বিবিসির বিশ্লেষণ

যে কারণে ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়

হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর বিস্ময়কর এক ঘোষণা দেন ট্রাম্প। জানান, গাজার দখল নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার বাসিন্দাদের মিশর ও জর্ডানসহ অন্যান্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

এই ঘোষণায় তার ট্রাম্প প্রশাসনের সদস্যরাও হতবাক হয়ে পড়েন। অনেকেই পরে জানান, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। 

আজ বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসির বিশ্লেষণে দাবি করা হয়েছে, এই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়ন হবে না।

পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জনমত 

উত্তর গাজার জাবালিয়ায় আগুন পোহাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ছবি: এএফপি
উত্তর গাজার জাবালিয়ায় আগুন পোহাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ছবি: এএফপি

গাজার বাসিন্দাদের জর্ডান ও মিশরে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন ট্রাম্প। তার বর্ণনা অনুযায়ী, স্থানান্তর ও সরিয়ে নেওয়ার কাজটির অর্থায়ন করবে সৌদি আরব।

তবে বেশিরভাগ আরব দেশ ইতোমধ্যে এই পরিকল্পনা নাকচ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররাও এই চিন্তাধারার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনের স্থায়ী সমাধান হিসেবে দুই-রাষ্ট্র মতবাদের প্রতি নিজেদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে।

ইতোমধ্যে ইরান ও মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশ এতে নিন্দা জানিয়েছে।

মার্কিন সেনা মোতায়েনের জটিলতা

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা মোতায়েনের পরিণতি শুভ হয়নি বলেই ভাবেন মার্কিনীরা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা মোতায়েনের পরিণতি শুভ হয়নি বলেই ভাবেন মার্কিনীরা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

তবে বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের একটি অংশ সুযোগ পেলে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ড ছেড়ে যেতে আপত্তি করবে না।

তবে ১০ লাখ মানুষ সরে গেলেও আরও অন্তত ১২ লাখ মানুষ সেখানে থেকে যাবেন।

সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সেনা মোতায়েন করে বাকি বাসিন্দাদের জোর করে সরাতে হবে।

২০০৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর এ ধরনের কোনো উদ্যোগ সাধারণ মার্কিন জনগণের কাছে তেমন জনপ্রিয়তা পাবে না বলেই মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

পাশাপাশি, এ ধরনের উদ্যোগে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্টরা।

এই চিন্তাধারায় মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের অন্তিম সমাধান হিসেবে ইসরায়েলের পাশাপাশি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে গাজা ও পশ্চিম তীরের সমন্বয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়।

নেতানিয়াহুর সরকার বরাবরই এই সমাধানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।

তবে ৯০ এর দশক থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম উপকরণ হিসেবে চালু থেকেছে এই দুই-রাষ্ট্র নীতি।

ট্রাম্পের পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক আইনেরও লঙ্ঘন হবে।

বাড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা

জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ্র সঙ্গে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বৈঠক। ছবি: এএফপি
জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ্র সঙ্গে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বৈঠক। ছবি: এএফপি

ট্রাম্পের পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও তার বক্তব্যে এক সময় অসম্ভব বলে বিবেচিত একটি অবাস্তব চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে—এটাই নেতানিয়াহুর বড় পাওয়া।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই বক্তব্যের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ। তার যেকোনো বক্তব্য সারা বিশ্বের মানুষ গুরুত্ব সহকারে নেয়।

স্বল্প মেয়াদে তার ঘোষণায় মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি আরব রাষ্ট্র বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ট্রাম্পের অনুরোধ তারা রাখতেও পারছে না, আবার একেবারে ফেলেও দিতে পারছে না।

এই পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে 'ভঙ্গুর' হিসেবে বিবেচিত গাজার যুদ্ধবিরতি পুরোপুরি ভেস্তে যেতে পারে।

এ মুহূর্তে যে চুক্তির আওতায় যুদ্ধবিরতি চলছে, সেই চুক্তিতে রয়েছে বড় একটি ত্রুটি—কবে সংঘাতের স্থায়ী অবসান ঘটবে, সে বিষয়ে কোনো রূপরেখা নেই আবার যুদ্ধের পর গাজা শাসনের দায়িত্ব কারা পাবে, সে বিষয়টিও স্পষ্ট করা হয়নি চুক্তিতে।

এখন এই সমস্যার একটি সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন ট্রাম্প—হামাস বা ইসরায়েল নয়, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকবে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলেও ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা প্রভাবিত হবেন। 

ইসরায়েলের কট্টর ইহুদিবাদীরা মনে করেন, ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদী পর্যন্ত (বা আরও দূর পর্যন্ত) ভূখণ্ডের সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র তাদের ঈশ্বর-প্রদত্ত অধিকার। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিদায় করা হলে সেই স্বপ্ন আরও সামনে আগাবে বলে মত দেন বিবিসির বিশ্লেষক জেরেমি বাওয়েন।

নেতানিয়াহুর সরকারেও এই কট্টর ইহুদিবাদীরা অংশীদার হিসেবে আছেন—তাদের সমর্থন নেতানিয়াহুর অবস্থান টিকিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা রাখে। তারা সবাই ট্রাম্পের প্রস্তাবে উচ্ছ্বসিত।

তারা চায় শিগগির গাজার যুদ্ধ আবার শুরু হোক এবং গাজা থেকে ফিলিস্তিনি সরিয়ে ইসরায়েলিদের জায়গা দেওয়া সেই যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য।

অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মটরিচ জানান, ট্রাম্প গাজার ভবিষ্যত নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

'যারা আমাদের ভূখণ্ডে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তারা চিরতরে তাদের নিজেদের ভূখণ্ড হারাবে। অবশেষে এখন ঈশ্বরের সহায়তায় অবশেষে আমরা চিরতরে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিপজ্জনক চিন্তাধারাকে কবর দেব', যোগ করেন তিনি।

মধ্যপন্থী নেতারাও ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে।

ফিলিস্তিনিরা যা ভাবছেন

অপরদিকে, হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি সংগঠন ট্রাম্পের প্রস্তাবের জবাব দিতে সামরিক শক্তি ব্যবহারের কথা ভাবতে পারে। সে ক্ষেত্রেও ভেস্তে যাবে যুদ্ধবিরতি।

অনেকেই ট্রাম্পের সর্বশেষ উদ্যোগকে ১৯৪৮ সালের 'আল-নাকবা' বিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন। সে সময় অসংখ্য ফিলিস্তিনি তাদের নিজ ভূখণ্ড থেকে বাস্তুচ্যুত হন।

সাত লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলিরা জোর করে তাড়িয়ে দেয়। তাদের বেশিরভাগই আর কখনোই নিজ ভূখণ্ডের দখল ফিরে পাননি।

এখন আবারও ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

ইসরায়েলকে খুশি রাখতে ট্রাম্পের এই বক্তব্য?

হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুমে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ট্রাম্প-নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুমে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ট্রাম্প-নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি

ট্রাম্প অনেক সময়ই অনেক কিছু বলেন, যা পরবর্তীতে তিনি আর বাস্তবায়ন করেন না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদেও এই ধারা দেখা গেছে।

তার বক্তব্য গুলো অনেক সময় দরকষাকষি শুরুর প্রাথমিক বক্তব্যের মতো। 'গাজা দখলের' কথা দিয়ে আলোচনা শুরু করে হয়তো তিনি এটাই বলতে চেয়েছেন যে তার মূল লক্ষ্য গাজাকে হামাসের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবেন।

জানা গেছে, নোবেল শান্তি পুরষ্কারের আকাঙ্ক্ষা জেগেছে ট্রাম্পের মনে। ওই লক্ষ্যেও তিনি এ সব অদ্ভুত চিন্তাধারা প্রকাশ করে থাকতে পারেন।

যখন গাজা নিয়ে সারা বিশ্বে মাতামাতি চলছে, তখন ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশালে ইরানের সঙ্গে পরমাণু শান্তি চুক্তি করার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন।

দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংস করতে চেয়েছেন নেতানিয়াহু। ইরানের সঙ্গে মার্কিন পরমাণু চুক্তি তার পরিকল্পনায় ছিল না কখনোই।

ইরানের সঙ্গে চুক্তি করে ইসরায়েলিদের বেজার করার পাশাপাশি গাজা দখলের কথা বলে তাদেরকে খুশিও করেছেন ট্রাম্প—বিষয়টিকে এভাবেই দেখছে বিশ্লেষকরা।

তবে সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে আরও অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছেন এই বিশ্বনেতা—এতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

Comments

The Daily Star  | English
Chief Adviser Yunus calls for peace

Yunus condemns attack at Amar Ekushey Boi Mela, orders swift action

In a statement, the chief adviser denounced the violence, emphasising that it goes against the open-minded spirit of the book fair, which honours the language martyrs of February 21, 1952, according to the CA's press wing

7h ago