আইন পেশায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লবের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) আগমন বহু শিল্পকে গভীরভাবে রূপান্তরিত করেছে। ফলে, বর্তমান সমাজের গতিপ্রকৃতিকে নির্ধারণকারী গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এআই। আইন পেশাও তার ব্যতিক্রম নয়; বিশেষ করে করপোরেট আইনখাত এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব অনুভব করেছে।

বিগত এক দশক ধরে আইন পেশায় জড়িত অনেকেই এআই ব্যবহার করে কার্যকর ডেটা বিশ্লেষণ ও আইনি নথি পরীক্ষা করেছেন। বর্তমানে, করপোরেট আইন পেশার ক্ষেত্রে এআইয়ের প্রয়োগের মধ্যে রয়েছে চুক্তি ড্রাফট ও পর্যালোচনা, আইনি গবেষণা এবং আইনি নথি তৈরিসহ রুটিন কাজের স্বয়ংক্রিয়তা।

ওল্টার্স ক্লুয়ার কর্তৃক পরিচালিত '২০২৪ ফিউচার রেডি ল'ইয়ার সার্ভে' প্রকাশ করেছে, জেনারেটিভ এআইয়ের (জেনএআই) ব্যাপক প্রয়োগ আইনজীবীদের দৈনন্দিন কাজ সম্পাদনের পদ্ধতি মৌলিকভাবে রূপান্তরিত করছে। জটিল আইনি সমস্যা মোকাবিলা ও ক্রমবর্ধমান ক্লায়েন্ট চাহিদা পূরণের জন্য আইনজীবীদের প্রায় ৭৬ শতাংশ সপ্তাহে অন্তত একবার জেনএআই টুল ব্যবহার করেন।

সমীক্ষা অনুযায়ী, ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা আশা করছেন যে আগামী তিন বছরে জেনএআইয়ের উল্লেখযোগ্য প্রভাব আইন সংস্থা ও করপোরেট আইনি পেশাজীবীদের ওপর অব্যাহত থাকবে, যার মধ্যে ৩১ শতাংশ উল্লেখযোগ্য প্রভাবের প্রত্যাশা করছেন।

আইন পেশায় জেনএআইয়ের অন্তর্ভুক্তি একটি অনন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের সম্মিলন ঘটাতে যাচ্ছে। আইনি বিবেচনায় জেনএআই ব্যবহারের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নৈতিক প্রভাব, অ্যালগরিদমে পক্ষপাতিত্ব, তথ্য গোপনীয়তার উদ্বেগ ও জেনএআই কর্তৃক সৃষ্ট কোনো বিষয়ের কপিরাইট মালিকানা সম্পর্কিত সমস্যা।

আইন পেশায় জেনএআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ হলো আইনজীবীদের মধ্যে প্রযুক্তিগত জটিলতা না বোঝার ভয়, সম্ভাব্য ভুল, নৈতিকতা লঙ্ঘনের ভয় ও চাকরি হারানোর আশঙ্কা।

ল'সাইটস ব্লগের প্রকাশক রবার্ট অ্যামব্রোজি বলেছেন, 'জেনারেটিভ এআই বাস্তবায়নে আইনজীবীরা সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তা হলো ভয়। সেই ভয় হলো প্রযুক্তির জটিলতা না বোঝার ভয়।'

জেনএআইয়ের উত্থান আইন পেশায় চাকরি স্থানচ্যুতির উদ্বেগও বাড়ায়। জুনিয়র আইনজীবীদের সম্পাদিত কাজ—যেমন: আইনি গবেষণা, নথি খসড়া ও পর্যালোচনা, তথ্য ও ফলাফল সংগঠিত করা এবং প্রাসঙ্গিক আইন ও মামলা চিহ্নিত করা—এখন এআই সহজেই করে দিচ্ছে। তবে, এআইয়ের কাজের গুণমান ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে মানুষের তত্ত্বাবধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সতর্ক মানবিক তত্ত্বাবধান ছাড়া এআইয়ের কাজে ত্রুটির সম্ভাবনা ও নেতিবাচক ফলাফলের সম্ভাবনা অনেক বেশি।

সম্প্রতি আমেরিকান একটি মামলায় এআই মডেলের উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাব্য দুর্বলতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। ওই মামলায় একজন আইনজীবী চ্যাটজিপিটি দিয়ে বানানো নজির উল্লেখ করে আইনি ব্রিফ জমা দিয়েছিলেন। নথি পরীক্ষার পর বিচারক দেখতে পান যে উদ্ধৃত ছয়টি নজির সম্পূর্ণ মিথ্যা। (হার্ভার্ড ল টুডে)

২০২৩ সালের 'স্টেট অব প্র্যাকটিস সার্ভে' প্রকাশ করেছে, এআই আইন পেশায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হলেও আইনজীবীরা আত্মবিশ্বাসী যে তাদের দক্ষতা, বিচার-বিবেচনা ও মানবিক মিথস্ক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিবর্তিত থাকবে এবং ৭২ শতাংশ উত্তরদাতাই বিশ্বাস করেন যে জেনএআই আইন পেশায় আইনজীবীদের বিকল্প হয়ে উঠবে না।

পেশাদার কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করার সময় মানুষকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে এবং ফলাফল পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

জেনএআইয়ের সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ সক্রিয়ভাবে জাতীয় এআই কৌশল ও নৈতিক নির্দেশিকার পাশাপাশি আইন প্রণয়ন করেছে।

২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন' প্রণয়ন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যদের জন্য নজির স্থাপন করেছে। একইভাবে, ২০২১ সালে ইউনেস্কো 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিশাস্ত্র সম্পর্কিত সুপারিশ' বিশ্বব্যাপী মান নির্ধারণ করেছে। ইউনেস্কোর এই নিয়ম সব সদস্য দেশের জন্য প্রযোজ্য।

ইইউ আইন ও ইউনেস্কোর নিয়মে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা, স্বচ্ছতা বজায় রাখা, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং পরিবেশের ক্ষতি না করার মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই নিয়মগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিরাপদ ও নৈতিকভাবে ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে।

বাংলাদেশ সরকারও 'জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশল (২০১৯-২০২৪)' প্রণয়ন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দায়িত্বশীল উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। এই প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী আইনি ও নীতিগত কাঠামো প্রতিষ্ঠা এবং দেশের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিক ও আইনি অগ্রগতি নিশ্চিত করতে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গঠন করা।

দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা এআই প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে নতুন জ্ঞান অর্জন ও পরিবর্তিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। জেনএআই ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সুবিধা অর্জন করতে এই প্রযুক্তিকে সুচিন্তিত ও নৈতিকভাবে প্রয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জেনএআই ব্যবহারে সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই প্রযুক্তিকে দায়িত্বশীল, নৈতিক ও কার্যকরভাবে ব্যবহার করার উপায় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করা। এআইয়ের ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা বুঝতে আইনজীবীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

২০২৪ সালের 'স্ট্যাট প্র্যাক্টিস সার্ভে' জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেক আইনজীবীই জানিয়েছেন, তারা এআই সম্পর্কে জানতে বিশেষ দল গঠন করেছেন। অন্যদিকে, আরেকটি জরিপে উঠে এসেছে, ৭০ শতাংশ আইনজীবী আগামী এক বছরের মধ্যে এআই সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেবেন।

আধুনিক আইন পেশাজীবীরা এআই সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিনিয়োগ করছেন। যারা এই প্রযুক্তি সম্পর্কে জানেন না, তারা পিছিয়ে পড়তে পারেন। আইনজীবীদের দ্রুত কাজ করতে হবে বিশ্বের অন্যান্য আইনজীবীদের সঙ্গে তাল মিলে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে। ভবিষ্যতের পরিবর্তনগুলোর আগাম আন্দাজ করা এবং তার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়া আইনজীবীদের জন্য খুবই জরুরি।

 

মাজহারুল ইসলাম, করপোরেট লিগ্যাল প্র্যাক্টিশনার

mazhar@insightez.com

Comments

The Daily Star  | English

Growth of economic units slows amid capital shortages

The growth in the number of economic units in Bangladesh has slowed over the past decade, primarily due to capital shortages among rural entrepreneurs, according to the latest Economic Census of the Bangladesh Bureau of Statistics.

7h ago