উচ্চমূল্যে স্বল্প খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার নাম খাদ্য নিরাপত্তা নয়

খাদ্যদ্রব্য, খাদ্য নিরাপত্তা, কাঁঠাল, মাংস,

গত কত কয়েক বছর ধরে সরকারের উন্নয়নের স্লোগান এমন—ওমুক উপজেলা বা জেলা শতভাগ বিদ্যুতায়িত, তমুক উপজেলা বা জেলা শতভাগ ভূমিহীন নেই। দেশে খাদ্যের কোনো অভাব নেই বা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত।

খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে মন্ত্রীরা বলছেন, ভাতের পরিবর্তে আলু খেতে, আর মাংসের পরিবর্তে কাঁঠাল। আসলে এসব কথার অর্থ কী? সত্যিই কি আমাদের দেশ এতটা উন্নত হয়ে গেছে যে দেশে ভূমিহীন নেই, বিদ্যুতের সংকট নেই? ভাত না খেয়ে আলু কিংবা মাংসের পরিবর্তে কাঁঠাল খেলেই আমাদের চলছে?

সরকার দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের এসব কথা কি উন্নয়নের সূচক নির্ধারণ করে? নাকি কেবলই একটি রাজনৈতিক দলের চোখ ধাঁধানো রাজনৈতিক বক্তব্য মাত্র?

প্রথমে যদি খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলি, বাজারে খাদ্যের কোনো অভাব নেই। ফলের দোকান কিংবা মাংসের দোকান— সবই পাওয়া যাচ্ছে মধ্যরাত পর্যন্ত। সবই আছে কিন্তু দাম বেশি, সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে। স্বল্প সংখ্যক মানুষ বেশি দামে এসব খাবার কিনে খাচ্ছে। এটাই কি একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা?

খাদ্যদ্রব্য মূল্য অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকলে খাদ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী জনসভা, টেলিভিশন বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে বলেন, দেশে খাদ্যের কোনো সংকট নেই। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ আছে, তা দিয়ে আগামী ৬ মাস চলবে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে নেই।

প্রশ্ন হলো, খাদ্য নিরাপত্তা আসলে কী? দেশে সরকারের ভাণ্ডারে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে কিংবা বাজারে চাল-ডালের অভাব নেই, কিন্তু মূল্য অত্যধিক বেশি। এটাই কি খাদ্য নিরাপত্তা?

আমরা যদি মনে করি, খাদ্য নিরাপত্তা হলো বাজারে খাদ্যের সরবরাহ থাকা এবং খাবারের অভাবে মানুষ মরে না যাওয়া, তাহলে ভুল ভাবছি। মানুষ যদি অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ বলয়ের মধ্যে না থাকে, খাদ্য কিনতে গিয়ে যদি নিজেকে নিরাপদ মনে না করে, তাহলে সেটা কি খাদ্য নিরাপত্তা? এখানে নিরাপদ শব্দের অর্থ তাহলে কী?

বাজারে খাদ্য আছে, কিন্তু অধিক মূল্যের কারণে সাধারণ মানুষ পরিমাণ মতো কিনতে পারছে না। এক কেজির জায়গায় আধা কেজি কিনছে। কিংবা শুধু চাল-লবণ-আলু কিনতে পয়সা শেষ, অন্য কোনো পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারছে না। নির্দিষ্ট ও স্বল্প আয়ের মানুষ দীর্ঘদিন এই অবস্থার শিকার হওয়ায় তারা ও তাদের সন্তান অপুষ্টিতে ভুগছে— এই অবস্থার নামই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার।

একদিকে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে, মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প ছড়িয়ে পড়ছে, বড় বড় মেগা প্রকল্পে সরকার হাজারো কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে, এসব মেগা প্রকল্প সচল রাখতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সরকার কঠিন শর্তে বড় বড় অংকের ঋণ নিচ্ছে।

অপরদিকে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ— যারা মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করেন বা স্বল্প আয় করেন— উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে নিজেদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। মানুষ ঠিকমতো খাবার খেতে পারছে না, নিজেদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।

দেশ যখন অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভেসে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাও ব্যাহত হচ্ছে। এটাই কি দেশের সুষম বা টেকসই উন্নয়ন?

দেশ যদি এতই উন্নত হয়, তাহলে মানুষ ভালো করে খেতে পারছে না কেন? যদি ঠিক মতো না খেয়ে ঋণ করে দালান-কোঠা তৈরি করেন, সেটা কি সত্যিকারের উন্নয়ন? দেশের মালিক যদি জনগণ হয়, আর সেই মালিক যদি খেতে না পারে এবং তাদের টাকা দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিরা বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করেন, তাহলে সেটা কোন ধরনের উন্নয়ন?

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির মতে, সকল মানুষের সর্বদা সুস্থ ও সক্রিয় থাকার জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও পুষ্টিকর যে খাদ্যের প্রয়োজন হয় সেই খাবার পছন্দ ও চাহিদা মতো ক্রয়ের সর্বময় সমর্থকে খাদ্য নিরাপত্তা বলে।

বাংলাদেশের মানুষ কি তাদের চাহিদা বা পছন্দ মতো খাবার কিনতে পারছে? বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ মানুষ তা পারছে না। ফলে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে, এই দাবি সরকার কীভাবে করছে? শুধু ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার নাম খাদ্য নিরাপত্তা নয়। বাংলাদেশকে পৃথিবীর বৃহৎ অর্থনীতির একটি দেশ হতে হলে আগে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। না খেয়ে দামি জামা গায়ে দিয়ে ফুটানি করলে প্রতিবেশীরা তাকে পাগল ছাড়া আর কিছুই বলবে না। সরকারের উচিত, উন্নয়নের গল্প দেশ-বিদেশ ফেরি করার আগে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এটাই এখন তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ।

মোস্তফা সবুজ, দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সংবাদদাতা, বগুড়া

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

17h ago