বইমেলায় ভালো বই খুঁজে পাবেন কীভাবে
যারা সরাসরি সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের মানুষ নন, তাদের জন্য বইমেলা থেকে ভালো নতুন বই খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটা মনে হয় খুব একটা সহজ না।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়েছি। আমার বাবাও ছিলেন সাহিত্যের ছাত্র। সাংবাদিকতা করেছি আট থেকে নয় বছর। পাশাপাশি, ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের কিছু মানুষের সঙ্গে আমার সংযোগ আছে। তাই নতুন বইয়ের খবর আমার কাছে এমনিতেই কিছু কিছু পৌঁছে যায়। কিন্তু যাদের এই সুবিধাটা নেই, তারা বলে যে বইমেলায় ভালো বই নেই।
বইমেলা থেকে প্রতি বছরই আমি কমবেশি আট থেকে ১০টা বই কিনি। তার মধ্যে ফিকশন বা উপন্যাসের সংখ্যা খুবই কম। আমার পছন্দ মূলত নন-ফিকশন, ইতিহাস, রাজনীতি, বিজ্ঞান (বিশেষ করে মহাকাশবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, প্রযুক্তি), সাহিত্য, চিত্রকলা। এগুলোতেই আমার আগ্রহ বেশি। সঠিক হিসাব বের করা হয়তো মুশকিল হবে যে, বইমেলায় প্রতিবছর কত সংখ্যক নতুন নন-ফিকশন বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার ধারণা সংখ্যাটা কয়েক হাজারের কম হবে না। এটাও স্বাভাবিক যে তার সবই খুব ভালো মানের লেখা না। তবে ভালো নন-ফিকশন বইয়ের সংখ্যাও একেবারে কম হবে না। সেগুলো খুঁজে বের করার আমার একটা পদ্ধতি আছে। সেটা হয়তো আরও অনেকেরই আছে। আজকের লেখাটা তা নিয়েই।
আমি সাধারণত প্রতি বছর দুই থেকে তিনবার বইমেলায় যাই। এর মধ্যে অন্তত দুবার যাই শনিবার সকালে, ১১টা বা সাড়ে ১১টার দিকে। খুব সম্ভবত সপ্তাহে ওই একদিনই সকালে বইমেলা খোলে। শনিবার ১১টা থেকে ১২টা থাকে শিশুপ্রহর। ওই সময়টা বইমেলায় ভিড় কম থাকে। এর মধ্যে একবার যাই বইমেলা শুরু হওয়ার পর প্রথম শনিবার। সেদিন আমি যেটা করি তা হলো—যতগুলো সম্ভব স্টলে যাই এবং সেখান থেকে গ্রন্থ তালিকা বা ক্যাটালগগুলো সংগ্রহ করি। সেদিনটা বই কেনা হয় খুব কম। নজরকাড়া কিছু চোখে পড়লে হয়তো কিনি।
সেদিন আরও একটা কাজ করি—বইমেলার মানচিত্রটা যতখানি সম্ভব মাথায় গেঁথে নিই। প্রতিবছরই স্টলগুলোর অবস্থান কিছুটা পরিবর্তিত হয়। যতদিন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মেলা সীমাবদ্ধ ছিল, তখন অনেক বেশি পরিবর্তন হতো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা বর্ধিত হওয়ার পর থেকে এখন কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। বেশিরভাগ বড় প্রকাশনীগুলোর স্টল বা প্যাভিলিয়ন প্রতিবছর কমবেশি কাছাকাছি জায়গাতেই থাকে। তারপরও, কোন প্রকাশনীর স্টল কোনদিকে সেটা মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে নিতে হয়। পাশাপাশি কত থেকে কত সিরিয়ালের স্টল কোন এলাকায় তারও একটা ধারণা নিয়ে নিই। বড় প্যাভিলিয়নগুলোর অবস্থানও বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ পরের বার যেদিন মেলায় যাব, সেদিন যেহেতু বই কেনার উদ্দেশ্য নিয়ে যাবে, তাই কোনো একটা নির্দিষ্ট স্টল খুঁজে পেতে দিশাহীনভাবে ঘুরে সময় নষ্ট করতে চাই না।
এরপর বাড়ি ফিরে প্রতিটা ক্যাটালগ একটা একটা করে মনোযোগ দিয়ে দেখি। বছরের নতুন প্রকাশিত বইগুলোর নাম এবং লেখকের নাম খুব ভালো করে দেখি এবং সেখান থেকে যেগুলো দেখে আমার আগ্রহ তৈরি হয়, সেগুলো টুকে রাখি। মাঝে একটা শনিবার সাধারণত বাদ দিয়ে যাই, কারণ ক্যাটালগে লেখা থাকলেও অনেক বই প্রকাশিত হতে হতে ১৫-২০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। মোটামুটি তৃতীয় শনিবার আবার যাই, এবার শুধুই বই কিনতে। যে নামগুলো টুকে রেখেছি, সেগুলো স্টলে গিয়ে উল্টেপাল্টে দেখি। যতগুলো নাম টুকে রাখা হয়েছে, সবগুলো হয়তো কেনা হয় না। উল্টেপাল্টে দেখার পর পছন্দ না হওয়ায় কিছু কিছু বাদ পড়ে যায়।
এ বছর থেকে দেখছি বাংলা একাডেমি একটা আলাদা ওয়েবসাইট করেছে—সেখানে কোনো প্রকশনীর নাম দিয়ে সার্চ করলেই স্টল বা প্যাভিলিয়ন নম্বর পাওয়া যাচ্ছে। এটা হয়তো আগেও ছিল, আমার চোখে পড়ল এবারই প্রথম। পাশাপাশি বইমেলায় এখন অনেকগুলো তথ্যকেন্দ্র থাকে। সেখানে কোনো প্রকাশনীর নাম, স্টল বা প্যাভিলিয়নের নম্বর জিজ্ঞেস করলেই সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় সেটা কোনদিকে গেলে পাওয়া যাবে।
ভালো নতুন বই সম্পর্কে জানার আরও একটা রাস্তা আছে। পরিচিত অনেকেই বইমেলা থেকে তারা যেসব বই কিনেছেন তার ছবি ফেসবুকে দেন। সেখান থেকেও ভালো বইয়ের খোঁজ মেলে। আমি নিজেও বই কেনা শেষ হয়ে গেলে একটা ছবি দিই প্রতিবছর ফেসবুকে, যাতে আমার পরিচিতজনের সেটা দেখে নতুন বই সম্পর্কে জানতে পারেন। এখন অনেক প্রকাশনীরই নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক পেজ আছে—সেখান থেকেও নতুন প্রকাশিত বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। তা ছাড়া, রকমারির মতো ই-কমার্স সাইটেও বইমেলার নতুন বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়।
তবে এই উৎসগুলোকে ব্যবহার করে আপনার পছন্দের বই খুঁজে পেতে হলে আপনাকে আগে ভালো করে বুঝে নিতে হবে আপনি কী ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন। অনেকেই পাঠক হিসেবে সর্বভূক। কিন্তু তাদেরও আমার ধারণা পছন্দের বইয়ের ধরন আছে। তাই আপনি কোন ধরনের বই পড়তে ভালোবাসেন, সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে যদি বইমেলায় দিশাহীনভাবে ঘুরে বেড়ান, তাহলে লাখো বইয়ের মাঝ থেকে ভালো বই খুঁজে বের করাকে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো কষ্টকর কাজই মনে হবে।
লেখক: কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ
Comments