‘বই পড়া ভারি মজা’র দিনগুলো

বই পড়া
ছবি: সংগৃহীত

চতুর্থ শ্রেণিতে বাংলা বইয়ে 'বই পড়া ভারি মজা' নামের একটি গদ্য পড়েছিলাম। তখন 'অ্যানালগ' যুগে নতুন বাংলা পাঠ্যবইটা সবার আগে নিয়ে বসা, গরমের ছুটিতে গল্পের বই পড়ে শেষ করার মধ্যেই ছিল আমাদের বিনোদন। তখন গল্পের বই কিনে দেওয়ার মধ্যেও থাকত নানান বিধিনিষেধ, যাতে পড়াশোনার ক্ষতি না হয়।

শুধু ফাইনাল পরীক্ষা শেষেই নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে নিয়ে গিয়ে আমাদের বই কিনে দেওয়া হতো। তখন বন্ধুদের মধ্যে গল্পই হতো কে কয়টা বই পড়েছি, কোন বই নতুন এলো দোকানে, তার কাহিনী কী- এসব নিয়ে। কিছু বন্ধু বই ধার দিতেও রাজি হয়ে যেত, বাকিরা বেশিরভাগই দিতে চাইত না। যদি শখের বই নষ্ট হয়ে যায়! সে সময়ে স্কুলে 'আমার শখ' রচনা আসলেই বই পড়া নিয়েই সবাই লিখে দিতাম।

কৈশোরে ডিজনি আর রঙিন ছবির বই ছেড়ে একটু ভারী, শুধুই লেখার পর লেখা, বই পড়া শুরু হলো। সেইসব বই আবার বাসার বড়রা আগে দেখে নিয়ে ঠিক করতেন পড়ার উপযুক্ত কি না। এই বই বাছাই এবং পড়ার মধ্যেও সময়ের পরিবর্তন বা রূপান্তর টের পাওয়া যায়। কিশোর বয়স যখন শুরু তখন সবেমাত্র সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দায় হাতেখড়ি। এখনো মনে পড়ে, অজানাকে জানা আর না দেখাকে দেখতে চাইবার আগ্রহে এসব বই পড়তাম। অন্যতম কারণ ছিল, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি এক ধরনের মোহ। একে তো কৈশোর বয়স, কত রকম বকাঝকা, তার ওপর মেয়ে হওয়ায় আরও নতুন নিষেধাজ্ঞা। তখন মনে হতো, ইউরোপ-আমেরিকায় বুঝি এমন হয় না। সেখানে স্বাধীনতা যেন একটু বেশিই। তিন গোয়েন্দার চরিত্রগুলো তাই জীবন্ত হয়ে উঠত। কল্পনা করে নিতাম রকি বিচ হয়তো এমন, লস এঞ্জেলেস শহরটাও নিশ্চয়ই ওমন। কাগজে মাকে লিখে দিতাম, তিন গোয়েন্দার কোন সিরিজগুলো এনে দিতে হবে। কখনো পকেট যথেষ্ট ভালো না থাকায় নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে মলিন বইগুলোই কিনে নিতাম। প্রত্যেকটা বই এখনো শেলফে আছে, একেক সময়ের স্মৃতি হিসেবে।

পাঠ্যবইয়ের বাইরে আমাদের আনন্দের প্রধান খোরাকই ছিল বই পড়া। কখনো লুকিয়ে শেলফ থেকে বড় বোনের বই পড়তাম, স্বাভাবিকভাবে এতেও থাকত নানান বিধিনিষেধ। তারপর তো হাইস্কুল থেকে সায়েন্স, কমার্স, আর কলেজের স্বল্প সময়ে নানা জটিল পাঠ্যবই। খুব বেশি সময় কোথায় গল্পের বই পড়ার! এর মাঝেও হয়তো হঠাৎ কোনো অবসরে তিন গোয়েন্দা বা সেবা প্রকাশনীর বই পড়তাম। যখন শুরু করতাম, টানা চার-পাঁচদিন এর মধ্যেই ডুবে থাকতাম।

এরপর তো অ্যাডমিশন টেস্টের ভর্তি যুদ্ধে পাস করে এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে। গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা পড়ায় ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম এমন বহু প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় নিয়ে পড়তে হয়েছে। শিক্ষক এবং নতুন বন্ধুমহলও নানান বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। যে বই বিদ্যালয় পরিসরে জানতাম পড়া যাবে না, শিক্ষকরা বললেন দুনিয়া, রাজনীতি, শোষণ বুঝতে হলে সেগুলো পড়তে হবে। তখন শুরু হলো, বই কেনার হিড়িক। এর ওপর নিজ ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে বইমেলা। পাশেই নীলক্ষেত। চারুকলা, শাহবাগ মোড়েও বইয়ের দোকান, আছে লাইব্রেরি। নিজ দেশের গুটিকয়েক লেখকের বই ছেড়ে সাহিত্য, নানা প্রশ্ন করার যেই চর্চা, ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালো জানবার নতুন দিকের হাতেখড়ি আমার এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই।

শহিদুল জহিরকে ছাড়িয়ে মার্কেজ, মুরাকামির জাদুবাস্তবতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা কিংবা সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, হুমায়ুন আজাদ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জন মিল্টন কত কিছুর মধ্য দিয়ে যে নতুন এক নিজেকে গড়া হয়েছে! পশ্চিমবঙের নকশাল, সুনীল, সমরেশের কলকাতার অলিতে গলিতে কত চরিত্রকে মনে হয়েছে নিজের মতোই। সে সময়টায় বৃত্তি, ঘর থেকে নেওয়া হাতখরচা বা কয়েক মাস টিউশনির টাকা দিয়ে বই কিনেছি। সে সময়টায় পকেটে অর্থ ছিল স্বল্প, কিন্তু বই কেনার নেশা এবং পড়ার সময় দুটোই ছিল ব্যাপক।

এরপর শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবন, তাও আবার শিক্ষকতায়। এখন পড়াশোনা হয় গবেষণার লিটেরেচার কেন্দ্রিক, মেথডোলোজি নিয়ে। এক সময় এ পেশায় আসতে চেয়েছি পড়তে পারব বলে। অফিস শেষে নতুন করে পড়বার সময় খুঁজে বের করতে যাতে না হয়। কিন্তু এখন এত এত শিক্ষার্থীর জন্য লেকচার, ক্লাস তৈরি করে সাহিত্য পড়বার সেই ভর দুপুরগুলো আর কোথায়! স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে যে ভাবে বই পড়েছি, এখন তো সেই ছুটি মেলে না। পকেটে যা দু পয়সা আছে, কিন্তু এখন সময়ের অভাবটাই মুখ্য। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র, 'মহানগরের' মতোই বলতে হয়, রুটি রোজগার করতে গিয়ে আমাদের শখগুলোকে আমরা কোথায় যে হারিয়ে ফেলি!

 

Comments

The Daily Star  | English
Tariffs

Economic lessons from the tariff war

Our understanding of tariffs might not be complete.

9h ago