নতুন বছরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আশা কতটুকু?

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

রাস্তার পাশের খাবারের দোকানগুলোয় ছোট ছোট রুটিগুলো কি আগের আকারে ফিরবে? আগের মতো কি ৫০০ টাকায় ব্যাগ ভরে বাজার করা যাবে? যে কয়েক লাখ শিক্ষিত যুবক সংবাদপত্রে নিয়োগের বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে দেখেন, তারা কি নতুন বছরে চাকরি পাবেন?

দুঃখজনক হলেও সত্য, অর্থনীতিবিদরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না যে ২০২৫ সাল আগের বছরের তুলনায় ভালো যাবে, নাকি পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

তারা মনে করছেন, নতুন বছরে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়বে কি না এর উত্তর রাজনীতিবিদদের কাছে।

কিন্তু, অর্থনীতিবিদরা কেন অর্থনীতি সম্পর্কিত প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছেন না?

এর একটি কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কিছুটা হলেও গতি হারিয়েছে।

যেহেতু রাজনৈতিক সংস্কার বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সেহেতু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত আগস্টে পটপরিবর্তনের পর আশা করা হয়েছিল নতুন বছরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হতে পারে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদনের পর সংস্থাটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে সংস্কার ও সংশোধনী তদারকি করায় দেশের ভবিষ্যৎ কিছুটা উজ্জ্বল দেখা যাচ্ছে।

সম্প্রতি আইএমএফ মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, 'আশা করছি, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করবে। ভালো দিন ফিরে আসবে।'

বেশ কয়েকটি বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও আইএমএফ ও দেশের অর্থনীতিবিদরা এ বিষয়ে একমত যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বছর শেষে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নানা দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল।

এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর জাতীয় নির্বাচন ২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের শুরুতে হতে পারে।'

অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থনীতির জন্য সরকার বেশকিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও সমন্বিত উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না।

আর এসব প্রচেষ্টা কোনো কার্যকর ফল বয়ে আনছে না বলেও জানান তারা।

যেমন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে ২০২৪ সালে পাঁচবার নীতিহার বাড়িয়েছে। তবে কাঁচাবাজারে সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যাগুলো সমাধানে দৃঢ় উদ্যোগ নেই।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়লেও চাঁদাবাজি এখনো নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণ বলে স্বীকার করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তার ভাষ্য, 'দীর্ঘদিনের ক্ষমতাধর সরকার এখন ক্ষমতায় না থাকলেও বাজারে অপ্রয়োজনীয় মধ্যস্বত্বভোগীরা এখনো আছেন।'

সুতরাং, সুদের হার বাড়ানো ও আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো হলেও কার্যত বর্তমানের দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি কমছে না। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে তা নয় শতাংশের বেশি থেকে যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আশা করে বলেন, 'আগামী জুনে মূল্যস্ফীতি সাত শতাংশে ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি পাঁচ শতাংশে নেমে আসবে।'

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমানো বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক নীতির কারণে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে।'

নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এক মাস আগে ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর আগের মাসে ছিল নয় দশমিক ৩৪ শতাংশ।

বোরোসহ অন্যান্য কৃষি পণ্যের উৎপাদন প্রত্যাশা পূরণ না করলে আমদানি ব্যাহত না হলে এবং বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান সমস্যা না করলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমতে পারে।

তবে নতুন বছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভালো হওয়ার আশা কম বলে মন্তব্য করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। কেননা, 'রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত' বলে মনে করছেন তিনি।

এ ছাড়াও, আমলাতন্ত্র এখনো পুরোপুরি কার্যকর নয়। শীর্ষ কর্মকর্তাদের বদলি করা হলেও অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি।

তিনি বলেন, ডলারের বিনিময় হার সংস্কার ও অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণের ফলে রেমিট্যান্স আসা বেড়েছে। ফলে রিজার্ভও বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বরে রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ১১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের আট দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার থেকে তা ২৬ দশমিক চার শতাংশ বেশি।

রপ্তানি-রেমিট্যান্স বেশি হওয়ায় চলতি হিসাবের ঘাটতি কমেছে। আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত স্বস্তি দিয়েছে।

ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, 'সামগ্রিক ভারসাম্যে এখনো অনেক ঘাটতি আছে। তবে, এসওএফআর (সুরক্ষিত ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট) কমে যাওয়ায় আমদানি খরচে ভারসাম্য দেখা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।'

তার মতে, বাহ্যিক চ্যালেঞ্জগুলো থেকে গেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য শুল্ক বৃদ্ধি রপ্তানিকে প্রভাবিত করতে পারে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'প্রবৃদ্ধি তিন থেকে চার শতাংশের বেশি নাও হতে পারে। এটা অর্জন করতে পারলে ভালো হবে।'

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে বাড়িয়ে দিতে পারে।

তার ভাষ্য, রাজনৈতিক সমাধান না হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়বে। বেসরকারি বিনিয়োগে প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি হবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অনিশ্চয়তা আছে। এ ছাড়াও, অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ব্যবসায়ীদের হতাশা বাড়িয়ে দিচ্ছে।'

ব্যবসার পরিবেশ তেমন উন্নত না হওয়ায় অর্থনীতি দ্রুত চাঙ্গা হওয়া অনিশ্চিত। এ ছাড়াও, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ সহায়তা কমে যাওয়ায় টাকার দাম বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

'মূল্যস্ফীতি কমাতে অন্যান্য উদ্যোগ যেমন কাঁচাবাজার ব্যবস্থাপনা যথাযথ নয়' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ দিকে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দিকে সরকারের মনোযোগ কিছুটা কমেছে। মূল মনোযোগ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির প্রাথমিক সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ নিয়েছে।

অধ্যাপক রায়হান মনে করেন, 'অর্থনীতি শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। অর্থনৈতিক বিষয়ের তুলনায় রাজনৈতিক বিষয় অগ্রাধিকার প্রাধান্য পাচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Internal democracy still a mirage

With their mass rallies and processions, slogans and posters echoing the will of their electorate, Bangladesh’s political parties project an air of vibrant democracy on the surface.

6h ago