উইয়ের পেটে যাচ্ছে ৭ দশকের অমূল্য সংগ্রহ
ঐতিহ্যের ধুলো জমা পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গত শতকের চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে; ব্রিটিশ শাসনামলের শেষবেলায়। সে সময় অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পানিহারসহ আশপাশের অনেক এলাকার মানুষের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছিল এই গ্রন্থাগারটি।
কিন্তু অনাদর-অবহেলায় ৭ দশক ধরে আলো ছড়ানো গ্রন্থাগারটির দীপ্তি এখন নিভতে বসেছে। পাকিস্তান আমলে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এই গ্রন্থাগারটির অনুদানও বন্ধ আছে। এমন পরিস্থিতিতে সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে এখানকার সংগ্রহে থাকা সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি গ্রন্থ।
এর পাশাপাশি পাঠের যথাযথ পরিবেশ না থাকায় এখন এই গ্রন্থাগারে খুব বেশি পাঠক কিংবা সত্যিকারের 'গ্রন্থকীটের' দেখা মেলে না; বরং অনায়াসে চোখে পড়ে উইপোকার আনাগোনা। শত বছরের পুরোনো মূল্যবান সব বইয়ের পাতায় পূর্তি হচ্ছে এদের উদর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখান থেকে ৭২ বছর আগে এনাতুল্লাহ মাস্টার নামের এক সমাজহিতৈষী বাড়ির পাশে ২ শতক জমির ওপর গড়ে তোলেন এই গ্রন্থাগারটি। বর্তমানে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে এটি। তবু কখনো কখনো দুর্লভ বইয়ের টানে অনেক কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকরা ছুটে আসেন এখানে।
রাজশাহী শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের ডাইংপাড়া মোড়। এখান থেকে আরও ১২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম আইহাই। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় প্রত্যন্ত এ এলাকা সাঁওতাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। আইহাই গ্রামের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা সরু সড়ক পেরিয়ে পৌঁছানো যায় পানিহার গ্রামে।
সম্প্রতি গ্রন্থাগারটিতে গিয়ে এর বেহাল অবস্থা চোখে পড়ে। দেখা যায়, টেবিলের ওপর রাখা একটি পুরোনো পত্রিকার ফাইল উইপোকায় খাচ্ছে। আলমারিগুলো ঘুনে খাওয়া। ভেতরে রাখা বইগুলোর অবস্থাও করুণ। গ্র্রন্থাগারের দেয়ালজুড়ে টানানো রয়েছে বিখ্যাত মনীষীদের ছবি।
এ সময় অসহায় কণ্ঠে লাইব্রেরিয়ান মোয়াজ্জেম হোসেন অর্থাভাবে এখানকার মূল্যবান গ্রন্থগুলো সংরক্ষণ না করতে পারার আক্ষেপের কথা জানান।
মনে প্রশ্ন আসে, কীভাবে এমন প্রত্যন্ত একটি এলাকায় এ রকম একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হলো?
এলাকার প্রবীণ পাঠক রফিকুল আলম জানালেন, গ্রন্থাগারটির প্রতিষ্ঠাতা এনায়েত উল্লাহর বাবা ছিলেন একজন কৃষক। কৃষক হলেও শিক্ষানুরাগী এ মানুষটি ছেলেকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর হাইস্কুলে। ওই স্কুল থেকে বাংলা ১৩১৮ সনে এনায়েত উল্লাহ এন্ট্রান্স পাশ করেন। ওই সময়েই স্কুলের গ্রন্থাগারের সদস্য হন। গ্রামে ফিরে নিজের মতো করে একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন।
এলাকায় ফিরে এনায়েত উল্লাহ প্রথমে আইহাই গ্রামে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। মাসিক ১৫ টাকা বেতনে নিয়োগ করেন শিক্ষক। বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করতে থাকেন। সে সময় তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বই আনতেন কলকাতা থেকে। এ সময় পাঠ্যবইয়ের বাইরে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় থেকে অল্প অল্প করে বাইরের বইও সংগ্রহ করতে শুরু করেন। বইয়ের মোটামুটি একটা সংগ্রহ দাঁড়ালে ১৯৪৫ সালে একটি মাটির ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন লাইব্রেরিটি।
সে সময় লাইব্রেরির জন্য আরও বই সংগ্রহের জন্য এনায়েত উল্লাহ গ্রামের মানুষের সহযোগিতা চান। একই সময়ে এ এলাকা থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন তার সহপাঠী সাগরাম মাঝি। লাইব্রেরিটিকে সাজিয়ে তুলতে তিনিও সঙ্গী হন এনায়েত উল্লাহর।
লাইব্রেরিয়ান মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছ থেকে জানা যায়, গ্রন্থাগারটিতে বিভিন্ন সাময়িকী, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, অনুবাদ, ধর্ম-বিজ্ঞান, কবিতার বই, গোয়েন্দা উপন্যাস এবং উদ্ভিদ ও জীববিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৭ হাজার ৭০২টি বই আছে। ২০টি আলমারিতে রাখা আছে এগুলো। পাঠকদের জন্য আছে ৪টি টেবিল ও ২০টি চেয়ার।
মোয়াজ্জেম হোসেনের ভাষ্য, করোনাভাইরাস মহামারির আগেও লাইব্রেরিতে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ জন পাঠক আসতেন। এখন তা ১০ থেকে ১২ জনে এসে ঠেকেছে। তিনি বলেন, 'এখন টাকার অভাবে কোনো দৈনিক পত্রিকা রাখতে পারি না।'
গ্রন্থাগারটি ঘুরে দেখা যায়, এখানে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসিমউদ্দীন ও আবুল মনসুর আহমদ থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদ- সবার বই আছে। রয়েছে কলকাতার রজনীকান্ত দাষ সম্পাদিত শনিবারের চিঠি, মাসিক মোহাম্মদী, মাহে নও, জয়তী, নতুন দিন, জয় বাংলা, দৈনিক বাংলাসহ অনেক সাময়িকী। নতুন ভবনের ৩০টি ঘরের আলমারিতে এগুলো সাজিয়ে রাখা।
মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রী প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, পল্লীকবি জসিমউদ্দীন, কবি বন্দে আলী মিয়া ও উত্তরবাংলার চারণকবি আব্দুল মান্নানসহ আরও অনেক গুণীব্যক্তি এই লাইব্রেরি ঘুরে গেছেন।
পানিহার পাবলিক লাইব্রেরির সভাপতি আব্দুল মতিন জানান, পানিহার লাইব্রেরি ১৯৫৮ সালে মঞ্জুরি পায়। সে সময় এর পরিবর্তিত নাম হয় 'পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি'। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো এটি। বছরে অনুদান আসতো ৫০০ টাকা। ১৯৮০ সালে লাইব্রেরিটিকে জেলা প্রশাসকের অধীনে আনা হয়। ২০০০ সালে জেলা প্রশাসক গ্রন্থাগারটিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে হস্তান্তরের পর আনুদান আসা বন্ধ হয়ে যায়।
আব্দুল মতিন বলেন, 'লাইব্রেরির জন্য আগে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অনিয়মিতভাবে কিছু অর্থ পাওয়া যেত। তবে ২০১৭ সালের পর থেকে আবেদন করেও কোনো অনুদান পাওয়া যায়নি। আর নব্বইয়ের দশকে মাটির ঘরের পাশে পাকা ঘরটি করে দেয় উপজেলা পরিষদ।'
আব্দুল মতিন আক্ষেপ করে আরও বলেন, 'এখন আর আগের মত পাঠক আসে না এখানে। লাইব্রেরিটি বাঁচিয়ে রাখার মতো মানুষও কমে আসছে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন রাজনীতিবিদরা আসেন। তারা আশ্বাস দিলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন হয় না।'
খেয়াল করে দেখা যায়, শুরুতে যে মাটির ঘরে গ্রন্থাগারটির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, সেটার অবস্থান নতুন ভবনের পাশেই। তার বারান্দায় বিকালে কিছু বাচ্চা পড়ছে। জানা যায়, মাটির ঘরটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গণশিক্ষা কার্যক্রমের স্কুল আর রিডিং রুম হিসেবে।
গ্রন্থাগারে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গোলাম মোস্তফা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলা সাহিত্যের অনেক দুর্লভ সংগ্রহ আছে এখানে। এগুলো সংরক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।'
একই কথা বলেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী মাহাবুল ইসলাম। তার ভাষ্য, লাইব্রেরিটি দেখে তিনি একই সঙ্গে অভিভূত ও শঙ্কিত। প্রাচীণ এই গ্রন্থাগারটি টিকিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
লেখক ও গবেষক খান মো. রবিউল আলম বলেন, 'আমি কিছুদিন পানিহার লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। অসাধারণ সব বই-পত্রিকার সংগ্রহ তাদের। ৭২ বছর আগে এমন প্রত্যন্ত গ্রামে এমন একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলার কথা ভাবাই যায় না।'
বিষয়টি নিয়ে কথা হয়, গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জানে আলমের সঙ্গে। তার ভাষ্য, তিনি ২ দফায় পানিহার লাইব্রেরিতে গিয়েছেন। সহযোগিতার ব্যাপারে লাইব্রেরি পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করতে বলেছেন। কিন্তু তারা সেটা করেনি।
ইউএনও বলেন, 'আমি অনুরোধ করব তারা (লাইব্রেরি পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা) যেন অফিশিয়ালি যোগাযোগ করে।'
আর অনুদান না পাওয়ার ব্যাপারে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুরের বক্তব্য, 'পুরনো লাইব্রেরিগুলো অনেক সময় আবেদন করে না। তাই অনুদান পায় না। তবে এমন লাইব্রেরিগুলোর অনুদান পাওয়া উচিত। আমি বিভাগীয় লাইব্রেরিয়ানের মাধ্যমে এ ব্যাপারে খোঁজ নেব।'
Comments