মুখের কথা আর বন্দুকের গুলি একবার ছুটে গেলে…

মতামত

বাংলা বচন আছে, "মুখ থেকে কথা ছুটে গেলে আর বন্দুক থেকে গুলি বের হয়ে গেলে, তা আর ফেরানো যায় না, যা ঘটার তাই ঘটে যায়।" ঠিক সেটাই ঘটেছে টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এর ক্ষেত্রে।

উনি ক্ষমতার দম্ভে এমনই মুখ ছুটিয়েছেন যে, তা গালিগালাজ হয়ে গেছে। ইউএনও সাহেব সাংবাদিককে তিরস্কার করে যা বলেছেন, মাননীয় হাইকোর্ট বেঞ্চ সেটাকে এইভাবে বলেছেন, "'টেকনাফ ইউএনও যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা আপত্তিকর, দুর্ভাগ্যজনক ও অগ্রহণযোগ্য। তার কথাগুলো সত্যি হলে, সেগুলো একজন মাস্তানের চেয়েও খারাপ। রং হেডেড পারসন ছাড়া আর কেউ এ ধরনের গালিগালাজ করতে পারেন না। একজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে ইউএনওর শালীন ভাষা ব্যবহার করা উচিত ছিল।"

শুধু তাই নয়, অভিযুক্ত ইউএনওকে ওএসডিও করা হয়েছে। যদিও ইউএনও সাংবাদিকের সঙ্গে তার আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার অপরাধ এতটাই গর্হিত ছিল যে তাকে শাস্তি মাথা পেতে নিতে হলো। এতে তার ব্যক্তিসত্ত্বা অসম্মানিত হলো নানাভাবে। পরিবারের কাছে ও সহকর্মীদের কাছে মাথা নিচু হলো এবং সর্বোপরি যে এলাকায় এতদিন প্রতাপ-প্রতিপত্তি দেখিয়েছেন, সেখান থেকে চুপ করে সরে পড়তে হলো।

এর আগে আমরা শুনেছি নগরীর স্বনামধন্য একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার টেলিফোন কথোপকথন। ফাঁস হয়ে যাওয়া এই কথোপকথন এতটাই কুৎসিত ছিল যে শুনে মনে হয়েছিল এগুলো মিথ্যা। কোনো মানুষ, বিশেষ করে একজন শিক্ষিকা কি এরকম কদর্য ভাষায় কথা বলতে পারেন?

যদিও মানুষের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ফাঁস করাটা অভব্যতার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু সেই কথা না শুনলে আমরা ভাবতেও পারতাম না একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার মুখের ভাষা এত জঘন্য হতে পারে। সেই ভাষা ও গালাগালি শুনলে মনে হবে উনি একজন অসভ্য, বর্বর, অশিক্ষিত মানুষ। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস যে তার হাতেই একটি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে।

আমি জানি না এই অকথ্য ভাষা ও বালিশের নিচে বন্দুক নিয়ে ঘুমানোর কথা শুনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা। শিক্ষা, প্রশাসন যদি রাজনীতির অধীন হয়ে যায়, তখন এধরনের মাত্রাছাড়া কর্মকাণ্ড ঘটতেই থাকবে। আর শিষ্টাচার বিষয়টিও ক্রমশ হারিয়ে যাবে।

কথা প্রসঙ্গে আমার দাদার একটি বাণী মনে হলো, যা এখানে প্রণিধানযোগ্য। দাদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন আইনজীবি ছিলেন। তিনি সবসময় বলতেন, 'তোমরা যত পড়াশোনা শিখবে, যত উপরে উঠবে, তত বেশি সহবৎ শিখবে, যেন তোমরা বিনয়ী হতে পারো। শিক্ষা তোমাদের মধ্যে যদি এই ভদ্রতাবোধ ও বিনয় তৈরি করতে না পারে, তাহলে পড়াশোনা শিখে, বড় হয়ে লাভ কী? এরচেয়ে ঘরে শুয়ে কড়িকাঠ গুনো।'

অভব্য আচরণকে দাদা রীতিমত অপরাধ বলে মনে করতেন। এমনকী তার সন্তানরা যেন নিজ নিজ সন্তানদের সাথে অভব্য আচরণ না করে, এই শিক্ষাও দিয়ে গেছেন।

আসলে যে যত উপরেই উঠুক, তার মূল পারিবারিক শিক্ষা যদি ঠিকমতো না হয়, পরিবার যদি তাকে ভদ্রতা, নিষ্ঠা ও সততার শিক্ষা না দেয়, তাহলে সেই মানুষ ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করলেও অসভ্যই থেকে যাবে। তখন হয়তো তার ক্ষমতার দাপটে কেউ মুখ খুলবে না কিন্তু কেউ তাকে ভালোবাসবে না, মন থেকে সম্মান করবে না।

অনেকসময়ই দেখবেন কোনো মানুষ খুব ছোট একটি চাকরি করছেন আপনার বা আমার অফিসে, কিন্তু তার আচার-আচরণ খুবই ভদ্র ও পরিশীলিত। তার সততা অনেক বড় চাকুরিজীবির চাইতে বেশি। খোঁজ করে দেখবেন সেই ব্যক্তি হয়তো দরিদ্র পরিবারের সন্তান বলে পড়াশোনা শিখে বড় কোনো চাকরি করতে পারেননি কিন্তু পারিবারিক শিক্ষা তাকে একজন বড় মানুষে পরিণত করেছে। এই আচরণ খুব সাধারণ যেকোনো পেশাজীবি মানুষের মধ্যেও দেখতে পারবেন।

শুধু বই মুখস্ত করে, পরীক্ষায় জিপিএ বাড়িয়ে, কর্মক্ষেত্রে চটকদার প্রেজেন্টেশন দিয়ে বা গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলে আপনি হতে পারেন অনেক বড় চাকুরে, অফিসের কান্ডারি, ক্ষমতাধর আমলা, বড় কোনো ব্যবসায়ী, নামকরা পেশাজীবি অথবা শিক্ষক বা সাংবাদিক। কিন্তু এই আপনিই যদি মানুষের মনের কাছে পৌঁছুতে না পারেন, তাহলে অর্জন হয়ে যেতে পারে ষোল আনাই মিছে। যেমনটা হয়েছে এই টেকনাফের ইউএনও সাহেবের ক্ষেত্রে। তার উদ্ধত আচরণ আজ তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করল। তাকে আদালত কর্তৃক ভর্ৎসনার শিকার হতে হলো এবং সর্বোপরি চাকরিতে ওএসডি হলেন।

আমি জানি না সরকারি চাকরিবিধি মোতাবেক অসদাচারণের আরো কোনো বড় শাস্তি আছে কিনা? কারণ একে ক্ষমতার অপব্যবহার বলা যায়। প্রজাতন্ত্রের এক কর্মচারী হয়ে কক্সবাজারে স্থানীয় এক সাংবাদিকের সাথে তিনি যে ভাষায় কথা বলেছেন এ থেকে ধারণা পাওয়া যায় প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষমতাহীন মানুষের সঙ্গে উনি কী ব্যবহার করেন বা করতে পারেন। উপজেলা প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন ইউএনওর ধৃষ্টতা দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে।

এইসব ঘটনা দেখে মাঝে মধ্যে আসলেই ভীষণ মন খারাপ হয়। এই দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত যা হচ্ছে হয়তো ভালোই হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মন-মানসিকতা, মূল্যবোধ নিচের দিকে যাচ্ছে। দিন দিন বৈষম্যমূলক আচরণ ও অবক্ষয় প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। শুধু যারা চাকরিতে বা ক্ষমতায় আছে তারাই নয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেও বড় একটা অংশের মধ্যে সেই ছাপ স্পষ্ট।

অর্থ ও ক্ষমতার দাপট দেখানোর মানসিকতা চলছে সবখানে। প্রশাসন কিংবা রাজনীতি কিংবা অন্য যেকোনো পেশা, এই রাষ্ট্র আর সমাজে ক্ষমতাই আজকে সব। তা না হলে বিসিএস পাশ করা একজন স্যুট পরা মানুষ কীভাবে দায়িত্বশীল পদে থেকে আরেকজনের সঙ্গে তুই তোকারি করেন, জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ করেন? আমরা যতই উন্নয়ন উন্নয়ন করে চেঁচাই না কেন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মূল্যবোধ না থাকলে সবই শূন্য হয়ে যাবে।

কেন আমাদের আচার-আচরণ, শিক্ষা-দীক্ষা নিম্নগামী হচ্ছে? বিভিন্ন জরিপে দেখতে পাচ্ছি বুদ্ধিবৃত্তি, গবেষণা, উদ্ভাবন এবং মৌলিক চিন্তায় দক্ষিণ এশিয়া সারা দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে। সেই দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে আবার আমরা সবচেয়ে পিছিয়ে। আরও ভয়ংকর কথা হলো দিনে দিনে এই পিছিয়ে পড়া বাড়ছে। চারিদিকে বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, দালান, কোঠা, উদ্ভাবন, চাকচিক্যের ছড়াছড়ি। তাহলে কেন মন-মানসিকতাসহ অনেককিছুর মান অধোগামী?

আমাদের মৌলিক জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য যে উদ্যম প্রয়োজন তার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে কগনিটিভ ডিজোনেন্স। যোগাযোগেরবিদ্যার ছাত্রী হিসেবে আমরা শিখেছিলাম কগনিটিভ ডিজোনেন্স হলো আমাদের মনে দুটো পরস্পরবিরোধী চিন্তার একত্রে অবস্থান।

এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মানুষ যুক্তি দিয়ে সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে এবং মনের অস্বস্তি দূর করতে চায়। এই অস্বস্তি কাটানোর জন্যই আমরা আরও জানতে চাই, চিন্তা করি, গবেষণা করি ও অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য ধারণা গ্রহণ করি। কিন্তু যখন মানুষ সেই কাজ করে না, যুক্তিবোধকে কাজে লাগায় না, কোনো প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় না, তখন মানুষের জ্ঞানের ধার কমতে শুরু করে।

মানুষ তখন অন্য কোনো উপায়ে নিজের ওপর ও পারিপার্শ্বিকতার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। তখন মানুষ হয় যুক্তিকে বাদ দিয়ে নিজের আগ্রাসী চিন্তাকে অগ্রাধিকার দেয়, নয়তো পরিস্থিতিকে অস্বীকার করতে শুরু করে। সঠিক পথে না গিয়ে যারা কগনিটিভ ডিজোনেন্সের অস্বস্তি থেকে মুক্ত হয় বা হতে চায়, তাদের জগতটা হয়ে ওঠে হালকা মানের। গভীর কোনো চিন্তা এবং বাস্তবতা সেখানে স্থান পায় না।

মেধায় পিছিয়ে পড়া ও আচরণে আবেগপ্রবণ, অসহিষ্ণু ও বিচারবোধের ঘাটতি নিয়ে যে প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, এরা পুঁথিগত বিদ্যার পেছনে যতটা ছুটে চলে --- যুক্তি, বিবেক ও নীতিবোধের শিক্ষা গ্রহণ থেকে ততটাই পিছিয়ে যায়। তাদের মধ্যে বিচারবোধ কমে যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা তৈরি হয়। এর সাথে বাড়ে বিষন্নতা, বিরক্তি, অসততা, অসহিষ্ণুতা, অবসাদ, কোনো বিষয়ে আগ্রহহীনতা ও আগ্রাসী মনোভাব। অন্যদিকে মানুষ যদি একটি হীন, স্বার্থপর, লোভ আর কুপমন্ডুকতার পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়, তাহলে সেই মানুষ শিক্ষিত হলেও প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী ও সৎ হবে না।

একটি পারিবারিক শিক্ষার কথা বলে লেখাটা শেষ করছি। ফোর-ফাইভে পড়ি, সেসময় আমাদের বাসায় গৃহকর্মী ছিল নূরজাহান। একদিন আমি নূরজাহানের ওপর বিরক্ত হয়ে ওকে ধাক্কা মেরেছিলাম। আব্বা-আম্মার কাছে আমার এই আচরণটি ছিল খুবই গর্হিত অপরাধ। আব্বা আমাকে নূরজাহানের কাছে ক্ষমা চাইতে বললো।

আব্বা সেদিন বলেছিল, 'মনে রাখবি দুটো খাবারের জন্য মেয়েটি আমাদের বাসায় কাজ করতে এসেছে। ওর জন্য এটা খুব কষ্টের অনুভূতি। ও কাজ করতে পারে আমাদের বাসায় কিন্তু ওর একটা সম্মান আছে। এরপর থেকে যেন কখনো গৃহকর্মীর গায়ে হাত তুলতে না দেখি।'

আমাদের শিশুরা কোনটা শিখবে আর কোনটা বর্জন করবে সেই মুল্যবোধ তৈরি করতে না পারলে এক সময় মানসিক অসুস্থতার যে ঝড় উঠবে, সেটা থেকে বাঁচা কঠিন হয়ে যাবে। এই কথাগুলো এজন্য বললাম যে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা থেকেই আমরা আচরণগত শিক্ষা পাই। মনে করার কোনো কারণ নেই যে মানুষ শুধু ধনী হলে, ভালো চাকরি করলে বা শিক্ষিত হলেই তার অধীনস্থ বা পাশের মানুষের সাথে ভালো আচরণ করবে, তা কিন্তু নয়।

 

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

10h ago