দুর্নীতির সংবাদ কীভাবে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট করে?
সম্প্রতি একটি জেলা শহরে চারতলা সুন্দর বাড়ি দেখিয়ে আমার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলো, এই বাড়িটা কার জানো? বললাম, না। বললো, 'ইনি কর অফিসের পিয়ন। তার এরকম বাড়ি আরও একটা আছে।'
একজন কর অফিসের পিয়ন সারা জীবন ধরে যে বেতন পান, সেই টাকা এক জায়গায় করলেও একটি জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দুটি চারতলা বাড়ি বানানো সম্ভব নয়। তার মানে তিনি এই বাড়ি বানিয়েছেন কি পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে? প্রশ্ন করলে তিনি হয়তো এই উত্তরই দেবেন। কিন্তু সেটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য কিংবা আদৌ তাকে কেউ এই প্রশ্ন করবে কি না—সেটি অন্য প্রশ্ন।
মোটামুটি একই সময়ে আমার এক প্রবাসী আত্মীয় জানালেন, দেশে কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার জন্য তিনি তার ট্যাক্স ফাইল আপডেট করতে একটি জেলা শহরের কর অফিসে যান। সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাকে নানাবিধ 'হাইকোর্ট দেখানো' শুরু করলে তিনি জানতে চান, কাজটা কীভাবে সহজে সমাধান করা যায়? ওই কর্মকর্তা তাকে বলেন, পাঁচ লাখ টাকা দিলে এটা 'শেটেল্ড' করে দেওয়া যাবে।
যখন এই কথা লিখছি তখন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন সদস্য মতিউর রহমানকে নিয়ে—যার ছেলে মুশফিকুর রহমান (ইফাত) কোরবানির আগে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন।
মতিউর রহমান শুরুতে ইফাতকে নিজের ছেলে বলে অস্বীকার করলেও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ইফাত নামে ওই তরুণ মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। নিজের সম্মান বাঁচাতে পিতৃত্ব অস্বীকারের এমন নজির দেশে আর আছে কি না সন্দেহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে রসিকতা করে লিখেছেন, কেয়ামতের মাঠে সবাই নিজেকে বাঁচাতে 'ইয়া নফসি ইয়া নফসি' করবে। বাবা তার সন্তানকে চিনবে না। সন্তান চিনবে না তার বাবাকে, মাকে। কিন্তু দুনিয়াতেই সেই ঘটনা ঘটালেন মতিউর রহমান!
এনবিআরের এই সদস্য কেন নিজের সন্তানের পরিচয় অস্বীকার করলেন? কারণ, ১৫ লাখ টাকার ছাগল ইস্যুতে বেরিয়ে এসেছে তার সম্পদের পাহাড়। যে বিপুল সম্পদ তার বৈধ আয় দিয়ে অর্জন করার কোনো সুযোগ নেই। দেশে-বিদেশে তার যে সম্পদের বিবরণ গণমাধ্যমে এসেছে, তাতে চোখ ছানাবড়া হওয়ার দশা। এই সম্পদ গড়ে তোলার জন্য তিনি কি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানাবিধ অবৈধ উপায় অবলম্বন করেছেন?
তার সম্পদ নিয়ে দুদক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধান করবে কি না বা করলেও তাতে কী বেরিয়ে আসবে—সেটি হয়তো সময়ই বলে দেবে; কিন্তু মানুষের মনে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে সরকারি পদে থেকে নানা উপায়ে রাষ্ট্রের সম্পদ ও জনগণের অর্থ লুটপাটের যে অসংখ্য উদাহরণ তৈরি হয়েছে, তাতে এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, মতিউর রহমানরা ওই সম্পদ বৈধ আয়ে কিংবা পৈত্রিক সম্পদ বিক্রি করে অর্জন করেছেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম বিতর্কিত হন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ—যার সম্পদের পরিমাণও বিস্ময়কর। সম্পদ অর্জনে তিনি যে নজির স্থাপন করেছেন, সেটি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির একটি বড় উদাহরণ বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই বিপুল সম্পদ তিনি যে বৈধ আয় দিয়ে গড়ে তুলেছেন, সেটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
এরপরই আলোচনায় আসেন ঢাকার সিটি এসবিতে (নগর স্পেশাল ব্রাঞ্চ) কর্মরত অ্যাডিশনাল ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল। তার বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল সম্পদ অর্জনের খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়।
এরপর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন এনএসআই কর্মকর্তা আকরাম হোসেন। যার বিরুদ্ধে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক। সম্প্রতি সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি জামিল হাসানও। একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম: 'ডিআইজি জামিল হাসান যেন আরেক ভূস্বামী।'
ডিএমপির সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামানের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের খবরও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। যদিও তিনি দাবি করেছেন, যেসব সম্পদের তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে, সেগুলো তিনি তার বৈধ আয়ে অর্জন করেছেন।
রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রধান কাজটি করে পুলিশ। কিন্তু তাদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের গড়পরতা ধারণা অত্যন্ত নেতিবাচক এবং তার পেছনে অসংখ্য কারণ রয়েছে। পুলিশ বাহিনীতে সৎ, দেশপ্রেমিক ও শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত মানুষের সংখ্যাও নিশ্চয়ই কম নয়। কিন্তু তারপরও এই বাহিনীর সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণাই যে প্রবল, সে বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই।
গুরুত্বপূর্ণ এলাকার থানাগুলোয় মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে ওসিদের বদলি হতে হয়—এই ধরনের কথাও প্রচলিত আছে। তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে তারা কেন ওইসব থানায় বদলি হন এবং কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় সেই টাকা তোলেন বা উসুল করেন? মোটামুটি কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর জানেন।
তার মানে কি সরকারের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা দুর্নীতি করেন না? নিশ্চয়ই করেন। বরং এমন কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যেটি দুর্নীতিমুক্ত।
সরকারি পদে থাকা লোকজন যেসব উপায়ে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হতে পারেন, তার প্রধান উৎস হলো ঘুষ। এরপর আছে ভয়-ভীতি দেখিয়ে বা ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়, রাষ্ট্রীয় বড় বড় প্রকল্প থেকে মোটা অংকের টাকা চুরি তথা লুটপাট ইত্যাদি।
প্রশ্ন হলো, যখন তারা এসব অর্জন করেন, সেই তথ্য কি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী তথা সরকার এবং রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীগুলো জানে না বা জানতে পারে না? গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের আগে দুর্নীতি দমন কমিশন বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নজরে আসে না? নাকি এলেও তারা এগুলো এড়িয়ে যায় বা প্রভাবশালীদের বিষয়ে তারা চুপ থাকে? অর্থাৎ দুর্নীতিবাজরা যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে নানাবিধ নজরদারির ভেতরে থেকেও এত বিপুল বিত্তবৈভব গড়ে তুলতে পারছেন, তার মানে সিস্টেমের কোথাও কি বড় ধরনের গলদ রয়েছে? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, রাষ্ট্র কি আদৌ সেই গলদ চিহ্নিত করতে চায়?
২.
পুলিশের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরপর কয়েকটি সংবাদ প্রকাশে ক্ষুব্ধ পুলিশ ক্যাডার সার্ভিসের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। তারা গণমাধ্যমকে 'সতর্ক' করে যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে সাংবাদিকদের জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকিও রয়েছে।
পুলিশের সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের নিয়ে গণমাধ্যমে 'অতিরঞ্জিত' ও 'নেতিবাচক' সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে দাবি করে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, 'কিছু মিডিয়া হাউজ ব্যক্তিগত আক্রোশ ও নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবমাননাকর নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করছে—যার মধ্য দিয়ে 'পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে' বলে দাবি করা হয়।
প্রশ্ন হলো, কোনো একটি বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে সেটি কীভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট করে? ব্যক্তির অপরাধের দায় কি বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের? অথচ বিভিন্ন সময়ে পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকেই এটা বলা হয়েছে যে, ব্যক্তির অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না। তাহলে এখন কেন এই ধরনের বিবৃতি দিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে?
পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এই বিবৃতির একদিন পরই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো যাতে পুলিশের খবর প্রকাশের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, 'পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এ ধরনের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহের অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।'
শুধু তাই নয়, পুলিশের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে তা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সদর দপ্তরের অনুমতি নেওয়ার বিধানও চান পুলিশ কর্মকর্তারা। শিগগির সরকারের কাছে প্রস্তাব আকারে পুলিশ এই দাবি জানাবে বলে একটি পত্রিকার খবরে বলা হচ্ছে।
যদিও এমন দাবির কোনো আইনগত ভিত্তি আছে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। তাছাড়া এই ধরনের উদ্যোগ বরং দুর্নীতিকে আরও বেশি উৎসাহিত করবে। দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।
সাংবাদিকতার নামে যে মাঝেমধ্যেই অপসাংবাদিকতা হয়; ভাইরাল হওয়ার নেশায় যে অনেকেই ভুল, অর্ধসত্য ও অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ বা ডিআইজি শিমুলকে নিয়ে যে ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো কি ভুল বা ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে করা হয়েছে?
ধরা যাক, কোনো পত্রিকা বা পত্রিকার মালিকপক্ষের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে এই ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো কি মিথ্যা? সাংবাদিকরা তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কি এসব প্রতিবেদন করেছেন? তথ্যপ্রমাণ ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করলে যে সাইবার আইন বা অন্য আরও একাধিক আইনে মামলা হতে পারে, সেটি কি সাংবাদিকরা জানেন না?
পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অ্যাসোসিয়েশন যে বিবৃতি দিয়েছে, এখন কি তাহলে কর বিভাগ বা প্রশাসনের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো স্তরের কর্মকর্তার দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হলে সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সংগঠন থেকেও গণমাধ্যমে এরকম বিবৃতি পাঠানো হবে? অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও কি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে এরকম 'নির্দেশক্রমে অনুরোধ' করবে? এই ধরনের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে কি গণমাধ্যমকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে?
গণমাধ্যম এমনিতেই নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা বর্তমানে সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ নানা আইন মুক্ত সাংবাদিকতায় বড় প্রতিবন্ধক। তৈরি করা হয়েছে ভয়ের সংস্কৃতি। ফলশ্রুতিতে গণমাধ্যমে এক ধরনের 'সেলফ সেন্সরশিপ' তৈরি হয়েছে। এ ধরনের বিবৃতি, চিঠি বা বক্তব্য কি গণমাধ্যমকে আরও বেশি চাপে ফেলবে এবং নির্ভার করবে দুর্নীতিগ্রস্তদের?
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments