ঝুঁকি নিয়ে বন্যার্ত পরিবারের খোঁজে

ফেনী সদরের কাজীরবাগ ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতির গত সোমবারের চিত্র। ছবি: স্টার

'বুধবার থেকে টানা চারদিন আমরা পুরোপুরি পানিবন্দি ছিলাম। আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার তার বাবার বাড়িতে ছিল। মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকায় কিছুতেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। সিদ্ধান্ত নিই, যেভাবেই হোক তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। রোববার ভোরে মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে দেখি কাঁধসমান পানি। সেই পানির মধ্যে কোথাও হেঁটে, কোথাও সাতরে ওইদিন রাতে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাই।'

দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলছিলেন ফেনীর ফুলগাজীর একটি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে দেখতে বন্যার মধ্যেই ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শ্বশুরবাড়ি যান তিনি।

মোহাম্মদ উল্লাহ যে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন, সেটির অবস্থান ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের খিলপাড়া গ্রামে। আর তার শ্বশুরবাড়ির অবস্থান ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার মহামায়া ইউনিয়নের চাঁদগাজী গ্রামে।

কেবল মোহাম্মদ উল্লাহই নন, ডেইলি স্টারের কথা হয় আরও ইদ্রিস চৌধুরী ও মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন নামে আরও দুজনের সঙ্গে, যারা বন্যার মধ্যেই জীবনঝুঁকি নিয়ে ছুটে গেছেন ফেনীর দুর্গত এলাকায় থাকা প্রিয়জনের কাছে।

বিষয়টি নিয়ে তাদের ভাষ্য, বন্যা পরিস্থিতিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় কোনোভাবেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না তারা। এমন অবস্থায় অসহনীয় দুশ্চিন্তার মধ্যে সময় কাটাতে হচ্ছিল তাদের। পরে বাধ্য হয়েই তারা জীবনঝুঁকি নিয়ে রওনা হন।

ফেনীর বহু মানুষই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে এভাবেই ঝুঁকি নিয়ে গেছেন।

বন্যার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউনিয়নের খিলপাড়া গ্রামের মাদ্রাসাশিক্ষক মোহাম্মদ উল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বাড়ি ফেনী পৌরসভার মধ্যে। আমি জীবনে কখনো ফেনীতে বন্যা হতে দেখিনি। বুধবার ভোর থেকে মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকার গ্রামের বাড়িঘরে পানি ঢোকে। দুপুরে মাদ্রাসাতেও পানি ঢুকে। মাদ্রাসা আশপাশের এলাকার তুলনায় কিছুটা উঁচু স্থানে হওয়ায় গ্রামের সব মানুষ মাদ্রাসার সামনে এসে জড়ো হয়।

'মাদ্রাসা ভবন তিনতলা এবং মসজিদ দুইতলা হওয়ায় আমরা নারীদের মাদ্রাসা ভবনে এবং পুরুষদের মসজিদে আশ্রয় নিতে বলি। ধীরে ধীরে পানি বাড়ছিল। বৃহস্পতিবার পানির উচ্চতা হয় বুকসমান। মাদ্রাসায় কিছু কেনাকাটা করা ছিল। এ ছাড়া চাল-ডাল মজুত ছিল। এগুলো দিয়েই আমরা সবাই মিলে কোনোরকমে দিন চালিয়ে নিয়েছি।'

তিনি জানান, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার—এই চারদিন মাদ্রাসার সামনে ও নিচতলায় এতটাই পানি ছিল যে কেউ সেখানে দাঁড়ালে কেউ ঠাঁই পেত না। মাদ্রাসা ও মসজিদের মধ্যে দূরত্ব ৫০ ফুটও হবে না। সেখানেও নৌকা নিয়ে যেতে হয়েছে।

ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউনিয়নের গত মঙ্গলবারের বন্যা পরিস্থিতি। ছবি: স্টার

'আমি সারাক্ষণ আমার স্ত্রীকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একদিকে আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা, তার ওপর মোবাইল বন্ধ, বিদ্যুৎ নেই। মঙ্গলবার থেকে আমি কোনোভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিই, যেভাবে হোক শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। রোববার ভোরে যখন আমি বের হচ্ছি, তখন বাকিরা বললো আমি কি পাগল নাকি! গলাসমান পানির মধ্যে কীভাবে যাব। শেষপর্যন্ত এই পানির মধ্যেই আমি রওনা দিই। অনেক জায়গায় পানিতে ঠাঁই পাইনি, সেখানে সাঁতার কেটেছি। যেখানে পানি বুক-কোমরসমান, সেখানে হেঁটেছি।'

বন্যার মধ্যে দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার বিষয়ে এই মাদ্রাসাশিক্ষকের ভাষ্য, 'পথ যেন শেষই হতে চায়নি। আমার মতো এরকম অনেক মানুষ হেঁটেছে। রাস্তার পাশে কোথাও দোকান ছিল। সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার পানি ডিঙ্গিয়ে হাঁটা শুরু করি। রাতে যে খেয়েছি, সারাদিন আর কিছুই খেতে পারি নাই। সব তো বন্ধ, কীভাবে খাব! রাত আটটার দিকে ২৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ছাগলনাইয়া বাজারে গিয়ে উঠি। দুই পা অবশ হয়ে এসেছিল। এমন সময় একটা ট্রাক পাই, এই ট্রাকে করে চাঁদগাজী বাজারে গিয়ে নামি। বাড়িতে ঢুকতেই আমার স্ত্রী আমাকে দেখে কেঁদে ফেলে। স্বস্তির বিষয় হলো আমার শ্বশুরের ঘর কিছুটা উঁচু থাকায় ঘরে তেমন পানি ঢোকেনি।'

মোহাম্মদ উল্লাহর মতো একই পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ইদ্রিস চৌধুরী তোহাও।

মোহাম্মদপুরের বসিলায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইদ্রিস চৌধুরী তোহা ফেনীর বন্যা পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ঢাকা থেকে ফেনীতে ছুটে এসেছিলেন। ইদ্রিস চৌধুরীর বাড়ি ফুলগাজীর বদরপুর ইউনিয়নের উত্তর শ্রীপুর গ্রামে। তিনিও জানিয়েছেন দুঃসহ ওই অভিজ্ঞতার কথা।

বন্যার শুরুতে ইদ্রিস চৌধুরী তোহার স্ত্রী ও দুই বছর বয়সী শিশু সন্তানও আটকা পড়েছিলেন তার শ্বশুরবাড়িতে। তিনি বলেন, 'আমার বাড়ি থেকে আমার শ্বশুর বাড়ি ১০ মিনিটের হাঁটা দূরত্ব। বন্যা শুরুর কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল। মঙ্গলবার রাত থেকেই আমার শ্বশুরবাড়িতে পানি উঠতে শুরু করে। আমাদের বাড়িতে আমাদের ঘরটি চারতলা হলেও শ্বশুরবাড়ি ছিল একতলা।'

'কয়েকদিন ধরেই প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি স্ত্রীকে বারবার তাড়া দিচ্ছিলাম আমাদের বাড়িতে চলে যেতে। কিন্তু সে বৃষ্টি ও পানি কমার অপেক্ষা করে বলেছিল, পানি কমলে যাবে। বুধবার দুপুরের মধ্যে পানি শুরুতে হাঁটুসমান এবং বিকেলের মধ্যে কোমরসমান উচ্চতায় উঠে যায়। বাড়িটা কিছুটা নিচু ও পাশে খাল থাকায় দ্রুত পানি বাড়ছিল। পানি ওঠা শুরু করলে আমার স্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেয়। রাতের মধ্যেই বাড়ির নিচতলা প্রায় পুরোপুরি পানির নিচে চলে যায়। বৃহস্পতিবার ভোরে আমার স্ত্রী জানায়, মোবাইল যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক আমাকে বাঁচাও। আমি তখন বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেও কোনো উপায় পাইনি।'

তোহা বলেন, 'বৃহস্পতিবার ভোরের পর আমার স্ত্রীর সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু আমাদের বাড়ি উঁচু থাকায় আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে দু-তিনবার কথা হয়েছিল। সব সিমের নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকলেও টেলিটক সিমের মাধ্যমে আমি যোগাযোগ করতে পারছিলাম। তিনি জানান, তারা সবাই নিরাপদে আছেন। তবে তারাও আমার স্ত্রী ও তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। আমাদের বাড়ির সামনেও তখন বুক সমান পানি।'

'প্রচণ্ড রকমের দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। সিদ্ধান্ত নিই, যেভাবেই হোক আমাকে শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে। শুক্রবার সন্ধ্যায় রওনা দিয়ে সেদিন রাতে আমি আমার নানার বাড়িতে উঠি। পরদিন সকালে সবার অগোচরে আমি বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে যখন শহরের সালাউদ্দিন মোড়ে যাই, তখনই দেখি সেখানে কোমরসমান পানি। ভাবি এখানেই এই অবস্থা, তাহলে ভেতরের দিকে কী অবস্থা হবে! পরে হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে ফেনীর সদর হাসপাতাল মোড়ে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে এক ভয়াবহ অবস্থা দেখতে পাই। কোথাও কোথাও পানি এত বেশি যে ঠাঁই পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও গলাসমান পানি। এর মধ্যেই আমি এগোতে শুরু করি। হঠাৎ স্পিডবোটের পানির স্রোত আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। এই পানি ডিঙ্গিয়ে শরীর যেন কিছুতেই চলছিলো না।'

এই পরিস্থিতির মধ্যেই সাড়ে ১০ ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছান তোহা। 'বাড়িতে পৌঁছে যখন আমি বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেওয়া স্ত্রী ও সন্তানকে দেখলাম, পেছনে ফেলে আসা তীব্র কষ্ট মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল।'

ফুলবাড়ীর খিলপাড়া মাদ্রাসার বন্যা পরিস্থিতি। ছবি: স্টার

কথা হয় চট্টগ্রামের একটি স্টিল কারখানার কর্মচারী মোহাম্মদ মাইন উদ্দিনের সঙ্গে। মাইন উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি ফেনীর পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী ও মুহুরি নদীর তীরবর্তী মালিপাথর গ্রামে।  বন্যায় ফেনীর যেসব গ্রাম প্রথমেই আক্রান্ত হয়েছিল, তার মধ্যে মালিপাথর অন্যতম।

মাইনউদ্দিন বলেন, 'আমাদের এলাকায় ভয়াবহ বন্যা ছিল। আগের কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় এবং পানি আসায় ১৮ আগস্ট রাত থেকেই আমাদের গ্রামে পানি ঢোকে। আমার স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছে। বাড়িতে আমার বাবা-মা আর নয় বছর বয়সী ছেলে ছিল।'

'আমাদের ওই এলাকায় মুহুরি নদী হওয়ায় ভারতের পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে সেখানে বন্যা হয়। জুনের শেষদিকেও আমাদের গ্রামে বন্যা হয়েছিল। তাই আমরা কিছুটা অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এবারের বন্যা সবকিছু ছাপিয়ে গেছে। মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকে পরিবারের সঙ্গে আমার আর কথা হয়নি। সব বন্ধ হয়ে গেছে। টানা দুইদিন এভাবে চলল।'

একপর্যায়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে বৃহস্পতিবার রাতেই চট্টগ্রাম থেকে ফেনীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন মাইন উদ্দিন। বলেন, 'এদিকে যানজটের কারণে রাতেই ফেনীর লেমুয়া ব্রিজের আগে গাড়ি আটকে যায়। কিছুতেই এগোতে পারছিলাম না। এদিকে মহাসড়ক দিয়ে বন্যার পানি নামছিল। রাস্তার কোথাও কোথাও কোমরসমান পানি ছিল। আমি তখন রাতেই পায়ে হেঁটে মহিপাল পর্যন্ত যাই। রাতে হাজারী রোডে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। যেখানে ছিলাম সেখানে পানি ওঠেনি। পরদিন সকালে সেখান থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিই।'

মাইন উদ্দিন আরও বলেন, 'ফেনী থেকে আমাদের বাড়ি ৩০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে। আমি জানি না, আমার পক্ষে যাওয়াটা কতটুকু সম্ভব ছিল। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল যেভাবেই হোক আমাকে যেতেই হবে। প্রয়োজনে দুই তিনদিন লাগুক!'

তবে মাইন উদ্দিন কিছুটা ভাগ্যবান ছিলেন। গলাসমান উচ্চতার পানি ডিঙ্গিয়ে ও সাঁতরে ফেনী সদর উপজেলার শেষপ্রান্তে পৌঁছানোর পর ত্রাণ নিয়ে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের একটি স্পিডবোটের মাধ্যমে তিনি পরশুরাম পৌঁছাতে পেরেছিলেন। সেখান থেকে তিনি সাঁতরে ও পানি ডিঙ্গিয়ে বাড়িতে পৌঁছান।

মাইন উদ্দিন বলেন, 'বন্যায় আমাদের ঘর পুরোটাই ডুবে গিয়েছিল। আমার পরিবার পাশেই একটা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল।'

গত মঙ্গলবার মাইন উদ্দিনের সঙ্গে যখন কথা হয়, তিনি জানান, তাদের গ্রামে পানি এখন অনেকটাই নেমে গেছে।

Comments

The Daily Star  | English
fire at Secretariat

Secretariat fire sabotage or accident still not known: Fire service DG

Muhammad Jahed Kamal, director general of the Fire Service and Civil Defence, today said the cause of the devastating fire at Building No. 7 of the Bangladesh Secretariat still remains unknown

1h ago