কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নমনীয় নীতিতে ব্যাংক খাতের ভগ্ন দশা

bangladesh bank logo

ব্যাংক কোম্পানি আইনে ব্যাংকগুলোর জন্য একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা নির্ধারণ করা আছে। অথচ গত ১৬ বছর ধরে সেই নিয়ম উপেক্ষা করেছে স্বয়ং ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে  বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ বিবেচনায় এই সীমা অতিক্রমের অনুমতি দিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে এবং পুরো ব্যাংক খাত রুগ্ন দশায় পড়েছে।

আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি একজন ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দিতে পারে না। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, কোনো কোনো ব্যাংক তাদের পরিশোধিত মূলধনের ৫০০ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে।

এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেক্সিমকো গ্রুপের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের প্রায় ৯৫০ শতাংশ। বেক্সিমকোর ঋণের ১৯ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে এখন।

জনতা ব্যাংককে এভাবে একক ঋণগ্রহীতার সীমা লঙ্ঘনের অনুমতি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে। ফলে, এই ব্যবসায়ী গ্রুপটি বিশাল অঙ্কের ঋণ নিতে পেরেছিল।

শুধু তাই নয় জনতা একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা লঙ্ঘন করলেও গত বছরের আগস্টে বেক্সিমকোকে ৪৭৯ কোটি টাকার ঋণ দিতে অনাপত্তিপত্র দিয়েছিল ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

তবে এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল ব্যাংক তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগ। কিন্তু তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বেক্সিমকোকে এই নিয়ম থেকে অব্যাহতি দিয়ে ঋণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেন।

শুধু বেক্সিমকো নয়- এস আলম গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপসহ অনেক শিল্পগোষ্ঠীর জন্য ব্যাংকগুলোকে ঋণ সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইসলামী ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদেও আধিপত্য ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক এই ব্যবসায়ী গ্রুপটির।

এস আলম জনতা ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৪৪৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে, যা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের ৪৫১ শতাংশ।

আবার বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা শিথিল করায় রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক ওরিয়ন গ্রুপের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২ সালের নভেম্বরে ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ এর ২৬-খ (১) ধারা শিথিল করায় ব্যাংক তিনটি ওরিয়নের জন্য এত বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করেছিল।

ওই ধারাতে বলা আছে, যে কোনো ব্যাংকের একক ঋণগ্রহীতাকে দেওয়া ঋণ তাদের পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি হবে না। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর জন্য পাঁচ বছরের জন্য এ নিয়ম শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ওরিয়নের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের জন্য অনাপত্তি সনদ দিয়েছিল ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

অবশ্য পরে ব্যবসায়ী গ্রুপটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ অনুমোদন বাতিল করা হয়।

ওরিয়নের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিম বলেন, প্রকল্পটির আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে এবং কোনো ধরনের অযাচিত প্রভাব ছাড়াই সিন্ডিকেটেড ঋণের অনুমোদন পেয়েছিল ওরিয়ন।

অন্যদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের স্বর্ণ শোধনাগার প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ বিবেচনায় সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ২০২২ সালে দুই হাজার ৭২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

এর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ছাড়া বাকিরা একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করেছে।

গভীর সংকটে থাকা জনতা ব্যাংক এ প্রকল্পের জন্য সর্বোচ্চ ৮৮৩ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে।

বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মোহাম্মদ আবু তৈয়ব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, স্বর্ণ শোধনাগার প্রকল্পের অবকাঠামো এখন প্রস্তুত এবং তারা যন্ত্রপাতি আসার অপেক্ষায় আছেন।

তার ভাষ্য, 'ব্যাংকগুলো যথাযথ মূল্যায়ন ও পরিদর্শনের পর এই প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী মহলের চাপে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে এক্সপোজার সীমা অতিক্রমের অনুমোদন দিয়েছে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ উদ্দেশ্যে ও বিশেষ স্বার্থে কিছু গ্রাহককে একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা থেকে ছাড় দিয়েছে।

তিনি বলেন, 'অনেক বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ ধরনের ছাড় দেওয়া হয়।'

রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা শিথিল করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে দেশবন্ধু গ্রুপ।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘন ঘন এক্সপোজার সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ দেওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো গুটিকয়েক গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

তারা বলেন, যখন একজন গ্রাহক পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে বড় অঙ্কের ঋণ পান, তখন ব্যাংকের জন্য ঝুঁকি বেড়ে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিতে দেখা যায়, গত বছরের জুন পর্যন্ত ২৫ শতাংশ ঋণ এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করা ঋণগ্রহীতাদের সবচেয়ে বড় অংশ (৬৭) ও বড় ঋণগ্রহীতার সর্বোচ্চ অনুপাত জনতা ব্যাংকের।

সোনালী ব্যাংকের বড় ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ২১ এবং ১৩ ঋণগ্রহীতা এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করেছে। অগ্রণীর বড় ঋণগ্রহীতা ছিল ৫৫ জন এবং তাদের মধ্যে ২০ ঋণগ্রহীতা এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করেছে। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত রূপালি ব্যাংকের বড় ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ৩৫ এবং তাদের মধ্যে ১০ ঋণগ্রহীতা এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, 'যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই ব্যাংকগুলোকে একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করার অনুমতি দিয়েছে, সুতরাং এই সীমা নির্ধারণের প্রয়োজন ছিল না।'

তিনি বলেন, 'নির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য এই জাতীয় ছাড় আইনসম্মত নয়।'

তিনি আরও বলেন, এভাবে নিয়ম-নীতি লঙ্ঘনের কারণে ব্যাংকিং খাত বর্তমান রুগ্ন দশায় দাঁড়িয়েছে।

তার ভাষ্য, 'আইন ও নীতি মানার জন্য তৈরি করা হয়। কিন্তু এগুলো যদি মানা না হয় তাহলে সেই আইন ও নীতির যৌক্তিকতা কি? অধিকাংশ ব্যাংকের নাজুক অবস্থার দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এড়াতে পারে না।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংক অগ্রণী, জনতা, রূপালী, সোনালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

এর মধ্যে জনতার খেলাপি ৬০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, অগ্রণীর ২৬ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা, সোনালীর ১৬ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা এবং রূপালীর ১২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।

ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কখনোই এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়, কারণ এটি সুশাসনের মধ্যে পড়ে না।

'যেসব বড় ঋণগ্রহীতা তাদের সামর্থ্যের বাইরে ঋণ পেয়েছেন, তারা এখন ঋণের সুদ পরিশোধ করতে পারছে না,' বলেন তিনি।

তিনি মন্তব্য করেন, 'একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা কেবল রমজানের পণ্য আমদানি এবং বিদ্যুৎ খাতের জন্য শিথিল করা যেতে পারে, কারণ দেশের জন্য বিদ্যুৎ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'

Comments