স্পিড ডেটিং সম্পর্কে জানেন তো?
তীব্র যানজটের শহর হিসেবে পরিচিত আমাদের ঢাকা। একবার যানজটে পড়লে যাকে বলে একেবারে শম্বুকগতিতে চলে গাড়ি। তবে এই শহরে ট্রাফিক জ্যামে পড়া গাড়ির চেয়েও ধীরগতির যদি কিছু থেকে থাকে, তা হলো রোমান্টিক সম্পর্ক।
বিয়ের আগে প্রেম! তা যেন এখানে পুরান ঢাকার গলিপথের মতো জটিল আর প্রেমের ব্যাপারে সামাজিক রীতিনীতি যেন সপ্তাহের পাঁচদিন মিরপুরের বাতাসের মান যেমন থাকে ঠিক তেমন। এটা এমন একটা শহর যেখানে ঘটকদের জয়জয়কার, সেখানে যদি আপনি স্পিড ডেটিংয়ের ধারণার কথা বলেন, তবে তা রোমান্টিক-কমেডি উপন্যাসের মতো শোনাবে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা যখন এই শহরে ডেটিং অ্যাপকে দূরে ঠেলে বাস্তবেই দেখা করার মতো বড় আয়োজন পরিকল্পনার গুঞ্জন শুনি, তখন অবাক হতে হয় বৈকি! মনে প্রশ্ন জাগে, ঢাকা কি আসলেই স্পিড ডেটিংয়ের জন্য প্রস্তুত?
কৌতূহল থেকেই ঢাকার সবচেয়ে বড় স্পিড ডেটিং ইভেন্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
আয়োজনে প্রবেশ করতেই মুগ্ধ হই, ভেতরে নাম-পরিচয় প্রকাশের কোনো বালাই নেই। কেবল একটি সংখ্যা দেওয়া হচ্ছে, ইভেন্টের সময় যেটাই হবে পরিচিতি। অনেকটা রোমান্টিক কমেডি কালকাট্রাজের অভিনব বন্দিদের মতো।
সেদিন সন্ধ্যার জন্য আমার পরিচয় ছিল 'তিন' সংখ্যাটি। সত্যি বলতে কী, বেশ নির্ভার লাগছিল। কারণ কোটি মানুষের এই শহরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা অনেকটা ভিড়ের মধ্যে খালি রিকশা পাওয়ার মতোই বিরল। সেখানে পুরো এক সন্ধ্যা পরিচয় লুকিয়ে কাটানো নিঃসন্দেহে দারুণ!
ছদ্মবেশ যেন শিল্প
শুরু থেকেই এই বেনামে চলার যে ব্যবস্থা তা আমাকে মুগ্ধ করে। নাম প্রকাশের ব্যাপার নেই, কে কোথায় চাকরি করে তা জানানোর বাধ্যবাধকতা নেই, নেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অন্যকে খোঁজার তাড়না; আমি শুধু 'তিন' নম্বর। আমার আশপাশে রয়েছে এরকম নম্বরধারী জনা বিশেক মানুষ। অনুভূতিটা ছিল দারুণ।
আমার পাশেই বসেছিলেন ১৩ নম্বর। তাকে রসিকতা করে বললাম, এখন একটি ট্রেঞ্চ কোট পরে সানগ্লাস চোখে দিলেই বেশ রহস্যময় আবহ তৈরি হবে। তিনি বললেন, এখানে আসায় তার এটা ভেবে সবচেয়ে ভালো লাগছে যে 'ক্রিপি টিন্ডার ডেটে' তাকে যেতে হচ্ছে না। টিন্ডারে পরিচয় হওয়া কারও সঙ্গে ডেটে যাওয়ার চেয়ে এখানে এসে যে স্বস্তি পাচ্ছি, সেটা আমিও না স্বীকার করে পারলাম না।
বরফ গলার সময়
সেদিনের সন্ধ্যাটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে ছিল সামাজিক জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত সময়। তাই আয়োজকরা আমাদের মধ্যকার বরফ গলার সুযোগ করে দিতে বিশেষ একটি খেলার ব্যবস্থা করেছিলেন।
আমাদের যে নম্বর দেওয়া হয়েছিল তা ছিল লাল ও সবুজ রঙের।
শুরুতেই কে কোন রঙের দলে তা জানতে চাওয়া হলো। সবাই হাত তুলে নিজেদের পতাকা দেখালাম আমরা।
এবার প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হলো লাল কার্ডধারীদের জন্য, 'কারও সঙ্গে সম্পর্কে থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে ফ্লার্ট করা কী স্বাভাবিক বলে মনে করেন?'
সবুজ কার্ডধারীদের জন্য বলা হলো, 'আপনার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ফেসবুকে পোস্ট করুন।'
আমরা এমন একটি শহরের বুকে বসে এই খেলাটি খেলছিলাম যেখানে লোক দেখানো হাসির পেছনে লুকিয়ে রাখি সত্যিকারের অনুভূতি। সেখানে প্রকাশ্যে নিজের সম্পর্কের কথা স্বীকার করা তো রীতিমতো অসম্ভব!
এসব প্রশ্ন আর অ্যাকটিভিটির মধ্যেই আমরা একে অন্যের সঙ্গে বেশ সহজ হয়ে উঠলাম। এরপর এলো আরেকটি খেলা। যেখানে আমরা বলেছিলাম নিজেদের জীবনের সবচেয়ে খারাপ ডেটিং অভিজ্ঞতাগুলো। যা শুনে নিজেরাই হেসে বাঁচি না।
এক অংশগ্রহণকারী স্মৃতিচারণ করে বললেন, কীভাবে একজনের সঙ্গে ডেট করতে গিয়ে পুরোটা সময় কেবল শেয়ারবাজার নিয়েই আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, 'আমার যদি ডেটে গিয়ে বিরক্তই হতে হয়, তাহলে তো অফিসে বসে বসের কথা শোনাই ভালো ছিল।'
এই হাসিঠাট্টার মধ্যেই স্পিড ডেটিং নিয়ে আমাদের মধ্যে যে দুশ্চিন্তা ছিল তা দূর হয়ে গেল।
১০ মিনিটের কথোপকথনেই অপ্রত্যাশিত সংযোগ
আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই আমরা যে কাজে গিয়েছি তাতে মনোযোগ দিলাম। আর সেটা হলো স্পিড ডেটিং। এতে আমাদের জন্য ছিল সাতটি রাউন্ড। যার প্রতিটির জন্য সময় বরাদ্দ ছিল ১০ মিনিট। নির্দিষ্ট সময় পরপর বেল বাজছিল যেন আমরা পরের রাউন্ডে যেতে পারি।
আমি আমার প্রথম ডেটের জন্য বসলাম। বেশ কৌতূহলীভাবেই প্রশ্ন করলাম, 'আপনার দিনটি কেমন ছিল?' দেখা গেল বিপরীতে যিনি বসে আছেন, তিনি বেশ ভালো বক্তা।
দ্বিতীয় রাউন্ডে আমরা পাঠাও রাইডারদের নিয়ে একচোট ঠাট্টা করলাম। দুজনেই একমত হলাম যে, রাইডাররা তাদের পিকআপ লোকেশন বাদে শহরের প্রতিটি গলি খুঁজে পায়।
চতুর্থ রাউন্ডে এসে আমি সত্যি সত্যিই কথোপকথন উপভোগ করতে শুরু করলাম।
আমার সন্ধ্যার 'চার' নম্বর সঙ্গীর গল্প বলার দক্ষতা ছিল দারুণ। তিনি বলছিলেন, সাধারণ চেনাজানা গণ্ডির বাইরে গিয়ে অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলাই ভালো। কারণ সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেবল কেপিআই পূরণ করা নিয়েই কথা হতে পারে।
আমি তার কথায় দ্বিমত পোষণ করতে পারলাম না। মাঝেমাঝেই এমন সব মানুষের সঙ্গে দেখা করা উচিত, যাদের সঙ্গে গল্প অফিসের গসিপ বা কাজের কথায় সীমাবদ্ধ থাকবে না।
এরপর পেলাম সেদিনের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র ২৩ নম্বরকে। আমরা আগের স্পিড ডেট নিয়ে বেশ হাসাহাসি করলাম যেখানে সঙ্গী ১০ মিনিট ধরে কেবল বিভিন্ন চিকিৎসাসংক্রান্ত কথাই বলে গেছেন।
২৩ নম্বরজন বললেন, 'ওই স্পিড ডেটে গিয়ে আমি কিডনি কীভাবে কাজ করে তার বিস্তারিত জেনে গেছি, যা আমি কোনোদিনই জানতে চাইনি।'
তিনি যখন এসব নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন, আমার মনে হলো তার সঙ্গে সত্যিকারের কোনো সংযোগ আছে আমার।
পুরো ইভেন্টে নাম-পরিচয় গোপন থাকলেও অনুভূতিগুলো ছিল একেবারে বাস্তব। কোনো ফিল্টার নেই, নেই সামাজিকতা রক্ষার বাধ্যবাধকতা। কেবল নিজের ভেতরের মানুষটার সঙ্গে কথোপকথন। আর এটা সত্যিই কাজে দিয়েছিল!
ঘটকের বাড়াবাড়ি আর সোশ্যাল মিডিয়ার ধাঁধা
সত্যি বলতে কী, আপনি যদি ঢাকায় বাস করেন এবং অবিবাহিত থাকেন; তাহলে আপনার রোমান্টিক অবস্থা আদতে একটি পারিবারিক বিষয়। আপনাকে দেখলেই কিংবদন্তি সব ঘটক আন্টিরা হামলে পড়বেন। এত দ্রুত তারা পাত্র-পাত্রীর খোঁজ আনতে শুরু করবেন যে আপনি সেগুলো ঠিকঠাক দেখে ওঠারও সময় পাবেন না।
এই ধরনের ঘটকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই উপায়ে ঘটকালি করে আসছেন। সাধারণত পারিবারিক কোনো মিলনমেলায় বা সাধারণ ডিনারের আড়ালেই চলে পাত্র-পাত্রী দেখার খেলা।
ফলে কোনো ঘটক যদি স্পিড ডেটিংয়ের কথা শোনেন, তাহলে নিশ্চিত মূর্ছা যাবেন। পরিচয়ের জন্য সময় মাত্র ১০ মিনিট, শুনে হয়তো চিৎকার করে উঠবেন তারা। তারচেয়ে বরং রফিক আংকেলের বড় ছেলে যে কিনা সদ্য কানাডায় চাকরি পেয়েছে, তার সঙ্গে দেখা করা যে ভালো হবে, সে উপদেশও দেবেন তারা।
তবে সত্যিই যদি ঢাকায় স্পিড ডেটিং শুরু হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, প্রথাগত ঘটক আন্টিদেরও এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। কারণ এটাই হবে সঙ্গী নির্বাচনের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এখন দ্বিমুখী তলোয়ারের মতো হয়ে গেছে। তাই অংশগ্রহণকারীদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। এই নিয়মটি নিয়ে আমি যতটাই ভয় পেয়েছিলাম, পরে ততটাই আশ্বস্ত হয়েছি।
এই শহরে যেখানে কেউ কারও সঙ্গে ডেট করছে এই খবর পেলেই তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায়, সেখানে কারও সঙ্গে দেখা করে, গল্প করেও তার ডিজিটাল প্রমাণ না রাখা রীতিমতো বিরল বলা যায়।
এক অংশগ্রহণকারী ফিসফিস করে বললেন, যদি এই স্পিড ডেটের ছবি ভাইরাল হয়ে যায়, তাহলে কী হবে বলুন তো?
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে স্রেফ মাথা নাড়লাম। জানেন তো? এই শহরের ফিসফাসগুলোও পূর্ণাঙ্গ গুজবে পরিণত হতে পারে।
নিরাপত্তাই প্রথম
দ্য অ্যাটেনশন নেটওয়ার্ক আয়োজিত এই ক্লোজ ডোর ইভেন্টে নিরাপত্তাকে প্রথম নিয়ামক ধরা হয়েছে। সেজন্য রাখা হয়েছিল বাউন্ডার আর লাল কার্ড ব্যবস্থা। যেন কোনো কথোপকথনে কেউ অস্বস্তি বোধ করলে লাল কার্ড দেখিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যেতে পারেন। কারণ স্পিড ডেটিংয়েও কিছু বিপদ হতে পারে। সেজন্যই বাউন্সারের ব্যবস্থা।
সম্পর্ক তৈরির নতুন যুগের সূচনা
তো, ঢাকা কি আসলেই স্পিড ডেটিংয়ের জন্য প্রস্তুত? এমন একটি শহর যে তার ঐতিহ্য ও আধুনিকতা নিয়ে গর্বিত, তার জন্য উত্তরটা হয়তো হ্যাঁ হবে।
এ বিষয়ে ১৩ নম্বর অংশগ্রহণকারী দারুণ উত্তর দিলেন। তিনি বলেন, 'এটা কেবল প্রেম খোঁজার বিষয় নয়। কখনো কখনো এমন মানুষের সঙ্গে দেখা করার বিষয়, যিনি আপনার কৌতুকগুলোকে ভয়াবহ মনে করবেন না। কিংবা এমন কারও সঙ্গে দেখা করার বিষয় যিনি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সহায়তা করবেন।'
আমার জন্য এই অভিজ্ঞতা ছিল এটা মনে করিয়ে দেওয়ার যে ঢাকার লোকেরা আসলে বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রযুক্তির আগ্রাসন আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের সেই সুন্দর বিষয়গুলো হারিয়ে গেছে। স্পিড ডেটিং সেই যোগাযোগটিই ফিরিয়ে আনছে, হোক না তা কেবল একটি সন্ধ্যার জন্য।
যখন আমি ইভেন্ট শেষ করে বের হচ্ছি, তখনো কিন্তু সবাই আমাকে 'তিন' নম্বর হিসেবেই চিনছে!
আমি জানি, ঢাকার ডেটিং সংস্কৃতি এখনো বেশ অগোছালো, কখনো কখনো ক্লান্তিকর। কিন্তু স্পিড ডেটিং হতে পারে স্মরণীয়। আপনি যদি মোবাইলের স্ক্রিন সোয়াইপ আর স্ক্রল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে এবার নতুন কিছু ট্রাই করে দেখতেই পারেন।
কে জানে, হতে পারে স্পিড ডেটিংয়ে পেয়ে যাবেন দীর্ঘ আলাপ চালিয়ে যাওয়ার মতো সঙ্গী। আর যদি তা নাও পান, ক্ষতি কী? নতুন গল্পের খোরাক তো পেলেন।
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments