রপ্তানি তথ্যে গরমিল: গণনা পদ্ধতি সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার
কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানি তথ্যের গরমিলের বড় অঙ্ক সামনে আনার পর সরকার তথ্য গণনা পদ্ধতি সংশোধনের উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। যেন একই ধরনের গরমিলের আবার পুনরাবৃত্তি না হয়।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে, তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত ও নীতিগুলো প্রমাণ-ভিত্তিক করতে চায় সরকার। এজন্য বিশ্ববাজারে বিক্রির রিয়েল-টাইম তথ্য প্রকাশে একটি প্ল্যাটফর্ম চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল ঢাকায় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে (ইপিবি) এক সভায় লাইভ ডেটা প্ল্যাটফর্ম চালু করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানি তথ্যের বড় ধরনের গরমিল সংশোধন করে। তারপর সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর প্রথম বৈঠক এটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশোধিত পরিসংখ্যান দেখে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন। অর্থনীতিবিদরা এটিকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় ধাক্কা বলেও অভিহিত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলের প্রকৃত রপ্তানি ইপিবির প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কম।
বিষয়টি রপ্তানি তথ্য নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করতে সরকারকে প্ররোচিত করেছে। কারণ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া রপ্তানি তথ্যের এই গরমিল নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া ইপিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'তথ্যের অমিল নীতিনির্ধারকদের ভুল বার্তা দিচ্ছে বলেই এই প্লাটফর্মের পরিকল্পনা করা হয়েছে।'
তবে প্ল্যাটফর্মটি কবে চালু হবে এবং কীভাবে চালানো হবে তা তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারেননি তিনি। কারণ পরিকল্পনাটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
এ বিষয়ে শিগগিরই ইপিবি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, 'এ ধরনের একটি আধুনিক ডাটা প্লাটফর্ম তৈরির জন্য অর্থের প্রয়োজন হবে।'
এর আগে, চলতি সপ্তাহের শুরুতে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, রিয়েল-টাইম ডেটা প্ল্যাটফর্মের জন্য শিগগিরই নতুন প্রকল্প নেওয়া হবে।
পরিকল্পিত প্ল্যাটফর্মের আওতায় ইপিবিতে প্রতিদিনের রপ্তানি তথ্য সরবরাহ করবে এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক রিয়েল-টাইম বিনিময় হারের ভিত্তিতে এটি হিসাব করবে।
ইপিবির এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শুল্ক বিভাগ টাকায় রপ্তানি পণ্যের পরিসংখ্যান পাঠায় এবং ইপিবি তা মার্কিন ডলারে রূপান্তর করে।
'তবে, একটি একক ডেটা প্ল্যাটফর্ম সব ধরনের বিভ্রান্তি দূর করবে, কারণ পরিসংখ্যানগুলো তখন রিয়েল-টাইমের ভিত্তিতে সরবরাহ করা হবে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গণনা করা হবে,' বলেন তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, 'এটি একটি সঠিক উদ্যোগ হতে পারে।'
তিনি বলেন, 'কোন তথ্যকে রপ্তানি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, তা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে।'
'তবে এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এ জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। আইএমএফ যদি একটি মিশন পাঠায়, সরকারকে তারা সহায়তা করতে পারবে।'
আশিকুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক রপ্তানি তথ্যে ধাক্কার পর ডাটা গভর্নেন্স বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এতে মোট ও নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মতো আরও অনেক পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
'তাই ডাটা ম্যানেজমেন্ট, ডাটা গভর্নেন্স ও সমন্বয়কে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।'
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'উদ্যোগটি সত্যিই একটি ভালো পদক্ষেপ হবে।'
তিনি ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানের গরমিলকে বড় তথ্য কেলেঙ্কারি বলে অভিহিত করেন।
ইপিবির কর্মকর্তা আরও বলেন, অতীতে প্রকৃত রপ্তানি ও অস্থায়ী রপ্তানি তথ্যের মধ্যে ব্যবধান বার্ষিক ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো ছিল। কিন্তু এবার একই পণ্য একাধিকবার গণনার কারণে সেই ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলারে।
বিদ্যমান রপ্তানি নীতিমালার আওতায়, রপ্তানিকারকরা সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছে বিনামূল্যে কিছু নমুনা পাঠান, এনবিআরের শুল্ক বিভাগ তার মূল্যও গণনা করেছে।
এছাড়া, গত বছর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রির তথ্য গণনার সময় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের আওতাধীন কারখানাগুলোর দেশের ক্রেতাদের কাছে প্রায় ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করে। এই পরিসংখ্যানকেও বিবেচনায় নিয়েছে ইপিবি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চূড়ান্ত রপ্তানি তথ্যে এই পরিসংখ্যান অন্তর্ভুক্ত করেনি।
তিনি জানান, বর্তমানে শুল্ক বিভাগ থেকে রপ্তানি তথ্য পাওয়ার পর ইপিবি তা হিসাব করে। পণ্যদ্রব্যের জাহাজিকরণ বিলের ওপর ভিত্তি করে শুল্ক বিভাগ এসব তথ্য পাঠায়। তবে পণ্য দেশ ছাড়ার পর অনেক পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন, কখনো কখনো কিছু পণ্য রপ্তানি করা হয় না। তবে শুল্ক বিভাগ সেই তথ্য বিবেচনা করে ও ইপিবিতে পাঠায়।
সেলিম রায়হান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা দুজনেই বলেন, সরকারের উচিত আগে তথ্য গরমিলের কারণগুলো খুঁজে বের করা।
অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, 'বাণিজ্য তথ্য যাচাই করার একটি উপায় হলো আমদানিকারকদের দিক থেকে তথ্য যাচাই করা। আবার এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, এই তথ্য নিয়মিতভাবে ইউএন কমট্রেডে রিপোর্ট করা হচ্ছে কিনা।'
তিনি বলেন, 'ভুলের উৎস খুঁজে বের করা জরুরি। সেখানে নানা ব্যাখ্যা থাকতে পারে।'
'এটা রপ্তানিকারকদের ওভার ইনভয়েসিং হতে পারে। অথবা ইপিবি ভুল তথ্য রিপোর্ট করতে পারে, কিংবা এমনও হতে পারে রপ্তানি আয়ের একটি অংশ দেশে আনা হয়নি,' বলেন তিনি।
সেলিম রায়হান প্রশ্ন তোলেন, তথ্যের এই গরমিল কি প্রযুক্তিগত অদক্ষতা? নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে প্রকাশ করা হয়েছে?
'যদি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়, তাহলে পরিকল্পিত প্ল্যাটফর্মটি মোটেই কাজ করবে না,' যোগ করেন তিনি।
তিনি এটিকে সবচেয়ে বড় ডেটা স্ক্যামগুলোর একটি বলে মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, 'বিষয়টি মোটেও হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। নতুন প্লাটফর্মটি কার্যকরভাবে চালু করতে হলে সরকারকে অবশ্যই কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে।'
Comments