কানাডার দর্শনীয় হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, কিভাবে চলে

কানাডার দর্শনীয় হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, ছবি উইকিপিডিয়া

আটলান্টিক সাগরকন্যার আর্শীবাদপুষ্ট প্রদেশ নোভাস্কোশিয়ার রাজধানী। বলছি তুষারশুভ্রতার কন্যা কানাডার কথা। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্যের অধিকারীণী কানাডা যার বিস্তৃতি সর্বউত্তরের নুনাভুট, ইউকন থেকে শুরু করে সর্বদক্ষিণের প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড, সেন্ট জোনস দ্বীপপুঞ্জ, নিউ ফাউল্যান্ড। মোট দশটি প্রদেশ এবং তিনটি প্রাদেশিক অঞ্চল৷

বইপ্রেমী মানুষের অভাব নেই হ্যালিফ্যাক্স শহরে। এখানে বাসে, ফেরীতে মানুষজন হারহামেশা বই পড়ে। কয়েকজন মানুষ আপনি পেয়েই যাবেন যারা বইয়ে ডুবে আছেন। শহরতলীতে মোট লাইব্রেরি রয়েছে চৌদ্দটি। আর অসংখ্য বইয়ের দোকান। কিছু কিছু বইয়ের দোকানে রয়েছে কফিশপও। বইয়ের এত সব সংগ্রহের মাঝে স্থানীয় সাংস্কৃতিক জিনিসপত্র সাজিয়ে ছোটখাটো প্রদর্শনীরও করেছেন কোন কোন আয়োজকেরা। বেশ নান্দনিক! বাংলাদেশে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে?

লাইব্রেরির প্রাণকেন্দ্র বলা যায় হ্যালিফ্যাক্স কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিকে। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন এই লাইব্রেরিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় বইয়ের তাক সাজানো রাখা কোন দালানকোঠা! আপনি চাইলেই একটি বই সরিয়ে নিয়ে আরেকটি বদলে নিতে পারবেন। পুরো কানাডার দর্শনীয় লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এর পূর্ব নাম ছিল স্প্রিং গার্ডেন মেমোরিয়াল লাইব্রেরি। 

১৮৬৪ সালে নোভাস্কোশিয়ার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবী স্যার উইলিয়াম ইয়ং ঋণগ্রস্ত হ্যালিফ্যাক্স লাইব্রেরি ক্রয় করেন এবং নগরীর প্রথম মুক্ত পাঠাগার স্হাপনের ইচ্ছা থেকে তা দান করেন। হ্যালিফ্যাক্স পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপনের মূল ধারণা এসেছে ব্রিটেনের 'ম্যাকানিকস্ ইনস্টিটিউটস্' থেকে। পৃথিবী ব্যাপী এই ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ভিক্টোরিয়ান আমলে সাধারণ মানুষের জ্ঞান চর্চার প্রসার ঘটাতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি  লাইব্রেরিতে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেওয়া হয়। সার্বিক অর্থায়নের ভার বহন করতেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিগণ। তারা এর বিনিময়ে সুশিক্ষিত এবং অধিকতর যোগ্য কর্মী বাছাইয়ের সুযোগ পাবেন এমন প্রত্যাশা করতেন। আবার এই জ্ঞান চর্চার সুযোগ জুয়াখেলা এবং মদের দোকানে পানাসক্তি কমাতেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে এমনটা প্রত্যাশিত ছিল।

বৃটেনের ধারায় অনুপ্রাণিত হ্যালিফ্যাক্স ম্যাকানিকস্ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রম কার্যক্রমে অংশ নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ নির্দিষ্ট অংকের বিনিময়ে বই ধার করে পড়তেন। পরবর্তীতে ১৮৬৪ সালে স্যার ইয়ং এর হস্তক্ষেপে  এটিকে বিনামূল্যে পড়ার কর্মসূচিতে পরিবর্তিত করা হয়। ১৮৯০ সালে তৎকালীন সিটি হল ভবনে লাইব্রেরি তার প্রথম স্হায়ী ঠিকানা খুঁজে পায়।

বর্তমান লাইব্রেরির অবকাঠামো

১৯৯৫ সালে হ্যালিফ্যাক্স পাবলিক লাইব্রেরি সিস্টেম প্রণয়ন করা হয়। এতে মূল হ্যালিফ্যাক্স শহরতলীর সাথে ডার্থমাউথ এবং রাজধানীর আশেপাশের সকল বিভাগগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়। ২০০৮ সালে হ্যালিফ্যাক্স মিউনিসিপালিটি সেন্ট্রাল লাইব্রেরি স্হাপন, অর্থায়ন মঞ্জুর করে এবং ২০১৪ সালে পূর্বের স্প্রিং গার্ডেন ব্রাঞ্চ বন্ধ হয়ে বর্তমান সেন্ট্রাল লাইব্রেরি স্থাপিত হয়। এখন এর চৌদ্দটি শাখায়  পাঠকগণ যে কোন লাইব্রেরি থেকে রেজিষ্ট্রেশন করে কার্ড নিয়ে বই পড়ার জন্য নিতে পারেন। ধারকৃত বই লাইব্রেরির যে কোন শাখায় ফেরত দেওয়া যায়। পরবর্তীতে অন্য কোন পাঠকের ওই একই বই পড়ার ইচ্ছে পোষণ না করার প্রেক্ষিতে বই রাখার মেয়াদ বাড়ানো যাবে। পুরো কাজই অনলাইনে বা ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে করা সম্ভব। প্রতিটি লাইব্রেরির নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে এবং এগুলো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থেকে পরিচালিত হয়।

কানাডার দর্শনীয় হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি সামনের দৃশ্য। ছবি লেখক

বর্তমানে হ্যালিফ্যাক্স এবং আশেপাশের লাইব্রেরির চৌদ্দটি শাখা- অলডার্নি গেইট, বেডফোর্ড, ক্যাপ্টেন উইলিয়াম স্প্রাই (স্প্রাইফিল্ড), কোল হারবার, ডার্থমাউথ নর্থ, হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, হ্যালিফ্যাক্স নর্থ মেমোরিয়াল, জে ডি স্যাটফোর্ড (হিউবার্ডস), কেসান গোডম্যান (ক্লেটন পার্ক), মসকোডোবয়েট হারবার, স্যাকভিল, সিট হারবার, ট্যানটালিয়ন, উডলন

সেন্ট্রাল লাইব্রেরি 

অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্যের নিদর্শন এই বিশাল বইয়ের পাঠাগারের নকশা আহবান করা হয় ২০১০ সালে। একটি আন্তর্জাতিক  নকশা প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে স্হানীয় সংস্থা ফাওলার বলড এন্ড মিচেল এবং ডেনমার্কের স্মিৎজ হ্যামার লেসেনকে নির্মাণ কাজের দায়িত্বের জন্য বাছাই করা হয়। নবনির্মিত লাইব্রেরি ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে উদ্বোধন করা হয় এবং এরপর থেকে সকলের বই পঠনে সময় কাটানো দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠে।

পাঁচ তলা ভবনের এই দর্শনীয় লাইব্রেরিতে  ক্যাফে, একটি ৩০০ সিটের মিলনায়তন, কমিউনিটি মিটিং রুমসহ অনেক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্হা রয়েছে। পরিবেশগত স্হায়ীত্বের বিষয়টি সামনে রেখে সংশোধনকৃত বৃষ্টির পানিকে লাইব্রেরির বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের ব্যবস্হা রয়েছে। লাইব্রেরি ভবনের ক্যাফের ব্যবস্থা রয়েছে ছাদে এবং প্রবেশপথ থেকে ভেতরে ঢুকে ডানদিকে। 

চিত্তাকর্ষক স্থাপত্যকর্মটির অন্যতম বিশেষত্ব হল এর পঞ্চম তলার দেওয়াল থেকে প্রসারিত খিলান (ক্যান্টিলিভার), ভেতরকার অন্দরের প্রতি তলার সোপানগুলোর আড়াআড়িভাবে অবস্থান যা যে-কোন দর্শনার্থীর নিচতলার প্রবেশপথে ঢোকার পর উপরের দিকে তাকালে চোখে অন্যরকম এক অনুভূতির সৃষ্টি করে নিঃসন্দেহে, কাচনির্মিত  ভবনের স্বচ্ছতা এবং শহুরে জীবনের প্রেক্ষাপটে রচিত এই ভবনকে কানাডিয়ান সরকার সর্বোচ্চ পুরস্কার লেফটেন্যান্ট গভর্নরস ২০১৪ এবং স্থাপত্যবিদ্যার স্বীকৃতিসরূপ ২০১৬ সালে গভর্নর জেনারেল মেডেল দিয়ে ভূষিত করেছে। 

বিভিন্ন ফ্লোরে ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ সুবিধা রয়েছে -বেসমেন্টে বর্তমানে পার্কিংয়ের ব্যবস্হা রয়েছে ৮৭ টি গাড়ির এবং ৫০টি সাইকেলের। প্রথম তলায় অভ্যর্থনা, ধারকৃত বই উত্তোলন, ক্যাফে, অডিটোরিয়াম, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, জনপ্রিয় এবং সেরা বইয়ের কর্ণার। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে বাচ্চা এবং কিশোর কিশোরীদের বইয়ের সংগ্রহ, অনুষ্ঠানের কক্ষ, কম্পিউটার, পড়ার জন্য উন্মুক্ত জায়গা, ইনডোর খেলার ব্যবস্থা এবং জনসাধারণের পড়ার জন্য তৃতীয় তলায় আদিবাসী গোষ্ঠীর সংগ্রহশালা, সবার জন্য পড়ার বইয়ের সংগ্রহ, বাংলা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য কর্ম, পাঠকের বসার এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা। চতুর্থ তলায় বিভিন্ন সহায়ক গ্রন্থ, নোভাস্কোশিয়ার স্হানীয় ইতিহাস বিষয়ক বইয়ের সংকলন, নীরবতা পঠনকক্ষ, তথ্যভিক্তিক বা নন ফিকশন সাহিত্যের ভান্ডার। পঞ্চম তলায় জনসাধারণের জন্য বসার ঘর, ক্যাফে, ছাদ এবং উপন্যাস এবং গল্পের সম্ভার। 

বই ধার এবং ফেরত দেওয়ার অভিনবত্ব

বই ধার করার কাজটি সরাসরি লাইব্রেরিতে এসে এবং অনলাইনে লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে গিয়েও করা যায়। বই কখন নেওয়া যাবে বা কখন পাঠকের জন্য উপলব্ধ হবে তার স্ট্যাটাস নিজের একাউন্ট থেকেই যে কোন সময় দেখে নেওয়া যায়। একজন পাঠক এককালীন ষাটটি বই অর্ডার করতে পারেন। এছাড়া আরও অনুষঙ্গ যেমন - বিভিন্ন  অডিও বুক বা, ম্যাগাজিন বা, সিডি বা ডিভিডি ধার করার নিয়ম রয়েছে। 

বইয়ের এবং অন্যান্য সকল ধারকৃত জিনিসের  মেয়াদ তিন সপ্তাহ বা একুশ দিন।  অন্য কোন পাঠক একই বই ধারের অনুরোধ বা হোল্ড না রাখার সুবাদে তিনবার একই বই  বা ম্যাগাজিন  পুনর্নবীকরণ করা যাবে। বই ফেরত দেওয়ার অভিনব কৌশল রয়েছে যা সত্যিই অসাধারণ!

হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বাংলা বই, ছবি লেখক

বই জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট জায়গায় একটি স্বয়ংক্রিয় প্রবেশপথ রয়েছে। ফেরত প্রদানকারী ব্যক্তি বইসমেত ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে বই প্রবেশপথের কাছাকাছি আনতেই আপনাআপনি সেই দরজা খুলে যায় এবং ভেতর থেকে একটি কণ্ঠস্বর নির্দেশনাবলী প্রদান করে। এরপর বই সেখানে রাখতেই তা কনভেয়র বেল্টের মাধ্যমে ভেতরে চলে যায়। প্রতিবার একটি বই ভেতরে জমা করা যায়।

বাংলা ভাষার সাহিত্যের সংগ্রহশালা

তৃতীয় তলার ভিন্ন ভাষাভাষী সাহিত্য বিভাগে রয়েছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ছোটখাট সংগ্রহ। প্রথম যেদিন এই দৃশ্য দেখেছিলাম খুব আনন্দিত হয়েছিলাম নিঃসন্দেহে। কারণ যে সিডনি, কেপ ব্রেটন শহরে আমার কানাডায় গোড়াপত্তন সে শহরে বাংলা সাহিত্যের কোন সংগ্রহ চোখে পড়েনি। ওখানকার তিনটি লাইব্রেরির কোথাও! এই লাইব্রেরিতে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের ৫৭টি বই। 

Comments