আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব?

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর গত বছরের মার্চ থেকে নয় শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতিকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে সাত শতাংশে নামিয়ে আনার পূর্বাভাস দিয়েছেন।

তার এই আশাবাদ হয়ত আর্থিক কড়াকড়ি ও নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক কমানো থেকে এসেছে।

সমস্যা হচ্ছে বহুপাক্ষিক ঋণদাতা বা স্থানীয় অর্থনীতিবিদ—কেউই তার এই প্রক্ষেপণকে সমর্থন করছেন না—অন্তত ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে তো নয়ই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর জানেন যে মূল্যস্ফীতি কমাতে দেরি হলে জনগণের অবিশ্বাস, ঘৃণা ও হতাশা বাড়বে।

৩২ বছর বয়সী বেসরকারি চাকরিজীবী আবুল হাসানের কথাই ধরা যাক। তিনি রাজধানীর ফার্মগেটে রাস্তার পাশের এক দোকানে চা দিয়ে খাওয়ার জন্য এক টুকরো কেক নিতে যাচ্ছিলেন।

ঝুলন্ত পলিথিন ব্যাগ থেকে কেকটা বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, 'দাম কত?'

দোকানদার বললেন, '২০ টাকা।'

'এর দাম ২০ টাকা?' প্রশ্ন করেন হয়ত ভুল শুনেছে ভেবে। গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করার আগে তিনি বলেন, 'সংসারের খরচের অতিরিক্ত বোঝা কতক্ষণ বহন করা যায়? সবকিছুর দাম বেশি। বিরক্ত লাগে।'

খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে পৌঁছে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ে দেশের মানুষের অনুভূতির প্রতিফলন ঘটে আবুল হাসানের বিরক্তিতে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।

গত নভেম্বরে ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ১০ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে যে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে কিসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার: সরবরাহ নাকি চাহিদায়?

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমতে পারে। তবে এটি নয় শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি তা সাত শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি।

গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বন্যার কারণে চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক সাত শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ।

পাশাপাশি, বহুপাক্ষিক ঋণদাতা সংস্থাটি টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়া ও ক্রমবর্ধমান আমদানি খরচ বেশি হওয়াকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস দিয়েছে।

তবে মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত চাহিদার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।

চাহিদা নিয়ন্ত্রণ কি সমাধান?

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা অর্জন করার চেষ্টা করছে তা হলো বাজারে টাকার প্রবাহকে সীমিত করার মাধ্যমে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা।

গত আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর আহসান এইচ মনসুর নীতি হার তিনবার বাড়িয়ে এ বছর ১০ শতাংশে উন্নীত করেছেন। এটি হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ হার।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি মূল্যস্ফীতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সুদের হার বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তাতেও কাজ না হলে গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে আরও কড়াকড়ির ইঙ্গিত দেন গভর্নর।

কঠোর ব্যবস্থা ছাড়াও দেশের ডলারের মজুদ ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনার মতো অন্যান্য বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এসব বিষয় তুলে ধরছেন।

সরবরাহের দিকগুলো কী?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি হার বাড়ালেও এর সীমাবদ্ধতা আছে।'

মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সরবরাহের ঘাটতি দূর করার আহ্বান জানান তিনি।

তার মতে, শুধু নীতি হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়।

বাজার ব্যবস্থাপনা ও কারসাজি দূর করার মতো অন্যান্য বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

'এগুলো ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা নেই।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদের ভাষ্য—ঋণের খরচ বেশি হলে তা পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। নতুন বিনিয়োগ ও চাহিদা কমানো হলে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে স্থবির করে দেয়।

তিনি বলেন, 'কৃষি উপকরণের খরচ, বিশেষ করে জ্বালানি ও কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান খরচ শিল্প উৎপাদন, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বাধাগ্রস্ত করেছে।'

'অনেক প্রতিষ্ঠান সক্ষমতার তুলনায় কম কাজ করছে। সরবরাহ কম তাই পণ্যের দাম বেশি।'

এর অর্থ হলো অতিরিক্ত কড়াকড়ি পণ্যের দাম কমানোর লড়াইকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সঠিক পথ নির্ধারণ করা সহজ নয়।

ডলারের মজুদও গুরুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগামী পাঁচ থেকে ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি সাত শতাংশে নেমে আসবে বলে আমি মনে করি না। মূল সূচকগুলো যেমন রিজার্ভ ও টাকার বিনিময় হার এ ধরনের পূর্বাভাসকে সমর্থন করে না।'

তিনি বলেন, 'রিজার্ভ কম থাকলে, আর্থিক খাত সঠিকভাবে কাজ না করলে ও বিনিময় হার অস্থিতিশীল থাকলে শিগগিরই মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন হবে।'

সম্প্রতি রেমিট্যান্স বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। বহুমুখী সংকটে থাকা দেশের জন্য এটি স্বস্তির।

এরপরও কয়েক মাস ধরে ১২০ টাকায় স্থিতিশীল থাকার পর সম্প্রতি টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে ১২৫ টাকা হয়েছে।

ডলারের দাম বেশি হলে আমদানির খরচ বেড়ে যায়। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সময় প্রয়োজন

গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে আহসান এইচ মনসুর স্বীকার করেন, মুদ্রানীতি কঠোর করা হলেও অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাজস্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হলেও মূল্যস্ফীতি এখনো কমেনি।

মুদ্রানীতি কঠোর করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সরকার পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল ও চিনির মতো নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক তুলে নিয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina regime silenced media

Chief Adviser's Press Secretary Shafiqul Alam yesterday said steps must be taken to ensure that no one can directly interfere with the media in the future like it was done during the ousted Sheikh Hasina government.

7h ago