিজেড লাগবে। কিন্তু সেটা সাঁওতালপল্লিতে কেন? এই জেলায় আরও অনেক জায়গা আছে, যেখানে ইপিজেড স্থাপন করা যায়। ওইসব এলাকার মানুষও চান যে তাদের এলাকায় ইপিজেড হোক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাঁওতালপল্লির এই এক হাজার ৮৪২ একর জমির বেশিরভাগ এখন চাষ করছে স্থানীয় বাঙালিরা। যেসব বাঙালিরা সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে জড়িত তারা তো চাষ করছেনই, যারা জড়িত ছিলেন না তারাও করছেন। প্রত্যেক পরিবারের পাঁচ বিঘা করে জমি চাষ করার কথা থাকলেও নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও গ্রুপিংয়ের কারণে কেউ এক বিঘা, আবার শক্তি, সামর্থ্য ও ক্ষমতা অনুযায়ী কেউ ৫০ বিঘাও চাষ করছেন। এমনকি পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, তিনজন সাঁওতাল এই জমি উদ্ধার সংগ্রামে প্রাণ দিলেও তাদের পরিবারের কোনো সদস্য পল্লিতে থাকেন না বলে এই জমির ভাগ পাননি এখন পর্যন্ত।
সাঁওতালদের এই জমি ফিরে পাওয়ার আন্দোলনের যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই লিখিত ও পঠিত হয়। চুক্তিপত্রে উল্লেখ আছে, এক হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর সম্পত্তি রংপুর সুগার মিলের ইক্ষু ফার্ম করার জন্য নেওয়া হলো। এই সম্পত্তিতে ইক্ষু চাষের পরিবর্তে যদি অন্য ফসল চাষ করা হয়, তাহলে অধিগ্রহণকৃত জমি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন সরকারের হাতে তুলে দিবে এবং সরকার তা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিবে।
রংপুর সুগার মিল অনেক দিন আগে থেকেই চুক্তি ভঙ্গ করে স্থানীয় চাষিদের জমি লিজ দেয় এবং চাষিরা আখ চাষ না করে অন্য ফসল ফলাতে থাকে। যার ফলে সাঁওতাল ও কিছু বাঙালি পরিবার এই জমি ফেরত পাওয়ার আন্দোলনে নামে।
সাঁওতালসহ সমতলের আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি, সরকার যেন তাদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করে। কিন্তু সেই দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান দেখায়নি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের আদিবাসীদের ভূমি, ভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য সংরক্ষণে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি কোনো সরকারই।
গত ৫৩ বছর ধরে এক ধরণের বৈষম্য দেখানো হয়েছে তাদের প্রতি। উত্তরবঙ্গে একাধিক জেলায় ভূমি ও ক্ষেতে সেচ সুবিধা পাওয়ার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন একাধিক সাঁওতাল। কিন্তু সেসব হত্যার একটিরও বিচার হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে যে সরকার এখন ক্ষমতায় আছে, যারা বিভিন্ন সংস্কারের কথা বললেন, তাদের উচিত আদিবাসীদের প্রতি হওয়া সব অন্যায়ের বিচার করা। আদিবাসীদের প্রতি যেসব বৈষম্য রয়েছে তা দূর করার উপযুক্ত সময় এখনই। এখনই সময় গাইবান্ধায় সাঁওতাল হত্যার বিচার করা এবং তাদের পূর্ব পুরুষদের জমি ফেরত দেওয়া।
ভূমিতে অধিকার কীভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে তার বাস্তব উদাহরণ হলো আজকের গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালপল্লি। জমি দখলে নিয়ে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে শুধুমাত্র কৃষিকাজ করে তারা নিজের উন্নতি ও জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। এই জমি ফেরত পেলে এবং সাঁওতাল হত্যার বিচার হলে তারা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।
মোস্তফা সবুজ, সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার
mostafashabujstar@gmail.com
Comments