বিয়ের চ্যালেঞ্জ এবং চার দেয়ালের ভেতরে গুমরে মরার লড়াই

ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল

বর্তমান সময়টা এমন, যখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমরা মুখোমুখি হচ্ছি নতুন কোনো টার্মের, নতুন কোনো তকমার। প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিউজফিডের বেড়া টপকে আসা এসব নিত্যনতুন টার্মের মধ্যে একটি হচ্ছে 'স্লিপ ডিভোর্স'। শুনেই একটু চোখ কপালে ওঠে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ, এও কি সম্ভব? এরপর কিছুটা জানাশোনার পর যদিও বা বিষয়টি নিয়ে অনেকটাই পরিষ্কার হওয়া গেল, কিন্তু এরপরের প্রশ্নটাও কম কৌতূহলী নয়। বাংলাদেশে কি আদৌ এই বিষয়টির চর্চা হয়? বিবাহিত জীবনের সমস্যাগুলো দূর করতে এছাড়া অন্যান্য কী পদ্ধতি রয়েছে? বিয়ে কি তবে অনেকের জন্যই শুধু আশীর্বাদ নয়, বরং সমাজের চাপিয়ে দেওয়া এক গাদা দায়িত্বের বোঝা?

এমন সব প্রশ্নের উত্তর লুকোচুরির বিষয় নয়, এগুলো হতে হয় খোলামেলা। আর তাই সব রহস্যের জট খুলতে গিয়েছিলাম মনোবিকাশ ফাউন্ডেশনের একজন উল্লেখযোগ্য সাইকোথেরাপিস্ট ড. আব্দুল হামিদের কাছে।

কথোপকথনের শুরুতেই তিনি একটু মজা করে বললেন, 'বৈবাহিক জীবনের সমস্যার কথা তো আর বলে শেষ করার নয়'। তবে এরপরই যে সমস্যাগুলো নিয়ে আমাদের সমাজে সবচেয়ে কম কথা বলা হয়, বিয়ের আড়ালে থাকা দুটো মানুষের সেসব দিকের দিকে আলোকপাত করলেন তিনি। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশি দম্পতিদের মধ্যে সঙ্গীর অ্যাসেক্সুয়াল আচরণের গতিবিধি ও জটিলতা, ইরেকটাইল ডিসফাংশন, স্লিপ ডিভোর্স সম্পর্কে আগ্রহ, সামাজিক চাপে পড়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগগত সমস্যাসহ আরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ।

ড. হামিদ বলেন করেন, 'বিবাহিত সঙ্গীর অ্যাসেক্সুয়ালিটির বিষয়টি আমাদের সমাজে খুব বাজেভাবে দেখা হয়। এটি কিন্তু কোনো রোগ নয়, বরং ব্যক্তির নিজস্ব প্রকৃতি। বিয়ের মতো সামাজিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর কেউ যখন বিষয়টি আবিষ্কার করে, তা খুব স্বাভাবিকতই নেতিবাচক দিকে চলে যায়।'

তিনি জানান, ভ্রান্ত ধারণা ও গ্রহণযোগ্যতার অভাবের কারণে অনেক দম্পতিই বিষয়টি বুঝতে পারে না এবং অদরকারি সব চিকিৎসার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইরেকটাইল ডিসফাংশন ও ডেমিসেক্সুয়ালিটির এমনিতেই নিজস্ব কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আবার এগুলো সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির ফলে বাড়তি সন্দেহ, মানসিক চাপ ও শেষমেশ সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরতে পারে।

ড. হামিদ যেকোনো ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান এই অবস্থাগুলো নিয়ে যেকোনো ধরনের দ্বিধা দূরীকরণের ওপর জোর দেন। তিনি মনে করেন, এ কারণে বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানা দরকার।

'ডেমিসেক্সুয়ালিটিতে ঘনিষ্ঠতার জন্য খুব জোরালো মানসিক বন্ধনের দরকার হয়। তাই অনেক সময় এ ধরনের ব্যক্তির স্বাভাবিক অবস্থাকে অ্যাসেক্সুয়াল বলা চলে', বলেন তিনি।

স্লিপ ডিভোর্সের ধারণাটা নতুন হলেও আজকাল অনেকেই বিষয়টি নিয়ে জানছেন। ড. হামিদের মতে, 'এটি মূলত পাশ্চাত্যের একটি ট্রেন্ড। এর মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে বাধা এলেও স্বামী-স্ত্রী আলাদা আলাদা ঘুমানো পছন্দ করে, যাতে করে তাদের নিজের ঘুম ভালো হয় ও ব্যক্তিগত কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।'

এমন সিদ্ধান্ত ঢাকার মতো শহরে গতানুগতিক বিয়েতে সঙ্গীর ভূমিকা ও প্রত্যাশার আমূল চিত্র পালটে দিতে পারে। তবে এ কথাও পরিষ্কার করা জরুরি যে, স্লিপ ডিভোর্স মানেই যে আবেগীয় দূরত্বও আসবে, তা কিন্তু নয়। এটি শুধুমাত্র নিজেদের সুস্থতার জন্য নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত।

এসব চ্যালেঞ্জের সবচেয়ে বড় সমাধান হচ্ছে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা। এ বিষয়ে ড. হামিদের পরামর্শ, 'সম্পর্কে থাকা মানুষগুলোর চাহিদা ও উদ্বেগ, দুই বিষয়েই খোলামেলা আলাপ করা দরকার। সেটা ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত হোক কিংবা ব্যক্তিগত লড়াইয়ের কথাই হোক। আদতে একে অন্যের অনুভূতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই সম্পর্কটা টিকে থাকে।'

ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল

বৈবাহিক সম্পর্কে যেকোনো ধরনের সেক্সুয়াল ডিসফাংশনের সঙ্গে যে ব্যক্তির মানসিক অবস্থায়ও প্রভাব পড়ে, সেটি নিয়েও তিনি আলাপ করেন। একইসঙ্গে তিনি তুলে ধরেন যে সামাজিক প্রভাব এসব সমস্যাকে কীভাবে আরও বাড়িয়ে তোলে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, 'ইরেকটাইল ডিসফাংশন খুবই স্বাভাবিক একটি সমস্যা, যেখানে ব্যক্তি জোরপূর্বক নিজেকে যৌনতায় সক্রিয় রূপে দেখতে চান। এতে করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও বৈবাহিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।' এই মানসিক চাপের ফলে সম্পর্কে অন্যান্য আরও চাপের সৃষ্টি হতে পারে, যার ফলে পুরো সম্পর্কটাই লেজেগোবরে হয়ে যায়। তবে ড. হামিদের মতো মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পেশাদারদের সহায়তায় দম্পতিরা খুব সহজেই এসব চ্যালেঞ্জ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের মতো করে সমাধান খুঁজে বের করতে পারবেন।

এ ছাড়াও বিয়েতে মূলত নারীদের ওপরই এসব ডিসফাংশনের প্রভাব বেশি দেখা যায়। বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে ড. হামিদ বলেন, 'দৈনন্দিন জীবনে সবকিছু ঠিক আছে—এমন একটা ভান করে বেঁচে থাকাটা ক্ষতিকর। এতে করে শুধু সম্পর্কের মধ্যকার বিশ্বাস আর প্রতিশ্রুতিতেই আঘাত আসে না, দম্পতির আবেগীয় যোগাযোগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'

তিনি মনে করেন, এসব সমস্যাকে স্বীকার করে নিয়ে আলাপের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াটাই সমাধান। 'সম্পর্কে অসন্তুষ্টির বিষয়টি লুকানোর মাধ্যমে ক্ষণিকের স্বস্তি এলেও দীর্ঘমেয়াদে তা শুধু গভীর খেদ ও ভুল বোঝাবুঝিরই জন্ম দেবে। তাই সঙ্গীর কাছে যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে সত্যটা প্রকাশ করাই ভালো।'

তিনি বিভিন্ন কৌশলের কথা বলেন, যার মাধ্যমে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে এসব সংবেদনশীল বিষয়ে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও বোঝাপড়ার সম্পর্কটা দৃঢ় করা যায়।

তার মতে, 'বিশ্বাসের জায়গাটা খুব বেশি দরকার। কিন্তু সেইসঙ্গে সবসময় এও মনে করলে চলবে না যে আমাদের সব চাহিদাই অপর পক্ষের জানা রয়েছে। কোনো ধরনের অনুমানের খেলা না খেলে খোলামেলা ও সৎভাবে কথা বলার মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা অঙ্কুরেই সমাধান সম্ভব।'

এই কথোপকথনগুলো খুব সরাসরি হবে, কিন্তু অসংবেদনশীলও হওয়া যাবে না। এতে করে উভয় পক্ষই নিরাপদ অনুভব করবে এবং পরবর্তীতে কোনো ক্ষোভ বা ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকবে না।

বাংলাদেশের আবহের সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করা ইমোশন-ফোকাসড থেরাপি ও কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপির মতো বিভিন্ন থেরাপিউটিক পদ্ধতির মাধ্যমে দম্পতিরা নিজেদের আবেগীয় ও শারীরিক, উভয় নৈকট্য বাড়িয়ে তুলতে পারেন। এক্ষেত্রে ড. হামিদ মনে করেন, 'এই থেরাপিগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিল রেখেই তৈরি করা এবং এতে করে খুব কার্যকর উপায়ে দম্পতিদের মধ্যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরি হবে।'

বৈবাহিক জীবনে আসা চ্যালেঞ্জগুলো শুধু ব্যক্তির নিজের লড়াই নয়—বরং এতে প্রকাশ পায় ঘূর্ণায়মান সমাজের প্রতিচ্ছবি। এই দম্পতিদের মধ্যকার অব্যক্ত দ্বন্দ্বগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং একটি সামাজিক ইস্যু, যাতে আমাদের তাৎক্ষণিক মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

ঠিক যেভাবে রাজধানী শহর ঢাকা বদলাচ্ছে, সেইসঙ্গে বদলে যাচ্ছে ঢাকার বিয়েগুলোও। চার দেয়ালের সংসারে বাঁধা শান্ত করিডোরে দম্পতিরা খুঁজে চলেছেন ঘনিষ্ঠতার নতুন সংজ্ঞা। অনেকে নতুন করে লিখছেন নিজের পরিচয়টাও। আর সেইসঙ্গে চলছে গতানুগতিক বিয়ের ছাঁচে খুঁজে চলা নিজের সন্তুষ্টির মুহূর্তগুলো।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

Comments

The Daily Star  | English

Have patience for election

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday said the government would issue a roadmap to the election as soon decisions on electoral reforms are made.

5h ago