লেলিহান আগুনে হেলিকপ্টারের পানি!

রাজধানী ঢাকার শপিংমল, বাজার, বস্তি, পুরান ঢাকার কেমিকেল গোডাউন এমনকি বহুতল আবাসিক ভবনেও আগুন লাগার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু যখনই আগুন লাগে, তখনই এক নম্বর সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আগুন নেভানোর পানির স্বল্পতা। অথচ বাংলাদেশকে বলা হয় 'নদীমাতৃক'।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত নদী নেই। নদী-খাল-বিল-পুকুর-জলাশয়ের প্রাচুর্যের কারণে বাংলাদেশকে বলা হয় 'পানির দেশ'। অথচ আগুন লাগলে সেই পানির দেশেই পানির জন্য হাহাকার করতে দেখা যায়।

সবশেষ ভয়াবহ আগুনে যখন রাজধানীর বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়ে গেল; অসংখ্য ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে গেলেন; হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হলো—তখন দেখা গেল ওই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে পানি ফেলা হচ্ছে—যে পানি আনা হচ্ছিল হাতিরঝিল থেকে।

হেলিকপ্টারের বাকেট থেকে পানি ফেলে এরকম লেলিহান আগুন কি নেভানো যায়? উপর থেকে একটি বাকেট সর্বোচ্চ কত লিটার পানি ফেলতে পারে? এরকম লেলিহান আগুন কি ওই পানি মুহূর্তেই খেয়ে ফেলে না? তাছাড়া হেলিকপ্টারের পাখার বাতাস কি আগুন আরও ছড়িয়ে দেয় না?

এসব বিষয়ে কথা হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের এক সাবেক পরিচালকের সঙ্গে। তার মতে, বন-জঙ্গলের আগুন নেভাতে এভাবে উপর থেকে হেলিকপ্টারে পানি ফেলা হয়। কিন্তু বঙ্গবাজারের মতো এলাকায় যখন আগুন লাগে—যেখানে হাজার হাজার দোকান এক সঙ্গে জ্বলছিল; যেখানে কাপড়-কম্বল ও প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থ ছিল—সেখানে হেলিকপ্টার থেকে পানি ফেলা তেমন কার্যকর হয় না।

প্রশ্ন হলো—আমরা দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজেদেরকে রোল মডেল বলি, অথচ আগুন নেভানোর অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নেই কেন? কেন পানির দেশে পানির আকাল দেখা দেয়? পানির উৎসগুলো কারা খেলেন?

বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরাও সাংবাদিকদের বলছেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই যদি পানি দেওয়া গেলে হয়তো কিছু সম্পদ বাঁচানো যেত। পুরো মার্কেটটি এভাবে ছাই হয়ে যেত না। বঙ্গবাজারের আশপাশে জলাধার বা পানির উৎস নেই। পানির ব্যবস্থা করতেই আশপাশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ৩টি প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। সেগুলো হচ্ছে—(১) উৎসুক জনতা (২) পানির স্বল্পতা ও (৩) বাতাস।

গত ৬ এপ্রিল জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের সংবাদে বলা হয়, বঙ্গবাজারে আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পানির উৎস পাচ্ছিলেন না। তাদের রিজার্ভ থেকে ৫ হাজার লিটার পানি নিয়ে প্রথমে আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়। ওই পানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা সংকটে পড়েন।

মার্কেটটির আন্ডারগ্রাউন্ডে পানির রিজার্ভার ছিল না। রাস্তার পাশেও নেই ফায়ার হাইড্র্যান্ট। আশেপাশে নেই খোলা জলাধার। পাশের ওসমানী উদ্যানের পুকুরটিও পানিশূন্য। শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পুকুর থেকে দীর্ঘ লাইন টেনে পানি আনা হয়।

গণমাধ্যম বলছে, এক দশক আগেও বঙ্গবাজারের ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে অন্তত ৬টি বড় খাল ছিল, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভরাট হয়ে গেছে।

সেগুলো হচ্ছে—সেগুনবাগিচা খাল, নারিন্দা খাল, ধোলাইখাল, গোপীবাগ খাল, দেবদোলাইখাল ও সূত্রাপুর খাল। এ ৬ খালের বাইরে 'দোলাই' নামে একটা নদীও ছিল বঙ্গবাজারের খুব কাছে। নানান অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে এসব খাল ও জলাধার বিলুপ্তপ্রায়। (বণিকবার্তা, ৫ এপ্রিল ২০২৩)।

মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল ২ হাজারের মতো। তা কমতে কমতে এখন ১০০-য় এসে ঠেকেছে।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা বলছে, গত ৫০ বছরে ৯৬টি পুকুর ভরাট করে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। পুরান ঢাকায় ২৪টি পুকুরের অস্তিত্ব থাকলেও আকারের দিক থেকে সেগুলো এখন অনেক ছোট হয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো পুকুর দখলের পাঁয়তারা চলছে।

বাস্তবতা হলো—ঢাকার খাল, পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন, সরকারি ভবন, মার্কেট, আবাসিক এলাকা না বানালে হাজার হাজার টাকার তেল পুড়িয়ে হাতিরঝিল থেকে হেলিকপ্টারে এক বাকেট পানি নিয়ে বঙ্গবাজারের আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে হতো না।

আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে উন্নয়ন বলতে অবকাঠামো, উঁচু দালান, কংক্রিট, কাঁচের বিলাসিতা; রাস্তায় ল্যান্ড রোভার, মার্সিডিজ, জাগুয়ার ইত্যাদি বোঝায়। আগুন লাগলেও তারা যেন বুঝতে চান না, এসবের চেয়ে পুকুর-খাল-জলাশয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি।

এখনো যেসব পুকুর ও জলাশয় টিকে আছে, সেগুলো যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে যখনই আগুন লাগবে, তখনই পানির জন্য হাহাকার তৈরি হবে। লেলিহান আগুন মুহূর্তেই হাজার কোটি টাকার সম্পদ পুড়িয়ে ফেলবে।

মানুষ তার উন্নয়নের নামে যত বেশি নদী-খাল-পুকুর-জলাশয় ভরাট করবে, একসময় আগুন এসে ওই পানির উৎস দখল করে গড়ে তোলা অবকাঠামো ও কোটি টাকার সম্পদ ছাই করে দেবে। এটি হয়তো প্রকৃতিরই এক ধরনের প্রতিশোধ।

শুধু পানির উৎস সংরক্ষণই নয়, প্রতিটি মার্কেট ও ভবনে অগ্নি নির্বাপণের আধুনিক ব্যবস্থাও রাখতে হবে। সেই সঙ্গে আগুন যাতে না লাগে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

অর্থাৎ, রোগী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি বা ওষুধ খাওয়ার চেয়ে নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে রোগ থেকে বেঁচে থাকাই যেমন কাঙ্ক্ষিত, তেমনি আগুন লাগলে পানির জন্য হাহাকার না করে বরং আগুন যাতে না লাগে এবং লাগলেও যেন দ্রুত তা নেভানো যায়, সেরকম ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

এক সময়ের 'তলাবিহীন ঝুড়ি' থেকে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এবং এর ধারাবাহিকতায় এখন বলা হচ্ছে 'স্মার্ট বাংলাদেশ'। আমাদের মনে রাখতে হবে, আনস্মার্ট অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা যাবে না।

এটা ঠিক যে, পৃথিবীর সব দেশে বাংলাদেশের মতো এত নদী-নালা-খাল-বিল-পুকুর-জলাশয় নেই। সেসব দেশেও নিশ্চয়ই আগুন লাগে। তারা কীভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে—তা জানা দরকার।

রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় সুরম্য অট্টালিকা হবে, রাস্তায় কোটি টাকা দামের গাড়ি চলবে, অথচ আগুন লাগলে মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে যাবে—তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সংকেত দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষ ও গবাদি পশুদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া; বন্যা ব্যবস্থাপনা; বন্যা-খরা ও লবণসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনসহ নানান সাফল্য বাংলাদেশকে এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত করেছে।

কিন্তু, যখনই কোথাও বড় ধরনের আগুন লাগে, তখন এই রোল মডেল যেন 'মুখ থুবড়ে' পড়ে। প্রতি বছর ঈদযাত্রায় সড়ক ও রেলপথে যেমন আমাদের উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে, তেমনি আগুন লাগলে যেন আমাদের মুখোশ খুলে যায়।

অস্বীকার করা যাবে না, বড় ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণে এখনো আমাদের সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। অতএব এই ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নজর দেওয়া দরকার।

আধুনিক ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম গড়ে তোলার পাশাপাশি উন্নয়ন ও অবকাঠামো গড়ে তুলতে গিয়ে পানির দেশকে যেন পানিশূন্য করে দেওয়া না হয়, সে বিষয়েও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কঠোর বার্তা দিতে হবে।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া নদী-খাল-বিল-পুকুর-জলাশয় বাঁচানো যাবে না—এটি যেমন ঠিক, তেমনি উন্নয়ন মানেই যে অবকাঠামো—এই ভুল দর্শন থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।

উন্নয়ন-ভাবনায় যখন নদী-পানি-পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতি থাকবে না, তখন আগুন এসে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, আমরা কতটা বোকার স্বর্গে বাস করছি।

 

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

17h ago