ঝিনাইদহে সোনা চোরাচালানকারীদের ‘অবাধ রাজত্ব’

প্রায় ছয় মাস আগে বাহক (ক্যারিয়ার) হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে সোহেল (ছদ্মনাম) তার মোটরসাইকেলে করে যশোর থেকে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে অন্তত ২৭ বার সোনার চোরাচালান পৌঁছে দিয়েছেন।

গত জানুয়ারিতে স্থানীয় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি ছাড়া পান।

সম্প্রতি ওই এলাকায় গেলে সোহেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, চোরাচালানকারীদের সঙ্গে চুক্তির অংশ হিসেবে তার বাইকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর স্থানীয় পুলিশের কাছে চলে যাওয়ায় এরপর থেকে পুলিশ তাকে আর কোনো বাধা দেয়নি।

ঝিনাইদহের নিহত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার সোনা চোরাচালানের কাজ সহজতর করার জন্য 'টোকেন সিস্টেম' নামে পরিচিত এই পদ্ধতি চালু করেছেন বলে জানা গেছে।

সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সোহেলের মতো যারা বাহক হিসেবে কাজ করেন, তারা তাদের নিয়োগদাতার পাশাপাশি সীমান্তে ওই চালান যারা গ্রহণ করেন, তাদের কারো নামও জানেন না।

যশোরের একটি মাদ্রাসার সাপোর্ট স্টাফ সোহেল বলেন, 'এই কাজের জন্য আমি মাসে ৪০ হাজার টাকা বেতন পেতাম, যত চালানই পৌঁছে দেই না কেন। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ডেলিভারি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।'

সোহেলের ভাষ্য, তার মতো আরও ডজনখানেক বাহক রয়েছেন যাদের একমাত্র কাজ যশোর বা আশপাশের অন্যান্য জেলা থেকে চালান নিয়ে তা মহেশপুর সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া।

'আমাদের আর কিছু করতে হয় না। চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরাই বাকি সব কাজ করছে', বলেন তিনি।

গোয়েন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৪০ জন মোটরসাইকেল আরোহী যশোর ও ঝিনাইদহ সীমান্তে চালান নেওয়া ও পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন।

আরও এক বাহক বলেন, 'আমরা চালান সীমান্তের একটি নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দিই, যেখান থেকে অন্য বাহক সেটা রিসিভ করে। এরপর সীমান্ত নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় চালানটি ভারতে পাচার করা হয়।'

তিনি জানান, সীমান্তের যেসব বাহক স্বর্ণ ভারতে পাচার করে, তারা চালানের আকার ভেদে এক থেকে দুই লাখ টাকা পেয়ে থাকেন।

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার কলকাতায় খুন হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ তদন্ত শুরু করার পর বেশিরভাগ বাহকই আত্মগোপনে চলে গেছেন।

তবে, এর মধ্যেই সম্প্রতি ভারতে সোনার বেশ কয়েকটি চালান পৌঁছেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

চারজন বাহক, তিনজন স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি ও গোয়েন্দা সূত্রের মতে, মহেশপুর সীমান্তে কাঁটাতারের কোনো বেড়া না থাকায় সোনা চোরাচালানের জন্য সেটা নিরাপদ পথ হিসেবে বিবেচিত। চোরাচালান চক্রের প্রভাবশালী নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে একজন ছিলেন নিহত এমপি আনার।

টোকেন সিস্টেমের উদ্ভাবক এমপি আনার

তারা আরও জানায়, গত চার-পাঁচ দশক ধরে এই সীমান্ত দিয়ে সোনা চোরাচালান চলছে, যেখানে প্রায় ১০ বছর আগে মূল ভূমিকায় ছিলেন এমপি আনার।

তবে তার অনেক আগে থেকেই ১৯৮৬ সালে ছাত্রাবস্থায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকা অবস্থায় একদল বাইকারের মাধ্যমে ভারতে সোনা পাচার শুরু করেন আনার।

গোয়েন্দা সূত্রটি আরও জানায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেতনভোগী বাহক নিয়োগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য একটি টোকেন সিস্টেম চালু করার ধারণা নিয়ে আসেন।

টোকেন সিস্টেমটি গেট পাস হিসেবে কাজ করে: যখন বাহকরা চোরাচালান বাহন করে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের 'বিরক্ত' করে না। বিনিময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী 'অর্থের ভাগ' পায়।

বারোবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ জানান, টোকেন পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি অবগত।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, একবার টোকেন দেখালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর মোটরসাইকেল থামাবে না। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। আমরা চোরাচালানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।

গোয়েন্দা সূত্রের মতে, আজাদও একসময় আনারের চক্রে ছিলেন। তবে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আজাদ।

'আমি স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নই', ডেইলি স্টারকে এমন কথাই বলেছেন আজাদ, যদিও তখনো চোরাচালানের সঙ্গে তিনি জড়িত কি না, এই সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নই তাকে করা হয়নি।

মহেশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান চোরাচালানে পুলিশের সহায়ক ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, 'কোনো টোকেন সিস্টেমের কথা আমার জানা নেই। স্বর্ণসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সঙ্গে পুলিশ সার্বক্ষণিক কাজ করছে।'

হটস্পট

ভারতে সোনা চোরাচালানের জন্য মহেশপুর যে একটি 'হটস্পট', বিষয়টি ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা স্বীকার করে বলেছেন, 'কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় আমরা অনেক সময় ব্যবস্থা নিতে পারি না।'

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরব, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে চোরাচালানের সোনা মূলত ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

এসব সোনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করা হয়। এর মধ্যে ঝিনাইদহের মাটিলা সীমান্ত পয়েন্ট অন্যতম পছন্দের রুট।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, মাঝেমধ্যে রেলপথও ব্যবহার করে চক্র।

অন্য দেশ থেকে সরাসরি ভারতে সোনা পাচারের পরিবর্তে পাচারকারীরা বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ প্রতিবেশী দেশে স্বর্ণ সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন ও অর্থ পরিশোধ পদ্ধতি—উভয়ই বেশ কঠোর।

ধরাছোঁয়ার বাইরে মূলহোতা

বছরের পর বছর ধরে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা স্বর্ণের কিছু চালান জব্দ ও কিছু বাহককে আটক করলেও মূল পরিকল্পনাকারীরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।

যেকোনো তথ্য ফাঁস, এমনকি এর সম্ভাবনাও খুনের কারণ হতে পারে।

স্বর্ণের একটি চালান ঘিরে বিরোধের জেরে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি মহেশপুরের বাঘাডাঙ্গা গ্রামে দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পুলিশ ও স্থানীয় সাংবাদিকদের ভাষ্য, চার কেজি ৬৬ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণের চালানের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র রয়েছে।

৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়ন সকালে চালানটি জব্দ করে এবং বিকেলে ওই দুজনকে হত্যা করা হয়। পরে জানা যায়, ঘটনার পর চালানটির মালিক ভারতে পালিয়ে গেছেন।

ওসি মাহবুবুর রহমান জানান, এই ঘটনার তদন্ত চলছে।

বিজিবি ২০২২ সালে প্রায় ৩৮ কেজি ৪০ গ্রাম, ২০২৩ সালে প্রায় ৩৭ কেজি ৫৬ গ্রাম এবং চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ২৭ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে।

জব্দের ঘটনায় কমপক্ষে ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে পুলিশ কোনো ঘটনার ক্ষেত্রেই মূলহোতাকে খুঁজে বের করতে পারেনি।

এ ছাড়া যারা এসব চোরাচালানের বাহক হিসেবে কাজ করেন, তাদের শাস্তি পাওয়ার ঘটনাও বিরল। গত ১০ বছরে কেবল দুজন বাহককে এক বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

মহেশপুর ৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ মো. আজিজুস শহীদ জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা শুধু বাহকদের আটক করতে পারেন।

'আমরা তদন্তকারী সংস্থা না হওয়ায় মূলহোতাদের খুঁজে বের করতে পারছি না। আমরা শুধু গ্রেপ্তারকৃতদের পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছি। পুলিশই এসব ঘটনার তদন্ত করে', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

4h ago