বাংলাদেশকে ‘উগ্রবাদী রাষ্ট্র’ প্রমাণ করে লাভ কী?

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে এক তরুণীকে কান ধরে ওঠবস করানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু তরুণ ওই তরুণীকে শাসাচ্ছেন এবং লাঠি হাতে তাকে ঘিরে আছেন।

ঘটনার সূত্রপাত জানা যায়নি। তবে উত্তেজিত তরুণদের কথাবার্তায় মনে হয়েছে, তাদের আপত্তি রাতে ওই তরুণীর সমুদ্রে সৈকতে একা ঘুরতে আসা এবং তার পোশাক। অনেকগুলো উত্তেজিত তরুণের মাঝখানে একজন নারী বা একজন তরুণী কতটা অসহায়, সেটি ওই ভিডিওতে স্পষ্ট। প্রচলিত ধারণায় যেসব পোশাককে অশ্লীল বলে মনে করা হয়, মেয়েটির পরনে সেরকম পোশাকও ছিল না। তার চেহারা দেখে মনে হয়েছে, তিনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

ধরা যাক তার পোশাকটি আঁটোসাটো। তাতেই বা সমস্যা কী? তাকে শাসানো বা কান ধরে ওঠবস করানোর এই অধিকার তাদের কে দিয়েছে? গত ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যেখানে স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও বলেছেন, কেউ যেন আইন হাতে তুলে না নেয়; সেখানে এই তরুণরা, তারা যদি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও হয়ে থাকেন, সমুদ্র সৈকতে গিয়ে একজন তরুণীকে হেনস্থা করলেন কেন? রাষ্ট্র কি তাদেরকে এই দায়িত্ব দিয়েছে? যদি দিয়ে থাকে তাহলে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ কী?

তাছাড়া রাতে সমুদ্র সৈকতে কোনো নারী একা যেতে পারবে না বা তাকে সরকারনির্ধারিত পোশাক পরে যেতে হবে—এমন কোনো ঘোষণা কি এসেছে? এটাকে শুধু 'মব জাস্টিস' বলে জায়েজ করা যাবে? মব মানে কী? এখানে যারা মেয়েটিকে অপদস্থ করলেন তারা দেশের কত শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন?

এই ধরনের দৃশ্য তালেবানশাসিত আফগানিস্তান কিংবা শরিয়া আইন আছে এমন কোনো দেশে হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে কেন? বাংলাদেশ তো ধর্মীয় মৌলবাদীদের দেশ নয়। এখানকার মানুষ বরাবরই ধর্মভীরু এবং একইসঙ্গে উদার। অন্যের ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এখানে মাগরিবের আজানের সময় হিন্দুদের শঙ্খ বাজে। এ নিয়ে এই ভূখণ্ডে কোনো দাঙ্গা হয়নি। বরং যেসব সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে আছে ভোটের রাজনীতি। কিছু ঘটনার পেছনে আছে জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধ ও ব্যক্তিগত শত্রুতা।

কিন্তু সব সময়ই এগুলোকে ধর্মীয় রঙ দেওয়া হয়েছে মূল ঘটনা আড়াল করার জন্য। বছরের পর বছর ধরে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এই ধর্মীয় বিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে ভোটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেই একই ধারায় বাংলাদেশ চলতে পারে না।

কাছাকাছি সময়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এক তরুণ আরেকজন তরুণীকে কোলে করে কিছুটা পথ গেছেন। পরে আবার তারা হাঁটতে শুরু করেছেন। এই ভিডিওর নিচে অনেকেই এই যুগলের নানা সমালোচনা করেছেন—যা একধরনের সোশ্যাল পুলিশিং।

ধরা যাক তারা প্রেম করছেন। ক্যাম্পাসে কি নারী-পুরুষ একসঙ্গে বসে গল্প করা কিংবা প্রেম করা নিষেধ? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, কারা এই ধরনের ছবি তোলেন বা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন? এর মধ্য দিয়ে তারা কী বার্তা দিতে চান? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সারা বিশ্বের মানুষ এসব দেখার ‍সুযোগ পায়। ওই তরুণ-তরুণীর পরিবার আছে। তাদের সমাজ আছে। পরিবার ও সমাজের কাছে তাদের অসম্মানিত করে কার কী লাভ?

এর আগে গত মাসের মাঝামাঝি আরেকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায় কয়েকজন তরুণ একটি আবাসিক হোটেলে রেইড দিয়েছেন। একটি কক্ষ থেকে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষকে বের করে এনেছেন যারা স্বামী-স্ত্রী নন। তাদেরকে বকাঝকা করা হচ্ছে। ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে জেরা করা হচ্ছে যে, কেন তারা হোটেলে এসেছেন?

প্রশ্ন হলো আবাসিক হোটেলে রেইড করার অধিকার কি ওই তরুণদের আছে? দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ যদি কোনো ধরনের সম্পর্কে জড়ান, তাতে আরেকজনের সমস্যা কী? যদি এটা প্রচলিত আইনে অপরাধ হয়, তাহলে সেটির বিচারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত রয়েছে।

দুজন মানুষকে যে ক্যামেরার সামনে নিয়ে এসে পুরো জাতির সামনে হেনস্থা করা হলো, তাদের উভয়েরই পরিবার আছে। ওই পরিবার দুটিকে সামাজিকভাবে অসম্মানিত করার অধিকার কি কাউকে দেওয়া হয়েছে?

সম্প্রতি খুলনায় উৎসব মণ্ডল নামে এক তরুণকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে বেদম মারধর করা হলো। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মহানবীকে (স.) কটূক্তি করেছেন। প্রথমে একটি জাতীয় দৈনিকে ওই তরুণের মৃত্যুর খবর বলা হলেও পরে তারা লিখেছে তিনি বেঁচে আছেন। এখন তার ও তার পরিবারের কী অবস্থা, সে বিষয়ে একটা ফলোআপ রিপোর্ট হতে পারে।

প্রশ্ন হলো, একজন ব্যক্তি যদি মহানবী (স.) সম্পর্কে অবমাননাকর কোনো কিছু লিখে ফেসবুকে পোস্ট দেন বা চায়ের আড্ডায় কোনো আপত্তিকর মন্তব্য করেন, তারপরও কি তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা বা এমনভাবে মারা যায় যাতে তার জীবন বিপন্ন হবে? তাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে? স্বয়ং মহানবীও (স.) কি তার সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে এরকম ব্যবস্থা নিয়েছেন? তার সহনশীলতার যেসব ঘটনা বইয়ের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ, তার সঙ্গে এইসব ঘটনার কোনো মিল পাওয়া যাবে?

সম্প্রতি বেশ কিছু মাজার ভাঙা হয়েছে। অভিযোগ, এসব মাজারে অসামাজিক কাজ হয়। কেউ কেউ ফেসবুকে লিখেছেন যে মাজারে গাঁজা খাওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, গাঁজা বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য আরও অনেক স্থানেই খাওয়া হয়। সেসব জায়গায় কি হামলা চালানো হয়েছে? বলা হচ্ছে, মাজারে শিরক হয়। গান-বাজনা চলে।

বাস্তবতা হলো, সব মাজারের চরিত্র এক নয়। কিছু কিছু মাজার এখন মূলত পর্যটনকেন্দ্র। মানুষ সেখানে ঘুরতে যায়। কেউ কেউ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেও যায়। কেউ কেউ মনের আশা পূরণের জন্য মাজারে গিয়ে দোয়া করেন। কিন্তু কেউ যদি মাজারে গিয়ে সেজদা করেন, সেটি ইসলামের মূল চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

প্রশ্ন হলো, সবাই কি মাজারে গিয়ে সেজদা করেন? সবাই কি মাজারে গাঁজা খাওয়ার জন্য যান? মাজারকেন্দ্রিক ব্যবসা ও প্রতারণার অভিযোগও বেশ পুরনো। কিন্তু তারপরও কি এভাবে একটি মাজার গুড়িয়ে দেওয়া যায়? এই ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে কী বার্তা যাচ্ছে?

মাজার ভাঙার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, 'মাজার ভাঙ্গা হোক, মসজিদ ভাঙ্গা হোক, মন্দির ভাঙ্গা হোক; এগুলো গর্হিত কাজ। যেগুলো যেভাবে আছে, সেগুলো সেভাবে থাকা দরকার। আমরা দেশবাসীকে জানাতে চাই, আমাদের কম্যুনাল হারমোনি-ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট হওয়ার মতো কোনও ঘটনা যদি ঘটে, আপনারা আমাদের জানালে আমরা মুহূর্তের ভেতরে আইনগত ব্যবস্থা নিবো।' (বিবিসি বাংলা, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।

বাংলাদেশকে উগ্র ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র প্রমাণের চেষ্টা বহু বছর ধরেই চলছে। এটা প্রমাণ করা গেলে এখানে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাক গলানো সহজ। আবার প্রতিবেশী দেশও যদি বিশ্বকে এই বার্তা দিতে পারে যে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন ধরনের সরকার গঠিত হলেও দেশটা মূলত কট্টরপন্থিদের হাতে চলে গেছে—তাহলে এই সরকারকে বিতর্কিত ও বিব্রত করা সহজ।

সুতরাং কে কার স্বার্থে কাজ করছেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোনোভাবেই বিশ্বের কাছে এই বার্তা না যায় যে, বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়েছে। তাতে দেশের সাধারণ মানুষও বিরক্ত হতে থাকবে এবং যারা বহু বছর ধরে বাংলাদেশকে মৌলবাদী ও উগ্রবাদীদের দেশ হিসেবে প্রমাণ করে এখানে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে, তারাও ঝোপ বুঝে কোপ মারবে। এই সুযোগ কোনোভাবেই কাউকে দেওয়া যাবে না।

মনে রাখতে হবে, সবার আগে দেশ। কোনোভাবেই দেশকে বিপদে ফেলা যাবে না। এই দেশে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-আস্তিক-নাস্তিক-ধর্মভিরু ও ধর্ম পালন না করা মানুষ, সবাই একসঙ্গে বসবাস করবে। বাংলাদেশের মানুষ মূলত গণতন্ত্রকামী। অধিকাংশ মানুষই একনায়কতন্ত্র যেমন চায় না, তেমনি কট্টরপন্থাও চায় না।

অস্বীকার করা যাবে না, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পেছনে একটি বড় কারণ গণতন্ত্রহীনতা। গণতন্ত্র মানেই ভিন্নমত ও বক্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা। গণতন্ত্র মানে সহিষ্ণুতা। পরধর্মের প্রতি সহনশীলতা ইসলামেরও একটি বড় আদর্শ। অথচ সেই ইসলাম রক্ষার নামে কেউ যদি মাজার ভাঙে, তাহলে বুঝতে হবে তার ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে। যে ইসলাম নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় সবচেয়ে বেশি কথা বলেছে; খোদ পবিত্র কোরআন শরিফে নারী (নিসা) নামে একটি সুরা পর্যন্ত আছে, সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ যদি রাস্তায় কোনো নারীকে অসম্মান করে, নিগৃহীত করে, নারীর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়, তাহলে বুঝতে হবে যারা এই কাজ করছেন, তারা ইসলামের আদর্শ ও সৌন্দর্য থেকে বেশ দূরে আছেন।

সুতরাং এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। এসব মব ও কার্যকলাপের বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা এবং সেইসঙ্গে ব্যবস্থাও দৃশ্যমান করতে হবে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English

Crowd control: Police seek to stop use of lethal weapon

The police may stop using lethal weapons and lead pellets for crowd control as their widespread use during the July mass uprising led to massive casualties and global criticism.

9h ago