ফেনীর দাগনভূঞায় ত্রাণের অপেক্ষায় হাজারো মানুষ

ত্রাণ সংগ্রহ করে ফিরছেন ফেনীর দাগনভূঞায় বন্যাকবলিত মানুষ। ছবি: স্টার

ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়ার মতো বন্যার কবলে আছে দাগনভূঞা উপজেলাও। আজ শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দাগণভূঁঞার বিরলি, বানাপুকুর, জয় নারায়ণপুর, গণিপুর, দিলপুর, সমাসপুর, লক্ষ্মীপুর, শরীফপুর, নন্দীরগাঁও, নারাণপুর সহ ১৩টি গ্রামে গিয়ে দেখা যায় সড়কে কোথাও কোমর পরিমাণ কোথাও বুক সমান উচ্চতায় পানি উঠেছে।

ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া উপজেলা বন্যা দুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণ পাঠানো হলেও দাগণভূঁঞায় সেভাবে ত্রাণ পৌঁছেনি। ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের নৌকা দেখলেই অসহায় মানুষ সেদিকে ছুটে যাচ্ছেন।

ফেনীতে গত মঙ্গলবার থেকেই বন্যার পানি উঠতে শুরু করলেও দাগনভূঞায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয় বৃহস্পতিবার থেকে। তবে এরই মধ্যে এই উপজেলায় কিছু জায়গায় পানি কিছুটা কমেছে।

উপজেলার সমাসপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ রফিক মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, 'চাইরদিন ধরি রিলিফ হন তো দূরের কথা, রিলিফের লোক ও দেখিনো। ঘরে কোমর হমান হানি।' (চারদিন ধরে ত্রাণ তো দূরে থাক, ত্রাণ বিতরণকারী দের ও দেখিনি! ঘরে এখনো কোমর সমান পানি।)

দাগনভূঞায় খাবারের সংকট তৈরি হওয়ার আগেই পানিয় জলের সংকটে বিপাকে পড়েছেন বন্যার্তরা। ছবি: স্টার

ক্ষোভ প্রকাশ করেন নন্দীরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা হেকমত আলী। তিনি বলেন, 'কন্ডে যামু, যেমুই রেনি হেমুই হানি। ঘরেত্তে হানি, মসইদে উইঠছিলাম হেয়ানেও কাইল হানি উডি গেছে। কাইল্লা গেরামের এক লোকের বাইত চাইরগা খাইলেও এর হরে আর কিছু খাইতাম হারিনো।' (কোন জায়গায় যাবো? যেদিকে তাকাই সেদিকেই পানি। ঘরে পানি, মসজিদে উঠেছিলাম সেখানেও গতকাল পানি উঠেছে। গতকাল রাতে গ্রামের এক লোকের বাড়িতে খেয়েছি। এরপর আর কিছুই খাইনি।)

এসব গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই পানি উঠেছে। হাঁটু ও কোমর সমান পানি ডিঙিয়ে যাতায়াত করছেন বাসিন্দারা। কোথাও কলার ভেলা দিয়ে অতি জরুরি প্রয়োজনে চলাচল করছেন। কেউ কেউ জাল দিয়ে মাছ ধরে খাবারের সংস্থান করছেন।

গ্রামবাসীদের অনেকে পাকা বাড়ির ছাদে, স্কুল, কলেজ মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। তবে সেখানেও দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট।

অনেকের সামর্থ্য থাকলেও খাদ্য সামগ্রীর সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এবং দোকান পানিতে ডুবে থাকায় কিনতে পারছেন না।

খাবারের সঙ্গে বিশুদ্ধ পানির সংকটেও পড়েছেন দাগনভূঞার মানুষ। নলকূপ ডুবে যাওয়ায় পানীয় জলের সংকট তৈরি হয়েছে। দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে আনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি বিশুদ্ধ পানি ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান বন্যা দুর্গত মানুষেরা।

আশ্রয়ের খোঁজে চলেছেন এক নারী। ছবি: স্টার

রাজাপুর কলেজে দুই শিশু সন্তানসহ আশ্রয় নিয়েছেন দিলপুর গ্রামের বাসিন্দা আসমা বেগম। তিনি বলেন, 'স্থানীয়দের সহায়তায় দুই বেলা খেতে পারলেও খাবার পানি নিয়ে বিপদে পড়েছি। সব টিউবওয়েল ডুবে গেছে। গত দুদিন ধরে কোথাও খাওয়ার পানি পাচ্ছি না।

জয় নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মতিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাপ দাদার আমলেও এমন বন্যা হয়নি। আটাশির বন্যাতেও হাঁটু পানি হয়নি। অথচ এখন আমার বাড়িতে বুক সমান পানি। এক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করেছি। কখন যে বন্যার পানি নামবে ঠিক-ঠিকানা নেই!'

বন্যাকবলিত অনেকে আবার লোক লজ্জায় খাবারের জন্য সাহায্য চাইতে পারছেন না।

উপজেলার নন্দীরগাঁও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, 'কেউ কি দিবে, কারো কাছে গিয়ে যে চাইবো লজ্জায় তাও পারছি না। এদিকে ঘরে কোমর পরিমাণ পানি। কোথায় গিয়ে উঠব বুঝতে পারছি না।'

বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন উপজেলার মৎস্য ও পোল্ট্রি খামারীরা। সব মাছের খামার ভেসে গেছে, মারা গেছে খামারের হাজারো মুরগি। উপজেলার সমাসপুর গ্রামের বাসিন্দা মৎস্য খামারী জোবায়ের ভূঁঞা বলেন, 'আমার তেরটি পুকুরে যা মাছ ছিল সব ভেসে গেছে। নিজে তো পথে বসেছিই, মাথার উপর এখন আট লাখ টাকার ঋণ। কীভাবে শোধ হবে জানি না।'

উপজেলার সত্যপুর গ্রামের বাসিন্দা মহিউদ্দিন বলেন, 'দাগনভূঞার মানুষ বন্যায় অভ্যস্ত নয়। তাই বিপদটা আরও বেশি। সবাই ফুলগাজী, পরশুরাম নিয়ে চিন্তিত; দাগণভূঁঞায় কেউ সহায়তা করতে আসছে না। ফেনীতে শত শত ট্রাক ত্রাণ নিয়ে বসে আছে অথচ দাগণভূঁঞায় হাজারো মানুষ ত্রাণের অপেক্ষায় আছে।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

3h ago