চিন্তার সীমাবদ্ধতাই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল
চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

আফ্রিকায় বেশ কয়েকটা দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে অনেকদিন কাজ করেছি। প্রথম প্রথম যখন ওখানে যাই, তখন চারপাশের সবকিছু দেখে বেশ অবাক লাগত। বিশাল এলাকা, অফুরন্ত খনিজ সম্পদ, ফল-ফলাদির চাষে জমজমাট—সব মিলিয়ে মনে হতো, এই দেশগুলো অনেক এগিয়ে থাকার কথা!

কিন্তু বাস্তবতা একদমই আলাদা। এত কিছু থাকার পরও মানুষগুলো মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যেত এই ভেবে, এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কেন তারা এগোতে পারছে না?

ধীরে ধীরে বুঝলাম, শুধু সম্পদ থাকলেই হয় না। এখানে ভূ-রাজনীতির ব্যাপারগুলো বাদ দিয়ে যুক্তিসঙ্গতভাবে 'ঠিক' চিন্তা করতে পারাটা বড় বিষয়।

আফ্রিকার মানুষ অনেক ভালো, মিশুক, সহজ-সরল। তাদের সঙ্গে কাজ করতে করতে একরকম বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। আলাপ হতো নানা বিষয়ে। শুধু যুদ্ধপীড়িত আফ্রিকা না, আফ্রিকা মহাদেশের উন্নত দেশগুলোর অনেক সেনা সদস্যও শান্তিরক্ষী হিসেবে আমাদের সঙ্গে কাজ করতেন। তাদের ভাবনাগুলোর ভেতরে ঢোকার সুযোগ হয়।

মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, এমনকি পিএইচডি ডিগ্রিও আছে। কিন্তু দেখতাম, কিছু জায়গায় তারা আটকে যায়। যেমন: বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কেন জানি একটু খেই হারিয়ে ফেলে।

এই জায়গাটা আমার খুব পরিচিত মনে হলো। কারণ, একই জিনিস আমি বাংলাদেশেও দেখি। আমরাও অনেক সময় একটা অদৃশ্য 'গ্লাস সিলিং' বা নিজের তৈরি সীমানার মধ্যে আটকে থাকি। মনে হয়, যেন কেউ আমাদের মাথার ওপর একটা ছাদ দিয়ে রেখেছে, আমরা সেটার বাইরে বের হতে পারছি না। ভাবনায় একটা টানেল ভিশন তৈরি হয়ে যায়।

আমি ভাবি, এটা কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দোষ? ছোটবেলা থেকে আমরা যেভাবে মুখস্থ করি—প্রশ্ন করতে পারি না, ভয় পাই; অথবা বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার থেকে পেশিশক্তির উত্থান (মব)—এসবই হয়তো আমাদের চিন্তাকে বেঁধে ফেলে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে দেওয়া উচিত কি না—এ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, এটা আমাদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকির, দেশের স্বার্থে এটা হতে দেওয়া যাবে না। এই ভাবনার পেছনেও সেই পুরনো ভয়—'বিদেশি মানেই খারাপ'—এই ধারণা কাজ করে।

কিন্তু এখনকার দুনিয়া আগের মতো না। পৃথিবী না ঘুরলে এটা একদমই বোঝা যায় না। এখন বিশ্বায়ন নামে একটা জিনিস আছে, যেটা সবকিছুর হিসাব পাল্টে দিয়েছে। এখন দেশি না বিদেশি, সেটা বড় কথা না—কোম্পানি হিসেবে তাদের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা আছে কি না, কাজের ফলাফল আছে কি না—সেটাই আসল।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। চট্টগ্রামের নতুন কনটেইনার টার্মিনাল এখন একটা বিদেশি কোম্পানি চালাচ্ছে। অনেকেই চিন্তা করছে—এই সুযোগ দিলে তারা না জানি কী করে বসে! আমরা বুঝতেই পারি না যে একটা গ্লোবাল কমপ্লায়েন্ট কোম্পানি, এমন ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ করবে না, যার জন্য তার লাইসেন্স বাতিল হয়। পাশাপাশি এই ধরনের কোম্পানিগুলোর অনেক দেশে বছরের পর বছর পরীক্ষিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, প্রমাণিত সফলতা আছে। তারা একা না, আমাদের মানুষজনও তাদের সঙ্গে কাজ করছে, শিখছে, উন্নত সিস্টেমে অভ্যস্ত হচ্ছে।

আমাদের সমস্যা হলো, আমরা এক লাখ টাকার প্রকল্প করে সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে ১০০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প চালাতে চাই। মেগা-স্ট্রাকচারের অভিজ্ঞতা ছাড়া সেটা সম্ভব না। আমি নিজের চোখে বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিশাল বিশাল মেগা-স্ট্রাকচার প্রজেক্ট দেখেছি। অনেক কিছু শিখেছি তাদের কাছ থেকে। ওরা যেভাবে কাজ করে, পরিকল্পনা করে, প্রতিটা খাতে বাজেট ধরে রাখে—সবকিছু থেকেই শেখার আছে। এই জিনিসগুলো বই পড়ে শেখা যায় না, শেখা যায় একসঙ্গে কাজ করে।

ড. ইউনূস অনেক আগেই এই ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। তাই তিনি টেলিনর, ড্যাননের মতো কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে এনেছেন। কারণ, এসব কোম্পানি শুধু পরিষেবা বিক্রি করতে আসে না—তারা প্রমাণিত ও পরীক্ষিত প্রক্রিয়া নিয়ে আসে, যেটা আমাদের লোকজন শিখে নিজেরাই একদিন বৈশ্বিক মানে পৌঁছে যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, শেখার জন্য সুযোগ দিতে হয়, আর সেই সুযোগ না দিলে আমরাও এক জায়গায় আটকে থাকব, সুযোগ হারাব।

আবারও বলি, বড় পরিসরে কাজ করতে গিয়ে একটা জিনিস বারবার মনে হয়েছে—দেশি-বিদেশির চিন্তার সীমা যতদিন থাকবে, ততদিন উন্নতি সম্ভব না। আমাদেরও সেই একই দেয়াল ভাঙতে হবে। বিদেশি মানেই খারাপ—এই চিন্তা ছেড়ে দিয়ে দেখতে হবে, কে ভালো কাজ করতে পারছে। কাজের মানুষকে সুযোগ দিলে তবেই শেখা যাবে, আর শেখার মাধ্যমেই একটা দেশ এগিয়ে যায়।


রকিবুল হাসান: টেলিকম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক লেখক এবং লিংক-থ্রি টেকনোলজিস লিমিটেডের চিফ টেকনোলজি অফিসার

Comments

The Daily Star  | English

Dengue cases see sharp rise in early July

Over 1,160 hospitalised in first 3 days, total cases cross 11,000

15h ago