মিনা দাস থেকে কবরী হওয়ার আখ্যান

কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর নার্গিস, কবি ও রহস্যময়ী এবং আশালতা তার অন্যতম সৃজনকর্ম। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে তিনটি উপন্যাস। এছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন নিয়ে তিনি লিখেছেন অভিযুক্ত নামক এক উপন্যাস। নগর জীবনের বহুমুখী জটিলতা ও নাগরিক জীবনের নানামুখী সংঘাত নিয়ে তিনি লিখেছেন খুন ও আনন্দ কুসুম। একুশে বইমেলায় প্রকাশিত কবরী ফিল্মের কোনো নায়িকার জীবন নিয়ে লেখা 'এদেশের প্রথম উপন্যাস'।
কবরী ফিল্ম জগতে প্রথম উপস্থিত হন মাত্র ১৩ বছর বয়সে। তা-ও শখে। নিম্নবিত্ত বাবা দুই সংসারের অনেকগুলো ছেলেমেয়ের ব্যয়ভার বহন করতে ক্লান্ত। সেই ক্লান্ত বাবার এই একান্নবর্তী পরিবারের চাকা সচল করার ভার পড়ে ভাগ্যক্রমে কবরীর উপর। সিনেমায় যাওয়ার আগে কবরীর পারিবারিক নাম ছিল মিনা। বাবা কৃষ্ণদাস। মা লাবণ্যপ্রভা দাস। কবরীর পিতৃভূমি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায়। জীবনের প্রথম যুগ তার কাটে ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায়।
প্রবাদ আছে ভাগ্যের লিখন, না যায় খণ্ডন। সিনেমা জগতে পা দেওয়ার সাথে সাথে কবরীর জীবনে ঘটে যায় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়েও তিনগুণ বয়সী চিত্ত চৌধুরীর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন কবরী। অবশ্যই যেটাকে বর্তমান সময়ে ফোর্সড ম্যারেজ বলা হয়। এমন অসম-বয়সী বিয়ের উদাহরণ আমরা পাই রোডেশিয়ান লেখক ডরিস লেসিং'র 'দ্য গ্রাস ইজ সিঙিং' উপন্যাসে। বিয়ে সম্পর্কে আধুনিক কবি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের কবিতায় এসেছে; বিয়ে/অমিল অনেক, এক পুরুষ ও এক নারী/ বহতা নদী এক/বেয়ে পড়ে এক মাঠে। কিন্তু, এই বিয়ে কোনোভাবেই বহতা নদীর মতো ছিলনা কবরীর জন্য। তার জন্য হয়ে উঠে অমিলের কারখানা। জীবন হয়ে উঠে তাঁর বিভীষিকাময়।
সৃজনশীল মানুষের মন কোমল হয়। তারা নিজের আবেগকে বিশ্বাস করেন এবং নিজের হৃদয়ের জন্য যা কিছু ভালো প্রতীয়মান হয় তাকেই তারা বেছে নেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এভাবেই উঠে এসেছে আমেরিকান দার্শনিক এমারসনের লেখায়। তাই শিল্পী বা সৃজনশীল মানুষের সাথে আচরণও হওয়া চাই অত্যন্ত সংবেদনশীল। কিন্তু, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সিনেমার প্রযোজক স্বামী চিত্ত চৌধুরীর কাছে কবরী হয়ে উঠেন টাকা কামানোর যন্ত্র যেন এক। যা কবরীর সংবেদনশীল মনে আঘাত করে নেতিবাচকভাবে। ভারতীয় ইংরেজি ভাষার ঔপন্যাসিক আর কে নারায়ণের দ্য গাইড উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজুও একই ভুল করে তার নৃত্য-শিল্পী সঙ্গী রোজির সাথে।
খ্যাতি একটা ভ্রমর বলেছেন এমিলি ডিকিন্সন। এটা গান গায়। কিন্তু, হূলও দেয়। খ্যাতির পথে মসৃণ নয়। অজানা-অচেনা মিনা যখন সিনেমার কবরী হয়ে উঠেন, তার সেই খ্যাতি কাল হয়ে উঠে ব্যক্তিজীবনে। দুনিয়ার কাছে তিনি ক্রেইজ নায়িকা, আর চিত্ত চৌধুরীর কাছে সে কেউ না। তার নোবডি থেকে সামবডি হয়ে উঠার পথটা এতটাই অমসৃণ ছিলো যা তার পরবর্তী জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। এমিলি ডিকিন্সনের একটি কবিতার লাইনের মতো হয়ে উঠে তার জীবন। "আমি কেউ না, তুমি কে?' কবিতায় ডিকিন্সন বলেছেন, পরিচিত হওয়াটা ভয়ংকর।
দুইজন মানুষ দাম্পত্য জীবনে যখন প্রবেশ করে তখন তারা মূলত একে অপরের উপর নির্ভর করতে চায়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস তাদের জীবনকে করে তোলে 'স্বর্গীয় বাতাসের বহর'। কিন্তু, এর অন্যথাও ঘটে কারো কারো জীবনে। সংসারে থেকেও কবরী বিচ্ছিন্নতাবোধ করতে থাকেন। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ তাকে কাছাকাছি নিয়ে খ্যাতিমান লেখক ও সিনেমা প্রযোজক জহির রায়হানের। জহির রায়হানের সাথে স্বল্প সময়ের বন্ধুত্ব, প্রেম, সে প্রেম থেকে পালিয়ে বিয়ে, চিত্ত চৌধুরীর চালাকিতে সে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া সবই ঘটে যায় কবরীর জীবনে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো।
উপন্যাসে কথিত সাংবাদিক সজীব চৌধুরীর সাথে কথোপকথনে এর পর ফুটে উঠে কবরীর জীবনের আরেক অধ্যায়। এবার তার জীবনে কিছুটা ইতিবাচকতার সন্ধান আসে। চিত্রনায়ক রাজ্জাকের সাথে অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব ও নির্ভরতার এক সম্পর্ক। লেখক যাকে ব্যাখ্যা করেছেন,' বন্ধুত্বের চেয়ে একটু বেশি, প্রেমের চেয়ে একটু কম।' প্রসঙ্গে কবরীর একটা উদ্বৃতি এখানে উল্লেখ করা যায়। "আসলে আমার তো কোনো সংসার ছিল না সজীব। দুটো ছেলে ছিল, এইটুকুই যা পিছুটান। এছাড়া আমার সংসার বলো, প্রেম ভালোবাসা বলো- সবই এই সিনেমা। এখানকার মানুষগুলোই আমার আপনজন।" কিন্তু, পেশাগত হিংসার বলি হয়ে রাজ্জাক-কবরীর সে সম্পর্কের যবনিকাপাত ঘটে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে কবরী ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেন। সেখান থেকে অভিনয়ের মাধ্যমে দেশের জন্য তহবিল গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সলিল চৌধুরীর উদ্যোগে মেগাফোন কোম্পানি থেকে 'আমি মুজিদের মা' নামক যে স্ক্রিপ্ট, গান ও কথামালার রেকর্ড বেরিয়েছিলো সেটাতে তিনি আবৃত্তি ও অভিনয় করেছিলেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে শরণার্থীদের জন্য টাকা তোলা, ত্রাণ বিলি করা ও রক্তদান কর্মসূচীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন কবরী।
দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে খলিল জিবরান বলেছেন, 'তোমরা একসাথে জন্মেছিলে বাঁচবেও একসাথে আজীবন।/ যমদূত এসে ঘাড় চেপে ধরার আগমুহূর্তেও তোমরা একসাথে থাকবে।/ হ্যাঁ, তোমরা খোদার রহমতে একসাথে থাকবে।/কিন্তু, দুজনের পথচলায় একটা ব্যবধান রাখবে।এবং দুজনের মাঝে স্বর্গের বাতাস বইতে দিবে।' কবরীর দাম্পত্য জীবন ঠিক এমন সুখকর ছিলোনা। তিনি এবার ঘাট বাঁধলেন নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত ওসমান পরিবারের সারোয়ার ওসমানের সাথে। কিন্তু, তাদের দীর্ঘদিনের দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরে কবরী যখন নারায়ণগঞ্জ থেকে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পান।

কবরীর জীবনে সবচেয়ে বড়ো বিপত্তি ঘটে শামীম ওসমানের মতো খলনায়কের সাথে তাঁর প্রতিনিয়ত টিকে থাকার ধন্ধ। রাজনীতিতে কবরীর পথচলা সুখকর ছিল না। কারণ তিনি জানতেন, নারায়ণগঞ্জে কোনো আওয়ামীলীগ ছিল না। ছিলো শামীম ওসমান লীগ। একবার এমপি হওয়ার পর দ্বিতীয়বার মনোনয়ন পাননি কবরী। কারণ তিনি শামীম ওসমানের মতো দুর্বৃত্তের মতো নেতিবাচক উপায়ে শেখ হাসিনার মন যোগাতে পারেননি। কবরীর বয়ানে লেখক বলছেন, 'আসলে কী জানো, আপা (শেখ হাসিনা) আমাকে আর আইভিকে সহ্য করে, আর শামীম- নাসিমকে ভালোবাসে।' এভাবে রাজনীতিতে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয়।
তের বছর বয়সে ঘরছাড়া হওয়া কবরী সারাজীবন যাকে কাছে পেয়েছেন নিজের করে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছেন। কৈশোরের প্রথম প্রেম অসীমবাবু থেকে, চিত্ত চৌধুরী, জহির রায়হান, রাজ্জাক,ও সারোয়ার কেউই তাকে আঁকড়ে থাকেননি। সবাই কেটে পড়েছেন সময়ের প্রয়োজনে। সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়েছেন। পড়ালেখা করিয়েছেন। শেষে করোনায় কবলে পড়ে এই অভিনেত্রী অনেকটা স্বজনহীন অবস্থায় পরকালে পাড়ি জমান। সাংবাদিক সজীব চৌধুরীর সাথে তার কথোপকথনের এক পর্যায়ে ফুটে উঠে তাঁর অন্তরের হতাশা। আজীবন সংগ্রামী কবরীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত করা হয়নি উল্লেখযোগ্য অর্থে। বরং তাকে 'অপর' করে রাখা হয়েছে।
কবরীর জীবন ছিলো ঘাত-প্রতিঘাত ও উত্থান-পতনের সমাহার। অজানা অচেনা মিনা থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সারাহ বেগম কবরী। পুরুষ শাসিত সমাজের শত রক্তচক্ষু তিনি উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন তার মেধা ও অভিনয় প্রতিভা দিয়ে।
বাংলাদেশের সিনেমা, সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতি জগতের যে দিকে কখনো আলোকপাত করা হয়নি লেখালিখি কিংবা বায়োপিক নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর হাতে সে কাজের সূচনা হলো কবরী লেখার মাধ্যমে। শিল্পীর জীবনের করুণ দশা ও আর্তি নিয়ে কাফকা রচিত "আ হাঙ্গার আর্টিস্ট" সম্পর্কে আমরা জানি। আমরা নজরুলের ' আমায় নহে গো, ভালোবাসো মোর গান' এর আদলে আমরা শিল্পী, লেখক/ অভিনেত্রীর কর্ম উপভোগ করি। কিন্তু, তাঁরা খ্যাতির দেয়ালের আড়াল হলে কী অবস্থায় জীবন কাটান সে খবর আমরা রাখিনা। অনেক সৃজনশীল মানুষের শেষটুকু হয় একেবারে অবহেলায়, নির্জনে এবং বঞ্চনায়। কবরী উপন্যাসের শেষের দিকে নায়িকা কবিতার করুণ পরিণতির কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করে লেখক সেই বার্তা দিয়েছেন আমাদের।
কবরীর জীবন ছিলো ঘাত-প্রতিঘাত ও উত্থান-পতনের সমাহার। অজানা অচেনা মিনা থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সারাহ বেগম কবরী। পুরুষ শাসিত সমাজের শত রক্তচক্ষু তিনি উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন তার মেধা ও অভিনয় প্রতিভা দিয়ে। রাজনীতির মতো কলুষিত খেলায় তিনি একটা ইনিংস খেলেছেন অসম ও অন্যায্য প্রতিযোগিতায়। কবরীর জীবন থেকে আমাদের মেয়েরা শিখতে পারেন নানাভাবে। নিজের ইচ্ছের প্রতি সৎ থাকলে ও প্রতিজ্ঞার প্রতি দৃঢ়মনস্ক হলে জীবনযুদ্ধের উত্থাল তরঙ্গ ঠেলে এগিয়ে যাওয়া যায়। কামিয়াব হওয়া যায়। কবরীর জীবন আমাদের সেটাই শেখায়।
Comments