বাস্তবের নায়ক গাইবান্ধার জোবায়ের

জোবায়ের রহমান জামিল। ছবি: সংগৃহীত

গাইবান্ধা এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী জোবায়ের রহমান জামিলের (১৮) নাম এখন সবার মুখে মুখে। সন্তানসহ এক গৃহবধূকে বাঁচাতে গিয়ে গতকাল সোমবার সকালে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যান জোবায়ের ও ওই নারী। তবে বেঁচে গেছে ১৫ মাস বয়সী শিশুটি।

এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য মানুষ জোবায়েরের সাহসিকতার প্রশংসা করছেন।

কেউ লিখেছেন, 'এই যুগে সবাই যখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, ব্যস্ত সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে, তখন অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া জামিলকে (জোবায়ের) রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো উচিত।'

কেউবা বলছেন, 'জোবায়ের যেন আমাদের সময়ের প্রমিথিউস', 'বাস্তবের নায়ক জোবায়ের'।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে জোবায়েরের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তার মা জেবা বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন, বাবা জাহিদুল ইসলাম ভেঙে পড়েছেন।

ভগ্নিপতি শাহজাহান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কথা বলার মতো কোনো অবস্থায় আমরা নেই। কেউ মানতে পারছে না জোবায়েরের এভাবে চলে যাওয়া।'

বাবা জাহিদুল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'দুদিন আগে ছেলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। আমাকে বলেছিল, ঈদে এবার আমাকে পাঞ্জাবি দেবে। আমি বলেছিলাম তুমি ছোট মানুষ টাকা কোথায় পাবে? বলেছিল, ওর মামা যে টাকা দেয়, সেই টাকা থেকে আমাকে একটা পাঞ্জাবি গিফট করবে। ছেলের আর বাড়ি ফেরা হলো না।'

গতকাল যা ঘটেছিল

গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গাইবান্ধা মাস্টারপাড়া থেকে প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়া শেষ করে মাঝিপাড়া মেসের দিকে যাচ্ছিলেন জোবায়ের। পথে দেখতে পান, এক নারী তার সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছেন।

এ ঘটনা দেখে জোবায়ের ওই নারী ও শিশুকে বাঁচাতে যান। ট্রেনটি খুব কাছে চলে আসায় শিশুকে বাঁচাতে পারলেও জোবায়ের ও ওই নারী ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন। তাদের উদ্ধার করে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে জোবায়ের এবং রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে ওই নারী মারা যান।

ওই নারীর নাম রাজিয়া। তিনি মাঝিপাড়া এলাকার আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ছিলেন।

দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী জোবায়ের থাকতেন শহরের থানাপাড়া এলাকার আদিল ছাত্রাবাসে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ওই নারী সকাল থেকে একাধিকবার ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। স্থানীয়রা তাকে কয়েকবার সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। তারপরেও তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

ঠিক কী কারণে রাজিয়া আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন তা জানতে  আজ দুপুরে গাইবান্ধার মাঝিপাড়া গিয়ে দেখা যায়, বেঁচে যাওয়া শিশু আবিরকে নিয়ে শুয়ে আছেন বাবা আনোয়ার হোসেন।

জানতে চাইলে আনোয়ারের বড় ভাইয়ের স্ত্রী মনি আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সোমবার রাতে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল রাজিয়ার। সেই রাগ থেকে রাত ১টার দিকে শিশুটিকে নিয়ে বাইরে যায় রাজিয়া। পরে আবার বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু সকালে বের হয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করে।'

জোবায়েরের প্রতি ভালবাসা

জোবায়েরের ভগ্নিপতি শাহজান আলী জানান, জোবায়ের পঞ্চম শ্রেণী ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। এসএসসিতে পেয়েছেন জিপিএ-৫। এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ৭১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তার রোল ছিল ১৩। নবম শ্রেণী থেকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পান জোবায়ের। বড় হয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছিল তিনি।

জোবায়েরের শিক্ষক আব্দুস সামাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই খুবই নম্র ও ভদ্র ছিল ছেলেটি, খুব মানবিক ছিল।'

জোবায়ের ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার সদস্য ছিলেন। মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে আনন্দ পেতেন ১৮ বছর বয়সী এই কিশোর।

তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেখা যায়, গত ২৬ জানুয়ারি স্থানীয় একটি বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শন করে ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলা চ্যাপ্টার।

সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে জোবায়ের লেখেন, 'প্রতিটি হাসিই অমূল্য, আপনাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে আমরা আনন্দিত।'

মাঝে মাঝে ফেসবুকে অনেক মজার পোস্টও দিতেন তিনি। যেমন: গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে জোবায়ের লিখেছিলেন, 'না পড়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুবিধা একটা। প্রশ্ন কঠিন হলেও বোঝা যায় না।'

জোবায়েরকে হারিয়ে তার বন্ধু মাশনুন স্নিগ্ধ ফেসবুকে লিখেছেন, 'আহ জীবন। আমার সহপাঠী, এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শুরু থেকে যার সাথে ওঠা-বসা, ওরে আজকে হারাইলাম। অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় সে নিজে চলে গেল না ফেরার দেশে। এই তো আজ সকালে ৯টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত একসাথে ছিলাম।'

গাইবান্ধার বোনারপাড়া রেলওয়ের ওসি মো. খাইরুল ইসলাম জানান, সন্তানসহ গৃহবধূকে বাঁচাতে গিয়ে গতকাল সকালে কলেজশিক্ষার্থী জোবায়েরসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

ময়নাতদন্তের পর জোবায়ের ও রাজিয়ার দাফন গতরাতেই হয়েছে বলে জানায় পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা।

Comments

The Daily Star  | English

Penalty less than illegal gains fuels stock manipulation

While fines are intended to deter future offences, questions remain over their effectiveness if the amount is lower than the illegal gain.

12h ago