ক্যাশ থেকে ক্যাশলেস পথের যাত্রা
'আমরা এতদিন যেভাবে সফল হয়েছি, সেভাবেই যে ভবিষ্যতেও সফল হব, তা কিন্তু নয়'—শুধু করপোরেট খাতের পেশাদারদের জন্যই নয়, সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির জন্যও এটি সমানভাবে সত্য।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি এবং গত পঞ্চাশ বছরে এগিয়েছি। জাতিসংঘে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া 'এসডিজি প্রগ্রেস অ্যাওয়ার্ড' সেই বাস্তবতারই জোরালো সাক্ষ্য দেয়। তবে, আরও অনেক দূর যেতে হবে। এসডিজির সব ক্ষেত্রে ক্রমাগত উন্নতি অর্জনের জন্য আমাদের অবিরাম মনোযোগ, আমাদের সীমিত সম্পদের সুবিবেচনামূলক ব্যবহার এবং সব নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
বর্তমান বিশ্বে, আলোর গতিতে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। বদলাচ্ছে মুদ্রা এবং আমাদের লেনদেন করার ধরনও। এই অংশে আমি ক্যাশ বা কাগজের মুদ্রার ওপর জোর দিতে চাই। কয়েকশ বছর ধরে আমাদের প্রতিদিনের লেনদেন হচ্ছে নগদে বা কাগজের মুদ্রায়। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের এই আচরণে পরিবর্তন এবং নতুন পদ্ধতি অবলম্বন লেনদেনের সময়, খরচ, গতি, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে আমাদের উল্লেখযোগ্য সুবিধা এনে দেবে।
নগদ টাকার ও নগদ লেনদেনের বেশ কিছু বিকল্প আছে। সীমিত পরিসরে হলেও বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন আকারে বিকল্পগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। কোভিড-১৯ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে ও বুঝতে শিখিয়েছে। এ সময় করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রামণ এড়াতে বাড়িতে থাকতে এবং চলাচল সীমাবদ্ধ রাখতে আমরা বাধ্য হয়েছি। তখন বাড়িতে বসে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় লেনদেন করার বিকল্প উপায়গুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হয়েছিল। যেমন: বিল পরিশোধ করা, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা, ঋণ ও ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে নিয়মিত অর্থ প্রদান এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজনে অনেক ব্যক্তিকে সাহায্য করা। আমরা তখন নগদ টাকার পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপ, মোবাইল আর্থিক সেবা ও ই-কমার্স ব্যবহার করেছি।
মজার বিষয় হলো, ব্যাংকের শাখা এবং এটিএমগুলোতে লেনদেনের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমেছে। অন্যদিকে ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ই-কমার্স ও এমএফএস লেনদেনগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্রবণতা এখনো অব্যাহত রয়েছে—মহামারি-পরবর্তী পরিস্থিতিতেও।
আমার বাসায় আমরা লেনদেনের ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করছি। আমরা অর্থ আদান-প্রদান এবং স্কুল টিউশন ফি পরিশোধের জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের 'আস্থা' অ্যাপ ব্যবহার করেছি। ইউটিলিটি বিল পরিশোধের পাশাপাশি আমার গ্রামের মানুষদের টাকা পাঠানোর জন্য বিকাশ অ্যাপ ব্যবহার করেছি। ই-কমার্স লেনদেনের জন্য আমরা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেছি।
নগদ মুদ্রার গুরুত্ব কমেছে কারণ আমাদের জন্য সস্তা ও চৌকস বিকল্প এসেছে। এটা কোটি কোটি বাংলাদেশির গল্প। আমরা আমাদের বাড়িতে থেকে নিয়মিত ব্যাংকিং লেনদেন কীভাবে করতে হয় তা শিখে গেছি। কোভিড আমাদের অনেককে বদলে দিয়েছে।
তবে, জনসংখ্যার বড় একটি অংশ এখনো আর্থিক লেনদেন করার প্রচলিত উপায় পছন্দ করে—তারা নগদ উত্তোলন করতে দীর্ঘ দূরত্বে যাতায়াত করবে, দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করে ঘাম ঝরাবে এবং মূল্যবান উৎপাদনশীল ঘণ্টা অপচয় করেই যাবে। তবে আমরা অনেকেই আমাদের কাছের মানুষ এবং প্রিয়জনকে ডিজিটাল জীবনধারার সুবিধার দিকগুলোর কথা জানিয়েছি, যা তাদের আজকের ডিজিটাল জীবনধারার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে উৎসাহিত করেছে। এটি তাদের অনেকের জন্য একটি মুক্তির অভিজ্ঞতা ছিল।
আমরা জানি, আমরা অনেকেই আমাদের আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে অন্যদের বেশি তথ্য দিতে চাই না—কোথায় এবং কীভাবে আমরা ব্যাংকিং করি, আমরা কোন পদ্ধতি ব্যবহার করি, আমরা কোন পণ্যগুলো কিনি, কোনো কিছু করার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়গুলো কী এবং কী কী এড়িয়ে চলা উচিত। আমার অভিজ্ঞতা যদি অন্যদের সাহায্য করতে পারে, তাহলে এর অর্থ হবে সম্মিলিত জয়।
অনেকগুলো ব্যাংকসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটালাইজেশনের জন্য নেওয়া অসংখ্য পদক্ষেপ বিভিন্ন পর্যায়ের সাফল্যের মুখ দেখেছে। ব্যাংকের শাখা, সেলস টিম ও কল সেন্টারে মানবসম্পদ যুক্ত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকদের নিবন্ধন, বিকল্প চ্যানেল ব্যবহার (এটিএম, সিডিএম ও কল সেন্টার), ই-স্টেটমেন্ট সাবস্ক্রিপশন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য বেড়েছে।
গ্রাহকদের ব্যাংকের শাখায় আসা কমাতে বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে নগদ উত্তোলন ও তহবিল স্থানান্তরের সীমা বাড়ানোর জন্য অনেক নির্দেশনা দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংককে ধন্যবাদ। এর ফলে সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করা গ্রাহক ও ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। এই বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিনিময় (আইডিটিপি), বাংলা কিউআর ও মাইক্রো-মার্চেন্টের মতো উদ্যোগগুলোও ভালোভাবে এগোচ্ছে। ক্রমাগত ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে উদ্যোগগুলো আরও এগিয়ে যাবে এবং দেশের ডিজিটালাইজেশন যাত্রাকে আরও অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আমাদের সঙ্গে ব্যাংকিং করা এসএমই গ্রাহকরাও স্বয়ংক্রিয় চ্যানেলগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং দৈনিক তহবিল স্থানান্তরের সীমা আরও বাড়াতে অনুরোধ করছে। আমাদের গ্রাহকরা ব্যবসার পাশাপাশি যত বেশি সম্ভব লেনদেনের নতুন উপায়ে যুক্ত হবে, অর্থ তত গতি পাবে।
একটি ক্যাশলেস সমাজের সামষ্টিক-অর্থনৈতিক প্রভাবগুলো পরিমাপ করার সময় এখনো হয়নি। নগদ অর্থের লেনদেন এখনো এগিয়ে রয়েছে এবং অন্তত বেশ কয়েক বছরের জন্য এগিয়ে থাকবেও।
ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনের খরচ বা মার্চেন্ট সার্ভিস ফি কম। তবে এই ফিও মাঝে মাঝে আমাদের ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে পারে। ডিজিটাল লেনদেনের উপায়গুলো ব্যবহার করায় উৎসাহিত করার জন্য ছোট ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা বা ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার সময় এসেছে। আমি এটিকে খরচ হিসেবে চিহ্নিত করব না, বরং এটিকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দক্ষ অর্থনীতি তৈরির জন্য বিনিয়োগ হিসেবে ধরব।
বিভিন্ন ডিজিটাল পদ্ধতির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল জালিয়াতি ও ব্যক্তিগত তথ্য চুরির বিষয়গুলোও সামনে আসবে। তবে ক্রমাগত সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা কর্মসূচি চালানো, ব্যক্তিগত তথ্যের দায়িত্বশীল ব্যবহার ও মূল্যবান ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষা করা এই ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।
কয়েক বছর আগেও পোশাকশ্রমিকরা তাদের বেতন নগদ অর্থে পেতেন। এখন অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বেতন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা এমএফএসের মাধ্যমে দেওয়াটা বেছে নিচ্ছে।
করোনাভাইরাস মহামারি চলার সময় এমএফএসের মাধ্যমে গার্মেন্টসকর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের জোর দেওয়া ছিল ভালো উদ্যোগ। কয়েকটি ব্যাংক মহামারির সময় এমএফএস অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দুস্থদের মধ্যে কোভিড সহায়তা বিতরণ করেছে।
'পুরোনো গতানুগতিকতা' থেকে বেরিয়ে আসায় অনেক লাভ। নগদ অর্থের লেনদেন থেকে আমাদের বের করে আনার জন্য উপযুক্ত অটোমেশন, নিয়ন্ত্রকদের দিকনির্দেশনা, প্রণোদনা বা নিরুৎসাহিত করার প্রক্রিয়া বের করা, জাতীয়ভাবে সচেতনতা কর্মসূচি—এসব দিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
নগদ অর্থ এখনো কিছু সময়ের জন্য দাপট দেখাবে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটির প্রভাব কমবে।
আমরা একটি সভ্যতা হিসেবে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে আমাদের নগদ অর্থকে ক্যাশলেসে রূপান্তর করতেই হবে। একটি ক্যাশলেস সমাজ গড়ার জন্য ক্রমাগত ডিজিটাল জ্ঞান অর্জন আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে দিবে।
লেখক: ব্র্যাক ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং চিফ অপারেটিং অফিসার।
Comments