জনগণের দুরবস্থা নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়রা আর কত রসিকতা করবেন
বিশ্বে চলমান এই আর্থিক অস্থিরতার সময়ে বাংলাদেশের মানুষ অন্যান্য দেশের মানুষের চাইতে 'বেহেশতে' আছে বলে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন প্রকাশ্যে মতামত দেন, তখনতো একটা শোরগোল পড়তেই পারে। বিশেষ করে এই বেহেশত ঘোষণার দিনই যখন অন্যান্য জিনিসের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডিমের ডজন ১৩০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা এবং ফার্মের মুরগির কেজি ২০০ টাকা হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বেশ ধন্দের মধ্যে পড়ে গেল এই ভেবে যে— কারা বেহেশতে রয়েছেন আর কারা নরক যন্ত্রণা ভোগ করছেন?
সরকার স্বীকার করুক আর নাই করুক, নানা কারণেই তারা যে এখন চাপের মধ্যে রয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। একদিকে সামনে নির্বাচন, অন্যদিকে কালো টাকার ছড়াছড়ি, দুর্নীতি সীমাহীন, বাজার নিয়ন্ত্রণহীন, জ্বালানি তেলের ভয়াবহ উচ্চমূল্য, ডলারের গলাকাটা দাম, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্য, মুদ্রাস্ফীতির কারণে দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের এখন নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ঠিক তখনি জীবন চালানোর জন্য শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে একেবারে পেরেশান করে তুলেছে।
এতসব চাপের মধ্যে থেকেও আমাদের মন্ত্রী মহোদয়রা কিন্তু রসিকতা করতে ছাড়ছেন না। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, তারা রসিকতা করছেন জনগণের সংকট নিয়ে। যেমন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বললেন, 'প্রত্যেকের গায়ে জামাকাপড় আছে, খুব খারাপ আছি মনে করি না।'
ওনার এই কথা শুনে রংপুর এলাকার একজন কৃষক খুব সহজভাবেই মন্তব্য করলেন, 'হামরা যে আসলেই খারাপ আছি, এইটা বুঝানোর তানে কি হামরা উন্ধা (কাপড় ছাড়া) হয়া বেড়াইম?' কারণ সেই কৃষককে সার-বীজ কিনতে হচ্ছে বেশি দামে, ডিজেলের দাম বেড়েছে, বেড়েছে পরিবহন খরচ, বিদ্যুতের সংকট, পানির সংকট, বৃষ্টি নেই। সব মিলে ৬ জনের সংসার নিয়ে মারা যেতে হবে, যদি এই অবস্থা চলতে থাকে। ইতোমধ্যে সংসারের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। অবশ্য উনি বলেছেন, তার পরিবারের সবার পরনে কাপড় আছে, এমনকী পায়ে স্যান্ডেলও আছে। কাজেই বোঝা গেল যে এটা দিয়ে তার 'দারিদ্র বা মন্দ থাকা' মাপা যাবে না।
অন্যদিকে জনগণের দুরবস্থা নিয়ে আরেক ধাপ বেশি রসিকতা করলেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তিনি অবলীলায় বলে বসলেন, 'জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় কেউ মারা যায়নি, মরবেও না।' তাহলে কি কাদম্বীনির মতো এইবার জনগণকে মরেই প্রমাণ করতে হবে যে তারা মরে নাই? একজন পরিকল্পনামন্ত্রীর যদি এই ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকে, তাহলে উনি কীসের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করছেন?
মন্ত্রী মহোদয় বোধকরি এখানে 'মারা যাওয়া' বলতে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে ভুগে মৃত্যুকে বোঝাতে চেয়েছেন। উনি কি জানেন না যে খাটিয়ায় শবদেহ হয়ে শুয়ে না থেকেও মানুষ মারা যেতে পারে? এই মৃত্যু মানুষের স্বপ্নের মৃত্যু, মধ্যবিত্তের জীবন থেকে নিম্নবিত্ত জীবনে প্রবেশের পর মৃত্যু, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হওয়ার কষ্টে মৃত্যু। যে মা তার বাচ্চার মুখে ৩ বেলা খাবার তুলে দিতে পারছেন না, যে বাবা সংসারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে ধার-দেনায় ডুবে যাচ্ছেন, যে পরিবার বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে প্রায় উদ্বাস্তু হচ্ছেন, তারা জানেন মৃত্যু কাকে বলে?
দ্রব্যমূল্যসহ জীবনযাত্রার ব্যয় এতটাই বেড়েছে যে, দরিদ্র মানুষতো বটেই মধ্যবিত্ত মানুষই এখন নামজপ করছেন। কারণ কারোরই আয় বাড়ছে না, বাড়ছে সংসার খরচ। এই আর্থিক কষ্ট মানুষের মনের ওপর যে চাপ ফেলছে, তা মৃত্যুর চাইতে ভয়াবহ। আমাদের মতো নির্ধারিত আয়ের মানুষের মূল চ্যালেঞ্জটা হলো বাজারে সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়বে, আমার আয় বাড়বে না কিন্তু আমাকে খরচ কমাতে হবে। সাধারণ মানুষ এত হিসাব-নিকাশ বোঝে না। শুধু দুবেলা ডাল-ভাত খেয়ে, পরিবার নিয়ে নিরাপত্তার মধ্যে বাঁচতে চায়। কিন্তু হঠাৎ করে যখন অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হলো তেলের দাম, তখন মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মূল্যবৃদ্ধির জন্য কারও কোনো প্রস্তুতি ছিল না, ছিল না কোনো আলোচনা বা আগাম সতর্কতা।
সরকার কি জানে না নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের অবস্থা আর্থিকভাবে কতটা সংকটপূর্ণ, সেটাতো সরকারের বিবেচনায় থাকা দরকার ছিল। কিন্তু, তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তাতে মনে হয় না যে তাদের এই বিবেচনাটা খুব একটা আছে। উল্টো সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এই মূল্যবৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ নিয়ে মজা করা হচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয়দের এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য একদিকে যেমন সরকারের ভাবমূর্র্তি নষ্ট করে, তেমনি মানুষকেও ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে।
এই আপৎকালীন সময়ে সরকারের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি বললেন, 'আইএমএফের শর্ত মেনে সরকার বিষ গিলল।' কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তো বুঝতে হবে এই বিষ দেশের জনগণ গিলল। আইএমএফ-এর লোন কেন দরকার, কোথায় খরচ হবে, কীভাবে খরচ করবে, সুদ কত, সরকার কীভাবে-কতদিনে সুদ মেটাবে, জনগণকে কতটা বহন করতে হবে-- এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করা দরকার সরকারকেই, কারণ তা না হলে মেনন সাহেবের বিষ গেলার কথাটাই সত্য বলে ধরে নিতে পারে বিপদগ্রস্ত জনগণ।
২০১২ সালে আইএমএফ যখন বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছিল, তখনো তারা অনেকগুলো শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। এর অংশ হিসেবে সরকারকে ২০১৩ সালে গোটা ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করতে হয়েছিল। পাশাপাশি ৯ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত না দিলে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ হয়ে যাওয়াসহ ঋণ পুনঃতফশিলের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতিমালাও পরিবর্তন করতে হয়েছিল। (দ্য ডেইলি স্টার)
আইএমএফের ঋণ পুরোটা পাওয়ার পর সরকার আবার সেইসব নিয়মকানুন পরিবর্তন করে আগের জায়গায় চলে গিয়েছে। ২০১৮ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন আবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে সুবিধা পেয়েছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। এই ছাড় দিয়ে দিয়ে চলতি বছরের জুনে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য সহজভাবেই বলেছেন যে, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং ব্যবসায়িক মন্দার কারণে অনেক গ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। শুধু কি তাই? অনেকে নাকি ইচ্ছা করেও ঋণ পরিশোধ করছেন না এবং করবেনও না। কারণ এরা এমন সব মাথাওয়ালা মানুষ, যারা অনেকেই দাজ্জালের চাইতেও শক্তিশালী।
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের পরনের কাপড় ও মৃত্যু হওয়া নিয়ে যখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন ঠাট্টা মশকরা করছেন, তখন জানা গেল দেশ থেকে গত ১০ বছরে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হয়েছে।
কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্চ করতে দেখছি না সরকারের কোন কর্তৃপক্ষকে। অথচ এই এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের হিসাব, অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার এবং দেশের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সবই এক সুতোয় বাধা।
একজন খেটে খাওয়া মানুষ হয়েও মাঝেমধ্যে আমাদেরও সাধ জাগে টাকার জাহাজের খোঁজ নিতে। কারণ ওই একটাই, দেশের অগণিত মানুষের দুঃখ, কষ্ট ও ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য যারা দায়ী, তারাই টাকা পাঠান সুইস ব্যাংকে। সুইস ব্যাংকে কার কত টাকা জমা হচ্ছে, অন্যান্য দেশ নিজের নাগরিকদের বিষয়ে এই তথ্য জানতে চেয়ে, জানতে পেরেছে।
কিন্তু বাংলাদেশ বলছে, তারা জানতে পারেনি। অন্যদিকে 'সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অ্যাকাউন্টের বিষয়ে বাংলাদেশ কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য চায়নি' বলে সুইস রাষ্ট্রদূত নাথালি শুয়ার্ড বক্তব্য দিয়েছেন। তার এই বক্তব্যকে 'মিথ্যা' অভিহিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।
তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? বাংলাদেশ কি আদতেই জানতে চাইছে সেখানে কার কত টাকা জমা হচ্ছে? সুইস ব্যাংকে রাখা বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তিদের অর্থের পরিমাণ সম্প্রতি কমে থাকলেও সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি বছরের জুনে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমা করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। শেষপর্যন্ত হাইকোর্ট জানতে চেয়েছেন সুইস ব্যাংকে টাকার তথ্য চাওয়া হয়েছে কি না?
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬ সালে বলেছিলেন, 'সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের সংবাদ আসলে অতিশয়োক্তি।' বর্তমান অর্থমন্ত্রী ২০২১ সালে বলেছেন, 'কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই।' তাহলে এই বেহেশতে থাকা সাধারণ জনগণ কার কথা বিশ্বাস করবে?
জিডিপি বা প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন বা চলতি হিসাবের ঘাটতি কিংবা সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি বা চলতি আয়ের ভারসাম্যে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতির প্রভাব কতটা, এইসব জেনে একজন সাধারণ মানুষের কী যায় আসে? সাধারণ মানুষ এত কঠিন হিসাব নিকাশ বোঝেন না। তারা বোঝেন একটাই হিসাব, তা হলো জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তাদের জীবনে সুখের আয়ু হ্রাস পাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি মানেই আয়ের ওপর সরাসরি আঘাত।
দেশে জিডিপির হিসাব নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। তবে, কোভিডের সময় এই বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য নিয়ে সন্দেহও বেড়েছে। এমনকি সন্দেহ আছে মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়েও। মজার বিষয় হলো জিডিপি যেহেতু পছন্দ, তাই এটিকে বাড়িয়ে দেখানো হয়, আর মূল্যস্ফীতি যেহেতু অপছন্দের, তাই এটি কমিয়ে দেখানো হয়। সমস্যা হচ্ছে, জিডিপি বাড়লেও তা টের পাওয়া যায় কম, আর মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হলেও এর উত্তাপ পাওয়া যায় অনেক বেশি। অনেকটা আবহাওয়ার মতো, অনুভূত হয় বেশি। (শওকত হোসেন, প্রথম আলো)
অন্য দেশের কথা বাদ দিলেও পশ্চিম আফ্রিকার দারিদ্র পীড়িত ৮০ লাখ মানুষের দেশ সিয়েরা লিওনেও জ্বালানিসংকট ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও সহিংসতায় অন্তত ২৭ জন নিহত হয়েছেন। কিন্তু আমরা প্রায় ১৩-১৪ কোটি মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ মুখ বন্ধ করে মূল্যস্ফীতির জোয়াল কাঁধে নিয়ে বয়ে চলেছি, আর ভাবছি কী জানি হয়তো 'বেহেশতেই' আছি কিন্তু শরীরে দোজখের আগুনের তাপ পাচ্ছি। জাতীয় কবির ভাষায় বলতে চাই, 'অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ, কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।'
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments