‘এত রক্তের ওপর দিয়ে তো আমরা কোটা সংস্কার চাইনি’
'এত রক্তের ওপর দিয়ে তো আমরা কোটা সংস্কার চাইনি…'
সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন, দুই বাহুতে, পিঠে ও বাম পায়ের উরুতে গুরুতর জখম নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
গত ২০ জুলাই মধ্যরাতে তাকে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কয়েকজন তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, নাহিদ যে ভবনে অবস্থান করছিলেন সেখানে রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে সাদাপোশাকে ২৫-৩০ লোক সেখানে আসেন। বাইরে ছিল আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর দুটি কালো ভ্যান ও দুটি গাড়ি। ভবনটির গেট ভেঙে তারা ভেতরে ঢোকেন। রাত আড়াইটার দিকে ভবন থেকে একজনকে তুলে নিয়ে গাড়িতে করে চলে যান তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলামের খোঁজে শনিবার সারাদিন ডিবি ও সিআইডি অফিস এবং সবুজবাগ থানাসহ বিভিন্ন থানায় ঘুরেছেন তার বাবা বদরুল ইসলাম।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ছেলেকে সাদাপোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এটি জানতে পেরে তিনি ডিবি অফিসে গিয়েছিলেন কিন্তু ছেলের সম্পর্কে কেউ কিছু তাকে জানায়নি।
'সেখানকার কর্মকর্তারা আমাদের ফোন নম্বর রেখে দেন। বলেন যে আমাদেরকে নাহিদের খোঁজ পেলে জানাবেন। আমরা এরপর খিলগাও থানায় যাই, জিডি করতে কিন্তু তারা জিডি নেয়নি,' বলেন তিনি।
ডিএমপির ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন সেদিন দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছিলেন, 'আমাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।'
শনিবার সকালে সারা শরীরে মারধরের চিহ্ন নিয়ে বাসায় পৌঁছান নাহিদ। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
নির্যাতনের যে বর্ণনা দিলেন নাহিদ
শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে নাহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত তাকে মারধর করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'শুক্রবার রাতে হঠাৎ কারফিউ জারি হওয়ায় আমি বাসায় ফিরতে পারিনি, বন্ধুর বাসায় থেকে যাই। রাত ২টার দিকে গেট ভেঙে পুলিশ পরিচয়ে একদল লোক ওই ভবনে ঢোকে। আমি তখন ছাদে চলে যাই। কয়েকজন ছাদে এসে আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। চার-পাঁচজন জোর করে নিচে নামিয়ে গাড়িতে তোলে। নিচে তিন-চারটি পুলিশ ও বিজিবির গাড়ি ছিল। তারা তিন-চার স্তরের কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলে।'
'গাড়িটা ৩০-৪০ মিনিটের মতো চলে। চোখ খোলার পর আমি দেখি যে আমাকে একটা রুমে আনা হয়েছে। সেখানে কয়েকজন আমাকে আন্দোলন সম্পর্কিত কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। আমরা কেন আন্দোলন করছি, উদ্দেশ্য কী, কর্মসূচি কেন প্রত্যাহার করছি না, বাইরে থেকে কারা মদদ দিচ্ছে, এই আন্দোলনের পেছনে কারা আছে—এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়। আমার উত্তরে তারা সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে শুরু হয় মারধর। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে।'
নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, 'লোহার কিছু একটা দিয়ে আমাকে আঘাত করা হয়। একটা পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারাই।'
শনিবার ভোরবেলায় জ্ঞান ফেরার পর রাস্তার পাশে ওভারব্রিজের নিচে নিজেকে আবিষ্কার করেন নাহিদ।
তিনি বলেন, 'ভোরের কোনো একটা সময়ে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারি যে এটা পূর্বাচল এলাকা। সেখান থেকে একটা সিএনজি ভাড়া করে আমি বাসায় চলে আসি। পরে আমার পরিবারের সদস্যরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।'
দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন নাহিদ। তার দুই বাহুতে, পিঠে ও বাম পায়ের উরুতে গুরুতর জখমের চিহ্ন আছে।
রোববার সকালে নাহিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর খবর পেয়ে সাংবাদিকসহ আরও অনেকে আসতে শুরু করেন। সে কারণে হাসপাতালেও ঝামেলা হয়। হাসপাতাল থেকে আমার ভর্তি বাতিল করা হয়। এক প্রকার নিরাপত্তাহীনতায় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।'
জানতে চাইলে হাসপাতালের চিকিৎসক বলেন, 'তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ আছে। এক্স-রে রিপোর্ট পেলে জানতে পারব তার শরীরে কোনো ফ্রাকচার আছে কি না। তবে তিনি মানসিকভাবে শক্ত আছেন।'
'এত রক্তের ওপর দিয়ে তো আমরা কোটা সংস্কার চাইনি'
সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন নাহিদ ইসলাম। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় সমন্বয়করা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে সমস্যায় পড়েন বলে জানান তিনি।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন ডিজিটাল ব্ল্যাকআউট চলছে। কত মানুষ মারা গেছে সেটাও আমরা নিশ্চিত না। সমন্বয়কদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। তারা কোথায় আছেন জানি না।'
দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলাম। কোর্ট থেকে রায় এসেছে সরকার সেই প্রেক্ষিতে প্রজ্ঞাপন জারি করবে কিন্তু এত রক্তের ওপর দিয়ে তো আমরা কোটা সংস্কার চাইনি। এত হতাহত, এত জানমালের ক্ষতি, সরকারের দায়িত্বহীন আচরণ এবং বিভিন্ন মন্ত্রীদের উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের দমন পীড়নের ফলে ছাত্র আন্দোলন বৃহত্তর গণআন্দোলনের জায়গায় চলে এসেছে।'
'এই আন্দোলনের কারণে ছাত্রদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন। আমরা এর বিচার চাই। যারা দায়িত্বে ছিল তাদের পদত্যাগ চাই। যে মন্ত্রীদের নির্দেশে, পুলিশ প্রধানদের নির্দেশে হামলা হয়েছে, গুলি চালানো হয়েছে আমরা তাদের পদত্যাগ চাই,' বলেন তিনি।
মন্ত্রীর সঙ্গে সমন্বয়কদের সংলাপ বিষয়ে তিনি বলেন, 'তারা বলেছে তারা মন্ত্রীর কাছে দাবি দিয়েছে কিন্তু কোনো সংলাপে যায়নি। তারা বলেছে মিডিয়া তাদের মিসকোট করেছে।'
'আমরা রক্তপাত দেখেছি, নির্যাতনের শিকার হয়েছি, অনেককে হত্যা করা হয়েছে, হাজারো শিক্ষার্থী-পুলিশও হতাহত হয়েছে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে… সরকারকে এগুলোর জবাব দিতে হবে। আমরা হত্যার বিচার চাই। আইনি ব্যবস্থা চাই।'
Comments