নতুন বছরও ব্যবসায়ীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে

মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক সুদ, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক সুদ, বাংলাদেশের অর্থনীতি, অর্থনৈতিক সংকট, কেমন যাবে ২০২৪ সাল,
প্রতীকী ছবি, সংগৃহীত

আগামী বছরেরও উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারের কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে বলে মনে করছেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও করপোরেট নেতা। তারা বলছেন, ক্রমবর্ধমান ব্যাংক সুদের কারণে উৎপাদন ও পরিচালনা ব্যয় বাড়তে পারে।

তবে, নতুন সরকার অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিলে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন তারা।

দেশের শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নিউএজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও টাকার মান স্থিতিশীল রাখাই হবে ২০২৪ সালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।'

বিদায়ী বছরটি অনেক ব্যবসা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে আমদানিকারকরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং রপ্তানিকারকরা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক দাম ধরে রাখতে মূলত লড়াই করেছেন।

এছাড়া, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিভার্জ ধরে রাখাতে ব্যবস্থা নেওয়ায় আমদানি কমেছে। এটি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্প কাঁচামাল কেনার ওপর প্রভাব ফেলেছে।

পিডব্লিউসি বাংলাদেশের ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশীদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুনাফা ফেরত পেতে অসুবিধায় পড়েছেন। পাশাপাশি তারল্য সংকটে নতুন বিনিয়োগকারীরা বাধাগ্রস্ত হয়েছেন।

সাবেক এই ব্যাংকার বলেন, অবৈধ চ্যানেলে ডলারের দাম বেশি থাকায় প্রবাসীরা সেখানে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ফলে, বৈধ মাধ্যমে সম্ভাব্য রেমিট্যান্সের মাত্র ৫০-৬০ শতাংশ এসেছে।

তিনি বলেন, 'কিছু বাজারে কিছুটা পতন সত্ত্বেও রপ্তানিকারকরা সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক পরিস্থিতি ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। যদিও বছরব্যাপী রপ্তানি আয়ের পরিমাণ খবরের শিরোনামে ছিল। আবার মূল্যস্ফীতির চাপ সারা বছর মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষকে চাপে রেখেছিল।'

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, '২০২৪ সালে ভূ-রাজনীতি ব্যবসার জন্য একটি ফ্যাক্টর হবে।'

তিনি জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ও বাংলাদেশের জন্য যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।

'বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ও চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যবসায়ীদের নীতিসহায়তা প্রয়োজন,' যোগ করেন তিনি।

অবশ্য ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আশরাফ আহমেদ ২০২৪ সাল নিয়ে বেশ আশাবাদী।

তিনি বলেন, আগামী বছরের চ্যালেঞ্জগুলো হবে ২০২৩ সালের সংকট থেকে পুনরুদ্ধার ও প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ খুঁজে বের করা।

'অন্যদিকে, আমরা আশা করছি বিদেশি মুদ্রার চ্যালেঞ্জ কমে যাবে। ২০২৪ সাল ব্যবসার জন্য আরও ভালো বছর হওয়া উচিত, কারণ দেশে ও বিদেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে, মূল্যস্ফীতি কমতে পারে এবং বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা কমে যেতে পারে।'

তিনি জানান, ২০২৩ সাল আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে সুদ, বিনিময় হার এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মতো মৌলিক বিষয়গুলো কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমরা কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। আমরা অতীতে এই মাত্রার অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখিনি।'

'বিদেশি লেনদেন পরিচালনার ক্ষেত্রেও আমরা এমন চ্যালেঞ্জ দেখিনি,' বলেন তিনি।

তিনি মনে করেন, নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু তেমন কাজে আসেনি। এছাড়া বিধিনিষেধ বিশেষ করে সুদের হারের ওপর বিধিনিষেধ অনেক সমস্যা সৃষ্টি করেছিল।

২০২৪ সাল কঠিন বছর হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'পাঁচ থেকে ছয়টি ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে এবং এসব ব্যাংকের সমস্যা যেন ছড়িয়ে না পড়ে ও পদ্ধতিগত সমস্যায় পরিণত না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।'

সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, 'প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যাংকিং খাতে প্রচুর ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। আমাদের এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাংকিং খাতে আমাদের অনেক সংস্কার দরকার। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্যও সংস্কার প্রয়োজন।'

তিনি বলেন, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর সংঘাতের ঝুঁকির কারণে বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ থেকে গেছে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য পাশ্চাত্যে সুদের হার এখনো বেশি। তাই রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।

ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাভেদ আখতার বলেন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ আরও উচ্চ মূল্যস্ফীতির দিকে ধাবিত হতে পারে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী বলেন, ডলার সংকট ও উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে বিদায়ী বছরটি ব্যবসায়ীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। যেহেতু আগামী বছর একটি নতুন সরকার মুদ্রা সম্পর্কিত কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেবে, তাই আশা করা হচ্ছে- ব্যবসায়ের ওপর চাপ কিছুটা কমতে পারে।

'রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে অভ্যন্তরীণ বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তবে তিনি বলেন, 'পশ্চিমাদের কাছ থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হলে ব্যবসায়ে চ্যালেঞ্জ থাকবে।'

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইস্পাত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে ব্যবসার উন্নতির পূর্বাভাস নিয়ে তারা কোনো আশার আলো দেখছেন না।

তিনি বলেন, '২০২৪ সালেও ব্যবসায়ীদের চ্যালেঞ্জ অব্যাহত থাকবে। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে, স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমরা ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে উন্নতি আশা করতে পারি।'

প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক মনে করেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি ও ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার ২০২৪ সালে ব্যবসার খরচ বাড়াবে।

তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের উন্নতি হলে ২০২৪ সালে ব্যবসা ভালো হবে। রিজার্ভ বাড়লে রপ্তানি পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং উৎপাদন খাত প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে পারবে।

ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ২০২৩ সালে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কিছু ধাক্কার মধ্য দিয়ে গেছে। বিশেষ করে হঠাৎ করে জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়া, টাকার অবমূল্যায়ন, সুদের হারের সীমা তুলে নেওয়া এবং মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি।

তিনি আরও বলেন, '২০২৪ সালে আমরা বড় ধরনের সংস্কার দেখতে পাব। বিশেষ করে কর, আর্থিক ও জ্বালানি খাতে।'

মামুন রশীদ মনে করেন, জানুয়ারির প্রথম দিকে নির্বাচন যদি শান্তিপূর্ণভাবে ও কোনো বিতর্ক ছাড়াই অনুষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ ভালো প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।

তিনি আরও জানান, বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক অংশীদারদের কাছ থেকে উন্নয়ন সহায়তা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা আছে। তবে, সম্ভাব্য রাজনৈতিক ঝুঁকির কারণে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

আসিফ ইব্রাহিম বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতি, পণ্যের দাম ও ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মতো বাহ্যিক কারণগুলো ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।

তিনি বলেন, নতুন বছরে অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ অভ্যন্তরীণ নীতি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভর করবে।

তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার এবং প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুযোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন।

Comments

The Daily Star  | English

Climate finance: COP29 draft proposes $250b a year

COP29 draft deal says rich nations should pay the amount to fight climate change

1h ago